ক্ষণিকের সাক্ষাৎ
ক্ষণিকের সাক্ষাৎ
টিরিং টিরিং টিরিং
বেশ কয়েক মিনিট ধরে ফোনটা বেজে চলেছে।ভাবলাম বাবা ধরবে হয়তো।কিন্তু না।
কলেজ থেকে ফিরে একে শরীরটা ক্লান্ত তারপরেও সেই আমাকেই উঠে নিচের তলায় যেতে হবে মনে হচ্ছে।
নীচে নেমে যতক্ষণে ফোনটা ধরবো দেখি রিং বন্ধ হয়ে গেছে। দেখলাম চারটে মিস কল।তাহলে কি বেশ অনেকক্ষণ ধরেই ফোনটা বাজছিল। কি জানি হবে হয়তো ?
তবে এই ফোনটা আসলে আমার বাবার।কিন্তু বাবার ফোন সঙ্গে রাখার কোনও অভ্যাস আজও গড়ে ওঠেনি। আমি সেটাকে খুলতেই দেখলাম চারটে ফোনকলই করেছে বাবার বন্ধু দীপ্ত কাকু। বুঝলাম যে বাবাকে হয়তো আড্ডা দিতেই কাকু ফোন করেছিল। আজ অবশ্য দিনটাও সেরকমই, বড্ড অলস। মাটির ভাঁড়ে চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্পের আসর বেশ ভালই জমবে। কথাটা ভেবে নিজের মনেই হাসলাম। তারপর বেশ কয়েকবার আমি বাবা বাবা বলে ডাক দিলাম। কিন্তু না, কোনও সাড়া শব্দ নেই। ঘরের মধ্যে আমার ডাকটা প্রত্যুতর না পেয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। আমি বুঝলাম ঘরে কেউ এই। তবে বাবা গেল কোথায় ?
অগত্যা আমি দীপ্ত কাকুকে ফোন করলাম।
দুই তিনবার রিং হতেই দীপ্ত কাকু ফোন ধরল। কিন্তু তার মুখ থেকে যেন কথা বেরচ্ছেনা। কাকুর জোরে জোরে নিঃশ্বাসের শব্দটা আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম। তিনি যেন উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ।
আমি- কাকু।আমি সুজন বলছি।বাবা আসলে ঘরে নেই।বাইরে একটু বেরিয়েছে বোধ হয়।
দীপ্ত কাকু এবার হো হো করে কেঁদে উঠল।
আমি চমকে উঠি।কাকু কি হয়েছে এত কাঁদছ কেন ?
দীপ্ত কাকু-অর্ক আর নেই রে বাবা। (এই বলে আবার হো হো করে কাঁদতে থাকে)
আমি কি বলবো বুঝতেও পারছিনা। অর্ক , দীপ্ত কাকুর একমাত্র ছেলে,কিন্তু নেই মানে। বুকের ভেতরে তখন হৃৎস্পন্দন অনেক অনেক বেশি করে উৎকণ্ঠায় তীব্র হয়ে গেছে। আমি নিজেকে যতটা পারলাম সামলে বললাম নেই মানে ? অর্কর কি হয়েছে।
আমার প্রশ্নের কাকু কোনও উত্তর দিতে পারেনা। শুধু তাঁর কান্নার শব্দটাই যথেষ্ট ছিল যে আমি কোন ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ শুনতে চলেছি। আমার মনে তখন সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে কি...............?
এমন সময় দেখি ফোনের ওপারে বাবা ফোন ধরল।
বাবা মনে হচ্ছিল একটু আগে অব্ধি কেঁদেছে।গলা ভারী হয়ে গেছে তার।
বাবা-সুজন তুই একবার নিমতলা শ্মশানে চলে আয়।অর্কের আজ দুপুরে একটা এক্সিডেন্ট মাথা ফেটে গেছিলো,এখন ডাক্তারে বলছে ও আর বেঁচে নেই।
এই কথাটা শুনে আমার মনে হল পায়ের তলায় জমি সরে গেছে। অর্ক আমার খুব ভালো বন্ধু। এই তো পরশু ওর সাথে দেখা হয়েছিল।আর আজ.......
আমি কি বলবো বুঝতে পারছিনা। আমি মেনে নিতে পারছিনা যে যা আমি শুনছি তা কি আদপে সত্যি।
বাবা- তুই দেরি করিসনা। আসলে তোকে বলার সুযোগ হয়নি। আমি সেই দুপুর থেকেই হসপিটালে আছি। আর তুই কলেজে থেকে কখন এসেছিস খোঁজ নেওয়াও হয়নি। এত জলদি সব হল যে আমি ফোনটাও ঘরে ভুলে এলাম । তুই যত জলদি পারিস আয়। আমরাও যাচ্ছি। বডি’টা আর কিছুক্ষনের মধ্যেই ছেড়ে দেবে।
আমি এখনো নিরুত্তর।কি বলবো বুঝে উঠতেই পারছিনা।
বাবা- শোন একটা ধূপের প্যাকেট সঙ্গে নিয়ে আসিস। সাথে কিছু টাকাও আনিস।আর আমার ফোনটা আনতে ভুলিসনা।
আমি বললাম হুম।আমি এখুনি বেরচ্ছি।
বাবা ফোনটা কেটে দিতে গিয়ে আবার বলল বাইকে আসিসনা আজ।আমার ভয় করছে এবার তোকে নিয়েও।অটোতে আয়।
আমি বুঝলাম কি জন্য।কথামত সব জিনিস নিয়ে বেরলাম ঘর থেকে।কিন্তু এমন দুর্ভোগ যে একটাও অটো নেই।এদিকে সন্ধ্যে হয়ে আসছে।
এর মধ্যেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো।দেখি শর্মিষ্ঠা ফোন করছে।
শর্মিষ্ঠা- সুজন শুনেছিস অর্ক মারা গেছে।
আমি- হ্যাঁয় আমি যাচ্ছি এখন নিমতলাতে। বাবা আগেই পৌঁছে গেছে।আচ্ছা তুই জানিস কি হয়েছিল।বাবা যেভাবে প্যানিক করছে কিছুই বুঝতে পারলাম না।
শর্মিষ্ঠা-আমি যতটা শুনলাম।ও বাইকে ছিল আর টার্নিং পয়েন্টে খুব জোরে বাঁক নিতে গিয়ে স্কিড করেছে।মনে হয় সাইকেল চালাচ্ছিল একটা লোকের জন্য ও ব্রেক চাপে আর সামলাতে পারেনি।
কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই আমি বললাম আচ্ছা শোন এখন রাখি রে।একটা অটো আসছে আমি আগে পৌঁছাই তারপর তোকে সব জানাচ্ছি।
শর্মিষ্ঠা- ওকে। তাই করিস। বাই
ফোনটা পকেটে পুরে এককথায় অটোটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।কারণ কেও যেতেই রাজি নই।অটোটা দাঁড়াতেই বললাম দাদা প্লিজ নিমতলায় নিয়ে চলুন।
মুখটাকে বেজার করে সে বলল না। এখন প্রায় সন্ধ্যে । আমি ফেরার কোনও লোক পাবনা,ফাঁকা গাড়ি আনতে হবে।
অনেক জোরাজুরি করলাম,কিন্তু কিছুতেই সে মানতে রাজি নয়।বিরক্ত হয়ে বললাম যাও যেখানে যাচ্ছিলে।
মনে মনে বেশ বিরক্ত লাগছিলো। প্রথমে অটো ড্রাইভারটার ওপর তারপর বাবার ওপর ।কি দরকার ছিল বাইক আনতে মানা করার। বাইকে এলে কতক্ষণ পৌঁছে যাই।অর্ক এমনিতেই জোরে চালায় কতবার ওকে মানা করেছিলাম। কিন্তু কে কার শোনে।আজ এখন আমি কি করে পৌঁছাই সেটাও বেশ সমস্যা ?
বাবার ফোনটা বেজে ওঠে টিরিং টিরিং....
দেখি দীপ্ত কাকুর ফোন।তুলতেই বাবা অস্থিরভাবে জিজ্ঞেস করে কি রে কতদূর?
আমার এবার খুব বিরক্ত লাগলো বললাম যেখানে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে। কোনও অটো নেই।আর মনে হচ্ছে পাবনা।
বাবা- তোকে বাইকে আসতে বলিনি বলে এমনও নয় যে একটু হাঁটা যাবেনা।হেঁটে সৈয়দ স্ট্রিটের দিকে আয় ওখানে বাস পাবি।
আমি কিছু বলার আগেই দিলো ফোনটা কেটে।।
তীব্র রাগ হচ্ছে আমার।মুখে বলে দেওয়া খুব সহজ আমার বাড়ি থেকে সৈয়দ স্ট্রিট প্রায় বাইকেই লাগে কুড়ি মিনিট।হেঁটে যাওয়া যায় নাকি।
ভাবছি যে কি করি।বাইক নিয়ে চলে যাবো। তবে বাবা জানলে আবার দেখলে রাগ করবে ?
কিন্তু করলে কি করা যাবে শুনি। সৈয়দ স্ট্রিটে কিছু না পেলে।সন্ধ্যে দেখে মনে হচ্ছেনা তখন।ঘড়িতে নজর যেতেই অবাক হয়ে গেলাম।দেখি রাত আট’টা বেজে দশ।
অবাক ব্যাপার মানে আমি প্রায় এক ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে। ভেবেই কোনও উত্তর পেলাম না।সম্বিৎ ফিরে পেতে আরও একমিনিট লাগলো আমার।
ভাবলাম আর না।ঘরে যাই বাইকে বেরিয়ে পড়ি।নাহলে যেতে পারবোনা।ছুটে ঘর থেকে বাইক বের করে দিলাম স্টার্ট...........
বাবা হিরোহোন্ডার এই পুরনো গাড়িটা কিছুতেই বেচবেনা।এটা স্টার্ট করতে রীতিমতো গলদঘর্ম হতে হয়।তবে আজ ভিন্ন। একবারেই স্টার্ট নিলো সেটা। মন বলছে যা দেরি হয়েছে, হয়েছে এবার জলদি পৌঁছে যাবো।
নিমতলার দিকটা আমার ঠিক চেনা নয় তাই গুগলের ম্যাপে জায়গাটা সেট করে বেরিয়ে পড়লাম।
অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে,তাই পিক আপ দিলাম। সৈয়দ স্ট্রিট ছাড়িয়ে আমার বাইক ছুটে চলেছে তখন বুলবুল বাগান দিয়ে।ম্যাপে চোখ যেতে দেখি আর সাত কিলোমিটার দূর ।
বাইকে চেপেই ভাবলাম কেউ বিশ্বাস করবে এইরকম শহুরে এলাকার মধ্যে এমন এক জন-মানবহীন জায়গা।সত্যি যেন এই জায়গাটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।এমন সময় গাড়িতে একবার চোখ যেতেই মনটা চঞ্চল হয়ে উঠলো এ কি দেখছি আমি?
গাড়িতে যে পেট্রোল প্রায় শেষের দিকে। কি হবে এখন ,আমি প্রায় মাঝামাঝি জায়গায়।ফিরে গেলে আর অনেক দেরি হবে।আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাবা ফোন করেই চলেছে মিনিট কয়েক পরপর।আবার এটাও মনে হচ্ছে গাড়িটা একবার বন্ধ হয়ে গেলে যদি স্টার্ট না নেই।এই ঘন জঙ্গলের মতো জায়গায় আমি বেশ ফেঁসে যাবো।
গাড়িটা আরও জোরে ছোটাতে শুরু করলাম আমি।এই সাত কিলোমিটার আমাকে যত জলদি সম্ভব পৌঁছতে হবে। অনেকক্ষণ মানুষ না দেখতে পেয়ে একটু চঞ্চল হয়ে উঠেছে তখন। আমি প্রায়শই বন্ধুদের বলি যে এই শহরের তাড়াহুড়ো ভাল্লাগেনা আমার। দেখিস আমি ঠিক একদিন চলে যাবো কোনও জঙ্গলে।
কিন্তু আজ সেরকম আমি মনেপ্রাণে চাইনা।মানুষের তাড়াহুড়োর সামান্যতম চিন্হের জন্য আমি তখন মরিয়া।
তবে ঈশ্বর সদয়। একটু আরও এগোতেই দেখলাম দূরে একটা দোকান ও সেটায় টিমটিম করে আলো জ্বলছে,সাথে কিছু বাড়িও দেখছি।ভরসা পেলাম।
কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের থেকেই সিগারেটটা খেতে শুরু করেছি।আর এই একবছরে সেটা নেশা হয়ে গেছে আমার।আনন্দে হোক কি অবসাদে মস্তিষ্কের খোরাক এখন সিগারেট। আজও তাই ভিন্ন কিছু হলোনা।
গাড়িটা দাঁড় করালাম। সাথে সাথে মনে পড়লো ধুপ নিতে হবে আমাকে। তাই এগিয়ে গেলাম দোকানটার দিকে........
কাছে যেতেই দেখি একজন বয়স্ক লোক হাঁটু মুড়ে দোকানটায় বসে আছেন। দোকানটায় টিমটিম করে একটি বাটিতে আলো জ্বলছে, আর সেই আলোয় পান বানাচ্ছে লোকটা। ভাবলাম ধুপ পাওয়া কি যাবে এখানে।
আমি কাছে যেতেই লোকটা বলল.....কি চাই ?
আমি বললাম ধুপ আছে তো দিন । তবে আগে একটা সিগারেট দিনতো আমাকে...
বয়স্ক লোকটি বলল এই নাও শেষ ধুপকাটি তোমার জন্য।
আমি অবাক হয়ে বললাম আমার জন্য কেন হবে?
বয়স্ক লোকটি একগাল হেসে বলল কিছুনা, আসলে আমার এই শেষ ধুপ কাটিটা না শেষ হওয়া অব্দি আমি দোকান বন্ধ করতে পারছিলাম না। ভাবছিলাম কেউ এসে নিয়ে যাক।
আমার এই লোকটার কথা রীতিমত অদ্ভুত লাগলো।ভাবলাম বুড়োলোক হয়তো এই দিয়েই দোকান চলে।
বললাম আর সিগারেটটা দিন.....
সে হাসল আর ঝুপ করে দোকানের একটা ছোট কপাট দিয়ে বেরিয়ে এলো। আর সাথে সাথে তাড়াতাড়ি দোকানপাট বন্ধ করতে লাগলো।
আমি এবার রীতিমত বিরক্ত হলাম । বললাম এটা কিরকম অভদ্রতামি, আমি কিছু বলছি তো না কি.....
লোকটার সামনের দুটো দাঁত নেই। তার থেকে অনেকখানি পানের পিক ফেলে সে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল শুধু......
এবার আমার রাগ হল খুব ,বললাম কত হল বলুন।
লোকটার আমার কথায় কোনও উত্তর নেই....
আজব ব্যাপার......মাথা খারাপ আছে না কি ?
আমি তার দিকে কুড়ি-টাকা এগিয়ে দিলাম। লোকটা হেসে হেসে সেই টাকাটা নিয়ে পকেটে পুরে দোকানের ঝাঁপ ফেললো ।
আমি জীবনে এমন লোক দেখিনি সত্যি। কিছু না বলেই এগিয়ে গেলাম নিজের বাইকের দিকে।ভাবল
াম মাথা খারাপ আছে নিশ্চয়।হবে না বা কেন যা জায়গা।......তবে ওরকম কেন বলল শেষ ধুপকাটিটার অপেক্ষায় ছিলাম। কেমন জানি একটা অস্বস্তি হচ্ছিল আমার লোকটাকে দেখে ।
মনে মনে বললাম কে জানে বাবা আর ওমনি দীপ্ত কাকুর আবার কল....
ফোনটা ধরে ধরে আমি বিরক্ত হয়ে গেছি। এবার তাই ধরেই বললাম কি ব্যাপার বলতো বাবা।আমি আসছি তো না কি ?
ফোনে তখন উল্টো দিকে দীপ্তকাকু...তোকে আজ অনেক অসুবিধে ভোগ করতে হচ্ছে না রে বাবা।
লজ্জায় মাথাটা কাটা গেল আমার। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না।তাও বললাম, না কাকু আসলে বাবা এমন বার বার ফোন করছে না। তোমরা এসে গেছো তো ?
উল্টো দিকে উত্তর এলো হ্যাঁ..... আচ্ছা সাবধানে আয়।
বাইকে চেপে দেখি এখানে আমার ফোনের নেট আর কাজ করছেনা।আর সেটা দেখে আমি কিন্তু বিশেষ অবাক হলাম না। কারণ ততক্ষণে শহর ছাড়িয়ে আমি অনেক ভেতরে চলে এসেছি।বাইকে চেপে আরও দ্রুতভাবে আমি এগিয়ে চললাম।।
মিনিট কয়েক পর কিছুদূরে চোখ যেতেই দেখলাম অনেকজন লোক সারিবদ্ধ ভাবে একটা মড়া নিয়ে যাচ্ছে।....ওদের বল হরি হরি বোল শব্দটা কানে ভেসে এলো। বুঝলাম আমি আর বেশি দূরে নেই। সিগারেট না খেতে পেয়ে আমার মেজাজ খানা তখন চটকে গেছে,ওদের পাস কাটিয়ে আমি এগিয়ে যাচ্ছি এমন সময় দেখি গুঊ গুঊ গুঊ করে আমার বাইকটা গেল আটকে। বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম ধূররররর..........
আর পারা যায়না। লোকগুলো আমাকে উপেক্ষা করে তখন এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। এই ঘন জঙ্গলে যদিও বা লোক পেলাম, তাও আবার বাইকটা গেল খারাপ হয়ে।
নিজে নেমে একটু বাইকটাকে খানিক হেলিয়ে দুলিয়ে স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করছি এমন সময় একজন পিছন দিক থেকে এগিয়ে এসে বলল কোন অসুবিধে হয়েছে। আমি কি কিছু করতে পারি ?
এই জনমানবহীন জায়গাটায় আচমকা লোকটার কথাতে আমি খানিক চমকে গিয়েছিলাম। তৎক্ষণাৎ ফিরে তাকাতেই দেখি সাধারণ জামা প্যান্ট পরে এক মাঝবয়সী যুবক আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্নিগ্ধ ভাবে হাসছে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
যুবক-কি হল বাইক খারাপ ?
আমি বললাম হ্যাঁ ।
যুবকটি খানিক গম্ভীর হয়ে আমার বাইকের দিকে তাকিয়ে বলল দেখতে পারি কি ?
আমি সানন্দে বললাম দেখুন যদি কিছু বোঝেন ।
বেশ কিছুক্ষণ সে নেড়েচেড়ে দেখছে। আর আমি শুধু একবার করে ঘড়ি আর একবার করে তারদিকে তাকাচ্ছি গোবেচারার মতো।
হটাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল নিন ঠিক হয়ে গেছে। আমি বাইক চালাইনা তবে কিছুটা জ্ঞান আছে মেরামতির ।
আমি খুশি হয়ে বললাম আপনি আমার অনেক উপকার করলেন। এই বলে পকেট থেকে ২০০ টাকা তাকে এগিয়ে দিলাম ।
যুবক বলল টাকা চাইনা আমার। তবে আপনি যদি বাইকে করে একটু নিমাতলায় নিয়ে যান তো ভালো হয়।
আমি বললাম নিমাতলায় কি জন্য ।
যুবক খানিক হেসে বলল দেখলেন না এই মাত্র একটা মড়া নিয়ে গেল লোকগুলো। আমি তো ওদের সাথেই যাচ্ছিলাম। দেখলাম আপনি পাশে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে নাড়াচাড়া করছেন । তাই একটু দাঁড়িয়ে গেলাম ।
আমি খুব খুশি হয়ে বললাম আরে সে কি বলছেন অবশ্যই।আপনি না থাকলে এই জঙ্গলে আমি একা বাইক নিয়ে মুশকিলে পড়তাম। তবে গাড়িতে তেল কম আছে দেখা যাক কতদূর যায়।
যুবক হেসে বলল ধন্যবাদ।হেঁটে এতদূর যাওয়া যায়না কি বলেন।আচ্ছা যাওয়ার আগে একটা সিগারেট খাবেন নাকি ?
আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একদম আমার মনের কথা যেন এ পড়ে এসেছে.....বললাম আছে ?
যুবক বলল আসুন এদিকে।
দুজনে সিগারেট ধরিয়ে শান্তিতে কয়েক টান মেরেছি ওমনি আবার কল।
ফোন ধরতেই বাবা বেশ চিৎকার করে বলল আর কতদূরে বলত তুই।আমি তাড়াহুড়ো করে গাড়িতে চেপে বসলাম আর ইশারায় তাকেও বসতে বললাম। সিগারেটটা একটা হাতে নিয়ে বললাম এই ঢুকে গেছি আর একটু..... আসলে বাইকটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল(এই কথাটা বলেই নিজেই নিজের জীব কাটলাম। এত চাপ চলছে যে ভুলেই গিয়েছিলাম বাবা মানা করেছিল বাইক আনতে)
বাবা ধমক দিতে শুরু করলো। আমি আর তাই কথা না বাড়িয়ে বললাম এসে বলছি.....
আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে।সাথে আমার পিছনে সেই যুবকটি বসে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু নিস্তব্দ জায়গাটার ঘনঘটায় আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। এতটা চুপচাপ ভাবে ছেলেটা বসে আছে যে বুঝতেও পারছিনা আমার গাড়িতে পিছনে কেউ বসে আছে কি নেই। অগত্যা আমি নিজেই কথা বললাম।
আমি-তো তোমার নাম কি?
যুবক কিছু উত্তর দেয়না।
আমি খানিক অবাক হই।এখানে কি সবাই এরকম নাকি। কেউ কোনও কথা বলেনা।গাড়ি বেশ জোরে ছুটছে আমি মাঝে মাঝে সিগারেটে টান দিচ্ছি।এমনি করে যেতে যেতে কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। বুঝলাম আর একটু এগিয়ে গেলেই শ্মশান।......কিন্তু হঠাৎ একটা গর্তে আমার বাইকটা পড়তেই একটু বেসামাল হয়ে গেল। যেভাবে হোক নিজেকে সামনে বললাম আপনি ঠিক আছেন তো ?
লোকটিকে বললাম আপনি আমার কাঁধে হাত রাখতে পারেন। এখানে রাস্তা খুব একটা ভালো নয়।
কিন্তু যুবকের কোনও উত্তর নেই।
আমি ঠিক করি আর কিছু বলবোনা। কোন কথারই উত্তর দেয়না। অদ্ভুত। কিন্তু এরকম ব্যবহার কেন এদের। মনে মনে অনেক কিছু চলছে তখন আমার।
এমন সময় যুবক বলে উঠলো আপনার কে মারা গেছে ?
আমি বললাম এক বন্ধু।আসলে বাইক চালাতে গিয়ে এক্সিডেন্টে মারা গেছে।
যুবক খানিক চুপ থেকে বলে বাইক ভালো জিনিস নয়। জোরে চালালে হয় নিজে মরে নাহলে লোককে মারে।
আমি নিজেই বাইক চালাচ্ছি তাই কি আর বলি।তাও বললাম কি আর করবেন সাবধানে চালালে অসুবিধে নেই।
যুবক- ঠিক।তবে অনেক সময় তাদের সামান্য ভুলের জন্য অন্য কাউকে মরতে হয়।
আমি বুঝলাম এই যুবক বাইকের বেশ বিরুদ্ধে।
আমি তাই আর কথা বাড়াইনি.....গাড়িটা একটা উঁচু জায়গায় দাঁড় করলাম। দেখি যুবকটি ঝুপ করে গাড়ি থেকে নেমে দূরে একটি চিতার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
আমি সেদিকে আর না দেখেই এগিয়ে গেলাম বাবার দিকে। দীপ্তকাকু আমাকে দেখে জোরে কেঁদে উঠল। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো আমার কাছে ভাষা ছিলোনা। দেখি অর্ককে ওরা চিতায় তুলেছে।একজন বলছে নিন আর দেরি করা ঠিক না আসুন.....
আমার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে।একটা তরতাজা প্রাণ এভাবে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে চলেছে।আমি এ জিনিস চোখে দেখতে পারবোনা।
এগিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।দাঁড়াতেই শুনলাম দুজন বলাবলি করছে দেখো জীবনের আর কি দাম।একসাথে দুটো জোয়ান ছেলে মরে গেল।একজন বাইক উল্টে আর একজন তার বাইকের ধাক্কায়।দেখলেও খারাপ লাগে।
আমি তাদের একজনকে বললাম আর একজন মানে ।
প্রথম অজ্ঞাত ব্যাক্তি- ওই যে আর একটা চিতা দেখছেন।ওটা আসলে আপনাদের এই ছেলের জন্যই মারা গেছে।
আমি শুনে বেশ আহত হলাম।ভাবলাম ওদের ভাষাজ্ঞান নেই দেখছি।
দ্বিতীয় অজ্ঞাত ব্যাক্তি- বেচারা ছেলেটা টিউশনি পড়িয়ে ঘর ফিরছিল।বাবা নেই।এই কম বয়সে নিজের প্রাণটাও হারালো। খুব ভালো ছেলে ছিল অকালে কেমন ঝরে গেল দেখ ? এখন ওর মা টার যে কি হবে ভগবানই জানেন।
আমি খানিক দুঃখ পেলাম শুনে।কারোর মৃত্যু শুনলে এমনিতেই কষ্ট হয় তারপর আবার এমন এক মৃত্যু যেখানে আমার নিজের কেউ দায়ী শুনে মাথা নামিয়ে সরে দাঁড়ালাম। লক্ষ্য করলাম ওই দুই ব্যাক্তি পুনরায় নিজেদের গল্পে মজে উঠেছে ।
কি করবো বুঝতে পারছিনা । তখনই দেখি আমার বাইকে চেপে আসা সেই যুবক একনিষ্ঠে তাকিয়ে আছে অর্কের চিতাটার দিকে।ভাবলাম একটা সিগারেট নিয়ে আসি ওর কাছ থেকে.......
এগিয়ে গেলাম ওর দিকে, বললাম এই যে শুনছো। বলছি তোমার কাছে কি আর একটা সিগারেট হবে।
সে নিরুত্তর। খানিক চুপ করে সে আমার দিকে না ঘুরেই আমাকে একটা সিগারেট এগিয়ে দিল।
আমি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললাম আচ্ছা ঐ যে আরেকটি ছেলে মারা গেছে কে হয় তোমার ?
সে উত্তর দেয়না।
হটাৎ মড়া পোড়ার গন্ধে চারিদিক ভরে গেল।আমি এর আগে কোনোদিন এভাবে আসিনি শ্মশানে।হয়তো এরকমই গন্ধ হয়। নাকে রুমাল চাপা দিতে দিতে লক্ষ্য করলাম ছেলেটির হাতে কেমন একটা পোড়া দাগ। যেন আগুনে ঝলসে গেছে সেটা।
সিগারেটে টান দিতে দিতে অস্পষ্ট ভাবে বললাম এটা কিসের দাগ ? পোড়া মনে হচ্ছে ? আগে তো মনে হচ্ছে দেখলাম না।কখন পুড়ল ?
সে বলল-হ্যাঁ।আগে পোড়া ছিলনা।এই পুড়ছে।
আমি চমকে উঠে বললাম কি ? বুঝলাম না ।
সে বলল এই যে তাকাও ওই দিকে। এই বলে একটা চিতার দিকে সে আঙ্গুল তুলল
আমি তাকালাম কিন্তু এখনো বুঝিনি।পোড়া গন্ধে চারিদিক তখন ভরে উঠেছে।আমি নাক চেপে পাশে তাকাতেই যা দেখি....ছেলেটি আমার দিকে ফিরে তাকিয়েছে নিস্পলক দৃষ্টিতে।
ওর মুখটা চোখে দেখে আমি রক্ত শূন্য হয়ে গেলাম।আমার মুখ দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছে না।
হাত থেকে সিগারেট ফেলে আমি চিৎকার করে উঠলাম ,কিন্তু কেউ যেন আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বের করতে দিচ্ছেনা। মুখ দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে আমার। সাথে হাত, পা, শরীর পুরো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। একি জিনিস দেখছি আমি। ছেলেটিকে দেখে আমার সব স্নায়ু তখন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে। চোখ দুটো মনে হল ভয়ে ঠিকরে বেরিয়ে এলো বলে। কারণ আমি দেখছি সে আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে পুড়ছে আর ধীরে ধীরে তার অবয়ব পুড়ে বেরিয়ে আসছে একটা কঙ্কাল। সে তার একটা আঙ্গুল তুলে একজায়গায় দেখাতেই চোখ ফিরিয়ে দেখি অর্ক ছাড়া আরেকটি চিতা তখন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে । সাথে অজ্ঞাত ছেলেটির চিতার পাশে বসে থাকা এক মহিলার হাউ হাউ করে বুকফাটা কান্না। আর আমি হতবাক হয়ে চেয়ে দেখছি,
ছেলেটি হাসি মুখে আমাকে বলছে ওই যে দেখো এখুনি আমি পুড়ছি। দেখ ঐদিকে..........।