দেবদত্ত চট্টরাজ

Drama Classics Inspirational

4.0  

দেবদত্ত চট্টরাজ

Drama Classics Inspirational

শুধু ৩৭০ টাকা মাত্র

শুধু ৩৭০ টাকা মাত্র

5 mins
378



জীবনে এমন অনেক কিছু মুহূর্ত থাকে যা সারাজীবনের জন্য মনে গেঁথে যায়।সবসময় যে তা কোনো চিরপরিচিত কারোর সাথেই হবে তা নয়,সেটা একদমই এক অজ্ঞাত কারোর সাথেও হতে পারে।আজকে তাই যেখানে এখন মানুষ শুধু নিজ স্বার্থ চরিতার্থের দিকে তৎপর সেখানে এক কিশোর আত্মভিমানের কথাই বলবো।

সুতরাং কোনো ভনিতা না করে সোজা শুরু করি সেই ক্ষুদ্র সাক্ষাতের কথা।যেখানে আমাকে যুগের সাথে তালমিলিয়ে চলতে গিয়ে ভুলে যাওয়া কিছু পাঠ পড়িয়েছিলো একটি ছোট ছেলে,






সেদিন টিভি দেখছিলাম অফিসের থেকে ফিরে এসে।দিনটা খুবই ক্লান্তকর ছিল।জ্যৈষ্ঠ মাসের কাঠফাটা রোদে, বাসে করে অফিসে থেকে ফেরার পর মনে হচ্ছিল শরীরটা আর চলবেনা।তাই ঘরে এসে স্নান করে মাকে বললাম

আমি-মা কোথায় গেলে?

মিনিট ২ পর মা উত্তর দিলো কি হয়েছে এত চিৎকার করে ডাকছিস কেন?

আমি-শরীরের থেকে এত ঘাম বেরিয়েছে যে কি বলি তোমাকে।একটু শরবত দেবে তো।তারপর একটু চা বানিয়ে দিয়ে যেও

কিছুক্ষন পর এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত এনে মা দিয়ে গেল।

মা-শোন বাবু ,চা একদম ঘরে নেই ।তোকে কবে থেকে বলছি যে অফিসে ফেরার পথে চা নিয়ে আসিস।কিন্তু কে কার কথা শোনে।

শরবতটা খেয়ে একটু সুস্থ লাগছিলো তাই উঠে পড়লাম চা টা নিয়ে আসার জন্য।

আমি-মা দরজাটা লাগিয়ে নিও।আমি বেরোলাম

পিছনে দরজা লাগানোর খুট করে শব্দটা শুনতে পেলাম কিছুক্ষণেই।

সকালে যতই গরম হোক না কেন সন্ধ্যে বেলাটা আজ বেশ আরাম লাগছে । বেশ হওয়া দিচ্ছে।পাড়াতেই একটা চায়ের দোকান আছে গিয়ে বললাম

আমি-লুস চা টা ২৫০গ্রাম দেবেন তো?

দোকানদার-এই নিন

আমি-কত হয়েছে?

দোকানদার-১৩০টাকা।

আমি-আচ্ছা। এই বলে ওকে ৫০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিলাম।

লোকটা ৩৭০ টাকা ফেরত দিলো।

এর পর একটু আড্ডা দেব বলে পাড়ার কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে চলে গেলাম।গল্প গুজব করতে করতে কখন দেখি রাত ৮ তা বেজে ২০ মিনিট।চকিতে উঠে পড়লাম সেখান থেকে।অফিসের বেশ কিছু কাজ ও বাকি আছে সেগুলো আজ সেরে ফেলতে হবে ঘরে গিয়ে।বন্ধুদের অনেক কাকুতিমিনতি সত্ত্বেও দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে ঘরের দিকে রওনা হলাম।

বাড়ি যাওয়ার আগের গলিটা এখন নির্জন কেও কোত্থাও নেই।শুধু কয়েকটা কুকুর নিজেদের মধ্যে ঘেউ ঘেউ করছে।গলিটা থেকে বেরিয়ে ঘরে ঢোকার কিছুটা আগে দেখি একটা ছেলে একটা ঠেলাগাড়ির ওপর বসে আছে আর কাঁদছে।এড়িয়ে চলে যাচ্ছিলাম কিন্তু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে ওর কান্নাটা আমার মনটাকে চঞ্চল করে তুলল।খানিকটা তাই ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।

ছেলেটা দেখতে ওই ১৩ কি ১৪ বছরের হবে।এই একলা রাতে বসে কাঁদছে কেনো বেশ উৎসুক হয়ে উঠলাম আমি।

আমি-এই তুমি এখানে এভাবে বসে কাঁদছো কেন?

ছেলেটি মুখ তুলে আমার দিকে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম এবার কিছুটা

সহানুভূতির সাথে।

-কি হয়েছে ভাই । আমাকে বলো।রাতে এভাবে এই নির্জন রাস্তায় বসে কেন তুমি?

এবার সে আমার দিকে তাকালো ভালো করে আর বলল

-আমি সুবোধ । এই সামনের বস্তিতে আমার বাড়ি।

কাল আমার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফর্ম জমা দেয়ার শেষ দিন কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই।

ওর নিষ্পাপ চোখ গুলো ছল ছল করে উঠলো।

বুকটা ভার হয়ে এলো আমার ,তবুও জিজ্ঞেস করলাম তোমার বাড়িতে কে কে আছে?

-বাবা নেই, দাদা।

-মা লোকের ঘরে কাজ করে আর বোন ছোট এখন প্রাইমারিতে পড়ে।মা অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি টাকা জোগাড় করতে।

আমি-তোমার মায়ের নাম কি ?

-মিন্টু দাস, বলে ছেলেটি

মিন্টু মাসিকে আমি চিনি উনি আমাদের ঘরেও কাজ করেন।অবাক হলাম মিন্টু মাসির ছেলে মাধ্যমিকের টাকা দিতে পারছেনা তবুও একবার জানায়নি।খানিক অবাক হলাম,তবে তার সাথে উনার মানুষের কাছে সাহায্য না চাওয়ার জেদটা ভেবেও আমি আশ্চর্য হলাম।

সুবোধ তখন দেখি আবার মাথা নামিয়ে বসে আছে।

বললাম কত টাকা লাগবে তোমার ফর্মের।

-সে বলল ৩০০ টাকা।

পকেটে হাত ঢুকিয়ে চা কিনে ফেরত পাওয়া পুরো

৩৭০ টাকাটা ওকে ধরিয়ে দিলাম।

-এতে ৩৭০ টাকা আছে । তুমি কাল ফর্ম ভরে নিও সাথে কিছু পেন পেন্সিল কিনে নিও বাকি টাকাটাই।

সুবোধ দেখি নির্বাক।

সে বলে না দাদা, মা বারণ করেছে কারোর কাছে চাইতে।

অনেক বার ওকে বলা সত্ত্বেও ও নিতে না চাওয়ায়।ওর নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে ওর হাত থেকে টাকাটা নিয়ে মাটিতে ফেলে দিলাম।জীবনে কোনোদিন টাকা মাটিতে এভাবে ফেলিনি তবুও আজ করতে হলো আমাকে।

-তোর মা কে বলিস তুই কারোর কাছে হাত পাতিসনি।কুড়িয়ে পেয়েছিস কেমন।

সুবোধের চোখ থেকে জল বের হয়ে আসছে।আমার মনটাও খুব ভার হয়ে আছে।ওর আর মিন্টু মাসির জীবনে হার না মানা এই জেদ আর সুবোধের পড়ার ইচ্ছেটা আমার মনে চিরকাল থেকে যাবে।আমি না দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে হাটতে শুরু করি।বুঝতে পারি সুবোধ অবাক হয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে হয়তো।বাড়ি ফিরে মাকে চা টা দিয়ে বলি চা করতো একটু।

মা বলে এত দেরি হলো তোর কেন রে?

আমি বললাম রাস্তায় জীবনের হার না মানা জেদের সাথে দেখা হয়ে গেছিল মা।

মা বললো- কি ?

আমি মুচকি হাসলাম।

এর পর কেটে গেছে আটটা মাস।দৈনন্দিনের কাজকর্মে ভুলেই গিয়েছিলাম সেই দিনের কথাটা।

আজ দিনটা সোমবার।রবিবারের ছুটি কাটিয়ে সবচেয়ে কষ্টকর লাগে আজকে কাজ করতে যাওয়াটা।তারপর অফিসের একটা ফাইলে সামান্য একটা ভুলের জন্য বসের কাছে অনেক ঝাড় শুনতে হলো।বেশ খিটখিটে লাগছিলো সারাদিন।ভাবলাম ছুটির পর সোজা ঘরে গিয়ে আজ শুয়ে পড়বো, কোথাও আড্ডা দিতে যাবোনা।কথামতো ছুটির পরেই ছুট্টে গিয়ে বাসে চেপে পড়ি।বাস থেকে নেমে বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছি দেখি অনেক লোকজন আজ গলিটার কাছে ঘোরাঘুরি করছে।জিজ্ঞেস করলাম একজন কে দেখে

-কি হয়েছে দাদা।আজ এখানে এত লোক কিসের?

-এই বস্তির একটা ছেলে আজ মাধ্যমিক তৃতীয় হয়েছে পুরো রাজ্যে। মেয়র নিজে এসেছিলেন তার বাড়িতে।ওকে পুরস্কার দেওয়া হবে যে।টিভিতে দেখাচ্ছে ওকে।

কি বলবো আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না।আমার চকিতে সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল।দৌড়ে গেলাম ঘরের দিকে।মন বলছে যে কে হতে পারে। এরকম উত্তেজনা আগে অনুভব করিনি।ঘরে গিয়ে কড়া নাড়তে দেখি দরজা তা খোলাই আছে।

-মা কোথায় আছো?

মা বলে ওঠে

-এই বাবু জানিস মিন্টুর ছেলেটা মাধ্যমিকে রাঙ্ক করেছে?

আমার মনের কথাটা পূর্ণ হলো।একরাশ আনন্দ নিয়ে জামা প্যান্ট না ছেড়েই আজ দৌড়ে টিভি র ঘরের দিকে গেলাম।দেখেই বুঝলাম ঠিক সেই ছেলেটি।অন্ধকার গলিতে সেদিন উদাস চেহারাটা আজ আত্মবিশ্বাসে বেশ উজ্জ্বল লাগছে।চোখের কোনের কালিটা আজ ওর কৃতিত্বের সামনে মলিন হয়ে গেছে।

রিপোর্টার জিজ্ঞেস করলো

-তোমার ভবিষ্যতে কি হওয়ার ইচ্ছে আছে।

সুবোধ সাবলীল ভাবে বলে

-আমার মাধ্যমিক দেওয়ার ঠিক ছিলোনা।আজ সেটাই পাস করতে পেরেছি।এখনো জানিনা কি হতে পারবো তবে চেষ্টা করবো মায়ের কিছুটা কষ্ট কমাতে।

-আচ্ছা সুবোধ তোমার এই কৃতিত্বে কাকে তুমি সবচেয়ে বেশি অংশীদার ভাব?

সুবোধ সহজ ভাবে বললো -আমার মা যে আমাকে শত কষ্টেও পড়াশোনা ছেড়ে কাজ করতে বলেনি।

একটু কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বলে

-আর এক পাড়ার দাদা যার নাম অব্দি আমি জানিনা, যে আমার পরীক্ষার ফি টা দিয়েছিল তাকে।

সুবোধের গলা বসে আসছে কান্নায়।বুঝে রিপোর্টার ওকে জল এগিয়ে দিল।

এদিকে আমার চোখের কোনেও জল তখন।

মনে মনে বললাম-অনেক বড় হ ভাই। আরো এভাবে এগিয়ে যা।

জীবনে এই প্রথমবার নিজেকে সত্যিকারের নায়ক বলে মনে হচ্ছিল। আর সাথে সাথে বুঝলাম সেটার মূল্য ছিল খুব বেশি না মোটে,শুধু ৩৭০ টাকা মাত্র



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama