এক কাপ চা মিষ্টি ছাড়া
এক কাপ চা মিষ্টি ছাড়া
#অনুপ্রেরণা – সাংসারিক মানুষের টান ও পরিবারের প্রতি মোহ
প্রতিদিন রঞ্জনবাবু বাজার থেকে সব্জী কিনে ফেরার পথে বটুকের চায়ের দোকানে দাঁড়ান,আজও তার অন্যথা হয়নি।
হাতে সবজি ভর্তি থলি।অন্য হাতে একটা ছাতা।
-বটুক কোথায় গেলে একটা চা'তো দিয়ে যাও।
-কি হে মিত্তির। কেমন আছো ?অনেক দিন তো তোমার দেখাও মেলেনি কি ব্যাপার --বলে উঠলেন রঞ্জনবাবুর পাশের বাড়ির মালিক নিশিত মল্লিক।
এক গাল হেসে রঞ্জন বাবু এগিয়ে গেলেন বটুকের দোকানের সামনে বেঞ্চটায় বসে থাকা নিশিত বাবুর দিকে।
-সেরকম কিছুই না মল্লিক মশাই।আসলে মেয়ে এসেছে বহুদিন পর ,সাথে নাতনিটাকেও নিয়ে এসেছে।যেমনি হয়েছে চঞ্চল আর ওমনি হয়েছে আমার নেওটা। একটুকু পিছু ছাড়েনা।অবশেষে গিন্নিকে বলে কিছুক্ষন কার্টুন চালিয়ে বসিয়ে রেখে এই বাজার টুকু করে এলাম আর কি।
নিন চা টা ধরুন।
বটুক যে কখন এসে চা দিয়েছে বোঝাই যায়নি।
তবেএকচুমুক খেয়েই চেঁচিয়ে উঠে রঞ্জন বাবু বললেন এটা কি করেছ হে বটুক।
-কেন কি হয়েছে ?
-গরম জলটাকে চা বলে ধরিয়ে দিলে
এবার হেসে বটুক বললো কি করবো বলুন আপনার মেয়ে এসে বলে গেছে যে ,আপনি এলে চিনি ছাড়া চা দিতে,আপনার নাকি অনেক সুগার হয়েছে।খেয়ে নিন এটাই ভালো আপনার জন্য।
মুখভঙ্গি করে রঞ্জনবাবু বললেন হয়েছে হয়েছে অনেক ডাক্তার হয়েছ সবাই।
-আহা কি হয়েছে বসো এখানে ,বললো নিশিত বাবু।
-আর কি বলি মশাই।ঘরে একফোঁটা মিষ্টি খাওয়া যাবেনা ,সাথে এই বটুকটাও আজকাল মস্ত ডাক্তার হয়েছে।জীবনটা এই সুগারটাই ছারখার করে দিলো।
রঞ্জনবাবুর কথা শুনে মল্লিকমশাই আর বটুক খিকখিক করে হেসে ওঠেন।এরপর খানিকক্ষণ গল্পগুজব করে রঞ্জনবাবু ফিরে আসেন বাসায়।
রঞ্জনবাবু-কই কে কোথায় আছো নাও ব্যাগটা নিয়ে যাও।
(রঞ্জনবাবুর ঘরের বহুদিন ধরে কাজ করছে নান্টু সে এসে ব্যাগটা নিয়ে গেল)।
এরইমধ্যে কোথাথেকে ধূমকেতুর মতো ছুটে এসে রঞ্জনবাবুর নাতনি ঝাপিয়ে কোলে চেপে বসে।আর সাথে সাথে রঞ্জনবাবুর মেয়ে ধমক দিতে শুরু করলো,
-এই এরকম করিসনা।দাদুর বয়স হচ্ছে এভাবে ঝাপিয়ে কোলে চাপলে কিছু একটা বিপদ ঘটবে।
এই মেয়েটা যে কখন শান্ত হবে কে জানে।
-আহা থাক থাক।কয়েকদিন পর আর ওকে পাবো কোথায়।(একটু উদাস ভাবে বললেন রঞ্জনবাবু)
-দাদু তুমি চকোলেট এনেছো আমার জন্য
-ইশ সত্যি তো একদম ভুলে গেছি ।আমার তুলির জন্য বিকেলে আমি অবশ্যই কিনে নিয়ে আসবো।
পাশের ঘরে থাকা রঞ্জনবাবুর স্ত্রী বললেন শুধু ওর জন্যই এন নিজে খেয়ে ফেলনা একেই ইনসুলিন দিতে হচ্ছে।রঞ্জনবাবু বিরক্তি প্রকাশ করে উঠে পড়লেন।
বেশ কাটছিল দিনগুলো রঞ্জনবাবুর,তবে সবার একটা শেষ আছে এক্ষত্রেও তাই হলো,একে একে কখন যে সব ছুটি শেষ হয়ে গেল বোঝাই গেলোনা আর তাই আবার ব্যাঙ্গালোরে ফেরত যাওয়ার দিন চলে এলো।তিনি তার নাতনির জন্য,নিঃসঙ্গতাটা যে এক মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারেননি তা আজ তুলি যেতেই বুঝতে পারলেন।আজ তুলি চলে যেতেই যেন ঘরটা খাঁ খাঁ করছে।ঠিক যেমন শরীর তার প্রাণ হারিয়েছে।
------------------------------------------
আচ্ছা এবার বলি ঘটনাটা আসলে কি...............
রঞ্জনবাবু তার একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন ব্যাঙ্গালোরে কর্মরত তাদেরই পাড়ার এক ছেলের সাথে।ভালোবেসে বিয়ে হয়েছিল তাদের।কিন্তু বিয়েতে রঞ্জনবাবুর মত ছিলোনা।এখন যদিও নাতনি হওয়ার পর রঞ্জনবাবুর মন অনেকখানি গলে গেছে ,তবে দীর্ঘবছর জামাই ও তার মধ্যে কথা না হওয়ায় তিক্ততার রেশ আজও বর্তমান।তাই শুধু তুলি ও তার মেয়ে তার বাড়িতে আসে,জামাই আসেনা।শশুর আর জামাইয়ের মধ্যে যে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়নি তা কিন্তু মোটেও নয়।তবে পুরোনোপন্থী রঞ্জনবাবু যেন আজও এই বিয়ে মন থেকে মেনে নিতে পারেননি।আর সেইজন্য এই পরিবার বাইরের লোকের কাছে পরিপূর্ণ দেখালেও বাড়ির লোকের কাছে অপূর্ণ রয়ে গেছে।
তো যাই হোক...... বেশ কিছুদিন দাদুর সাথে কাটিয়ে তুলি ওর মায়ের সাথে চলে গেল।আর নাতনি চলে যাওয়ার পর রঞ্জনবাবু ও তার স্ত্রী আবার একলা হয়ে পড়লেন।
আবার রোজকারের মতো তাদের দিন কাটতে শুরু করলো।
রঞ্জনবাবু সকালে উঠে বাজার করেন,বাইরে চা খান তারপর ঘরে গিয়ে টিভি দেখেন আর নাতনির সাথে ফোনে কথা বলেন।
তার বহুবার ইচ্ছে হয়েছে যে তিনি ও তার গিন্নি দুজনেই চলে যাবেন মেয়ের কাছে।কিন্তু পরক্ষণেই ভাবেন দুজন অসুস্থ,বিশেষ করে তার সুগারের জন্য প্রতিদিন ইনসুলিন নিতে হয় তাই সেখানে গিয়ে আবার তার মেয়ের ওপর চাপ বাড়াবেন হয়তো।আর তার চেয়েও বেশি যে ছেলেটিকে তিনি জামাই বলে মেনে নেননি তার ঘরেই কিনা উঠতে হবে।এই জিনিস কল্পনা করেই তিনি আজও সেখানে যাননি।তার গিন্নি বরং দু একবার গেছেন মেয়ের সাথে।কিন্তু তিনি একবারো না।
তবে নাতনী তার কাছে জীবন,তার সাথে কথা যেন ফুরোতেই চায়না।মাঝে মাঝে তার গিন্নি বলে ফেলেন এত কিসের কথা আছে বলতো তোমাদের......
রঞ্জনবাবু হাসেন,বলেন ওসব তুমি বুঝবেনা।তুলি আমার নাতনি নয় শুধু,ও আমার বাঁচার শেষ ইচ্ছে।
মেয়ে চলে যাওয়ার পর ঘরটায় যেন মন টিকছেনা তার।তাই সুযোগ পেলেই বটুকের চায়ের দোকানে এখন তিনি চলে যান।
এই রকমই এক বিকেল বেলায়,
মল্লিক মশাই-কি ব্যাপার হে মিত্তির,নাতনী চলে যেতেই যে দুবেলা চারবার করে চলে আসছো।
রঞ্জনবাবু হালকা হেসে বলেন না সেরকম কিছুই নয়।তবে কি করি বলুন তো জীবনটা প্রায় কেটেই গেল।এই শেষ বয়সে গল্প করার লোকের খুবই অভাব।তুলি যতদিন ছিল তাও মনটা ভালো লাগতো ঘরে গিয়ে।
মল্লিক মশাই রঞ্জনবাবুর কথাগুলো শুনে খানিক অনুভব করলেন,মনে মনে ভাবলেন সত্যি ভদ্রলোকের কি করারই বা আছে।
রঞ্জনবাবু-এই বটুক দুটো চা বানা।একটা মল্লিকবাবুকে দে আর আমারটা চিনি বেশি করে দিয়ে দিস।
মল্লিকমশাই খানিক উত্তেজিত হয়ে বললেন তুমি এগুলো কি শুরু করেছ বলতো মিত্তির।বাঁচার ইচ্ছে কি নেই নাকি?
রঞ্জনবাবু খানিক গম্ভীর হয়ে বলেন জানেন বাঁচার ইচ্ছে আমার সেদিনই শেষ হয়ে গিয়েছিল যেদিন অনিমা ওই ছেলেটাকে বিয়ে করেছিল।
মল্লিকমশাই খানিক অবাক হয়ে বলেন বলো কি হে?
তুমি আজও সেই এতবছর পুরোনো রাগ নিয়ে বসে আছো।আচ্ছা মুশকিল তোমাকে নিয়ে বাপু।
রঞ্জনবাবু এবার মল্লিকমশাই এর দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি বুঝবেন না মশাই।নিজের মেয়ে যখন বাবার পছন্দের পরোয়া না করে...............
(আর কিছু বলে উঠতে পারেন না তিনি)
মল্লিকমশাই বুঝতে পারেন নাতনি জীবন হতে পারে কিন্তু ভদ্রলোকের অভিমান কিন্তু আজও গলেনি।
মল্লিকমশাই -শোন সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সকলকেই বদলাতে হয়।আর তাছাড়া সৌম্য খুব ভালো ছেলে।আমি দেখেছি তো।
রঞ্জনবাবু এবার উত্তেজিত হয়ে বলেন কিন্তু ওর বাবা নয়।মনে নেই আপনার কিরকম ভাবে আমাকে অপমান করেছিল যখন আমি কথা বলতে গিয়েছিলাম।সৌম্য ভালো ছেলে আমি জানি আর সেই কারণেই মেয়ের ইচ্ছে মেনে তার কাছে যাই
কিন্তু তিনি...............
আর সৌম্য সেদিন কি করছিল জানেন।চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।আর অনিমা ওভাবে সুইসাইড না করতে গেলে হয়তো সৌম্য বিয়েও করতোনা।
>
মল্লিকমশাই-আমি সবটাই জানি।কিন্তু তুমি এটা বোঝ এখন তো সবাই মেনে নিয়েছে তাহলে তোমার অসুবিধেটা কোথায়?
রঞ্জনবাবুর এতক্ষনে রাগে অভিমানে চোখে জল চলে এসেছে,তিনি উগ্রভাবে বলে উঠেলন অসুবিধেটা হলো অনিমার এভাবে নিজেকে ছোট করাটা।ওকে আমি স্বাবলম্বী করতে চেয়েছিলাম।ও আমার আত্মবিশ্বাস ছিল।কিন্তু ও কি করলো...........আমার ভালোবাসার কোনো প্রতিদান না দিয়ে নিজে সুইসাইড করতে গেল তাও এমন একজনের জন্য যে নিথরের মতো দাঁড়িয়ে ছিল যখন ওর বাবাকে এই গোটা পাড়ার সামনে সবাই ছি ছি করছিল।
ও আমার মাথা হেঁট করে দিয়েছে মল্লিকমশাই।
মল্লিকমশাই আর কিছু বললেন না।বটুক এতক্ষন এই সব কথা শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।চা উথলে পড়ে যেতে তার জ্ঞান ফিরলো।
কয়েক মিনিটের একটা নিস্তব্ধতা ভাঙল বটুকের কথায়,
-চা'টা ধরুন।
রঞ্জনবাবু কিন্তু পুরোনো স্মৃতিমন্থন করে তখনও অভিমানে গজগজ করছেন।আর মল্লিকমশাই যে কি বলবেন তার ভাষা নেই।
কিছু একটা বলতে গিয়েও রঞ্জনবাবু যেন আটকে গেলেন, হয়তো ভাবলেন বলে কি লাভ।মল্লিকমশাই কিন্তু তার এই বহুপুরোনো প্রতিবেশিটিকে হাঁড়ে হাঁড়ে চেনেন।তিনি জানেন রঞ্জনবাবু রেগে গেলে কি কান্ড করেন.....তারপর এখন আবার ডায়বেটিস খুব,ডাক্তার তাকে মানা করেছে রাগারাগি করতে।
তাই সব কিছু ভেবে তিনিও চুপ রইলেন।আর ওদিকে রঞ্জনবাবু চায়ে চুমুক না দিয়েই উঠে পড়লেন।তার মন আজ আর ভালো নেই।
বটুকের শত চেষ্টাতেও তিনি আজ আর চা খেলেন না,তার প্রাপ্য টাকা মিটিয়ে হাঁটা দিলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে।
রাত তখন হবে ওই সাড়ে দশটা।
সবাই যে যার সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত,এমন সময় রঞ্জনবাবুর ফোনে একটা কল এলো,
টিরিং টিরিং...........
ভদ্রলোক চশমাটা চোখে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরখ করে দেখতে চাইলেন কে করেছে....কিন্তু এটা কোনো পরিচিতের নাম্বার নয় ,080 9523.......
080 হ্ম্ম তাহলে ব্যাঙ্গালোরের নম্বর এটা।তিনি ফোনটা তুললেন।
-হেলো কে বলছেন
-হেলো মিস্টার রঞ্জন মিত্র বলছেন কি?
-হ্যা বলুন
-আমি ইন্সপেক্টর পি.গৌড়া বলছি আর.এম.সি পুলিশ স্টেশন থেকে।
হটাৎ করে এত রাতে পুলিশের ফোন শুনে রঞ্জনবাবু তড়াক করে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।তিনি উৎকন্ঠার সাথে জিজ্ঞেস করেন কি হয়েছে অফিসার
-আজ হাইওয়েতে একটা কার একসিডেন্ট হয়েছে,গাড়িতে দুজন এডাল্ট আছেন আর একটা চাইল্ড।দুজনের মধ্যে একজন মেল আর একজন ফিমেল।
রঞ্জনবাবু বুকটা কেঁপে ওঠে।তিনি কোনোকিছুই বলার মতো অবস্থায় নেই
-আমরা যতক্ষণে রেসকিউ করি দুজন মারা গেছেন,আর চাইল্ডের অবস্থা এখন কিছুটা ভালো।গাড়ি থেকে যে পার্স পাওয়া গেছে, আমরা সেখানেই আপনার নাম্বার পাই।আপনারা এখানে এসে বডি সনাক্ত করে যান।
কিছু বলার মতো আর ভাষা নেই রঞ্জনবাবুর।তিনি মন থেকে কথাগুলো মেনে নিতে পারছেন না।তার মনে আজ বিকেলে জমা সব অভিমান যেন নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।তিনি পাথরের মত ফোনটা ধরে দাঁড়িয়ে রয়ে গেলেন.......
গিন্নির শতবার জিজ্ঞেসা করা সত্ত্বেও তার কাছে কোনো উত্তর নেই।কারণ তার মন মানতে চায়না যে এরকম ভাবে তার পরিবার শেষ হয়ে যাবে।তার কাছে তিলার্ধ সাহস নেই এই কথাটুকু তার গিন্নিকে বলার,আর তিনি বলবেনই বা কি?
তবে সময় লাগলনা এই খবর ছড়াতে।ছেলেটির পরিবার যেহেতু সেই পাড়াতেই তাই আগুনের মতো এই খবর নিমেষে ছড়িয়ে পড়লো পুরো পাড়ায়।আর তার সাথে এই মধ্যরাতে পাড়ার সকলে এসে রঞ্জনবাবু র বাড়িতে হাজির হলো।
ইতিমধ্যে মল্লিকমশাই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন রঞ্জনবাবুর ঘরে আর ঢুকেই দেখলেন আকস্মিক এই দুঃসংবাদ পেয়ে রঞ্জনবাবুর স্ত্রী মূর্ছা গেছেন।প্রতিবেশীদের মধ্যে কিছুজন তখন তার চোখে মুখে জল দিচ্ছে।আর সোফায় রঞ্জনবাবু তখন জ্ঞানশূন্য হয়ে বসে আছেন।
মল্লিকমশাই এগিয়ে গেলেন রঞ্জনবাবুর দিকে।বিকেলের সেই উত্তেজিত মুখখানা এখন গ্লানির ভারে নিচু হয়ে আছে।ভদ্রলোক খুবই কঠিন মেজাজের কিন্তু আজ তিনি শিশুর মতো কাঁদছেন আর নিজের মাথা চাপড়াচ্ছেন।
মল্লিকমশাই- এভাবে বসে থেকোনা মিত্তির।তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে কি হবে ভেবেছো?
এবার রঞ্জনবাবু কেঁদে উঠলেন।নিজের একমাত্র মেয়ে জামাইয়ের এই খবর শুনে তিনি আজ পুরোপুরি পর্যুদস্ত।তিনি মল্লিকমশাইকে বললেন এসব আমার জন্যই,আমি আজই বলছিলাম আর দেখুন........আর আমার বাঁচার কিছুই রইলনা।
তার কথায় আজ জড়তা স্পষ্ট।তার আবেগ আজ আর নিয়ন্ত্রণে নেই।
মল্লিকমশাই- এভাবে বলোনা, নিয়তিকে কে খণ্ডাতে পেরেছে বলতো।তাছাড়া তুমি ভুলে যাচ্ছ কিভাবে যে তোমার নাতনী এখনো বেঁচে আছে।তার কথা ভাবো।এভাবে তুমি ভেঙে গেলে তার কি হবে ভেবেছো?
ওদিকে ছেলের বাড়িতে তখন কান্নার শোরগোল পড়ে গেছে।ঘরের ছেলের মৃত্যুসংবাদের খবর যে সঠিক তা নাকি ছেলের বাড়ির কোনো এক ব্যাঙ্গালোরে থাকা আত্মীয়ের কাছেই জানতে পেরেছে তারা।আর তাদের মৃতদেহ আনার ব্যবস্থাও করছে।
রঞ্জনবাবু হটাৎ উঠে দাঁড়ালেন তার কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে যাওয়া চোখের জল মুছে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন
-আর তুলি?
মল্লিকমশাই আপনি যাবেন আমার সাথে আমার নাতনিকে আনতে।
মল্লিকমশাই খানিক অবাক হলেন তারপর বললেন চলো দেরি করোনা।
দীর্ঘদিনের প্রতিবেশী বন্ধুটির এই দুঃসময়ে, তার কাছে কোনো ভাষা ছিলোনা সান্তনা দেওয়ার।তিনি ভেবেছিলেন হয়তো রঞ্জনকে এইযাত্রা আর বাঁচানো যাবেনা কারণ মেয়ের আত্মহত্যার চেষ্টায় তার একবার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল।কিন্তু রঞ্জনবাবুর এই কোথায় তিনি স্পষ্ট হলেন ,না রঞ্জনের বাঁচার কারণ কিন্তু এখনো শেষ হয়নি।
তারা বেরিয়ে পড়েন ব্যাঙ্গালোরের উদ্দেশ্যে।।।
এরপর কয়েকসপ্তাহ কেটে গেছে।
সৎকার করে যে যার আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।তুলি এখন কিছুটা সুস্থ।তবে তার মাথায় চোট এখনো বেশ গম্ভীর তাই সে বেশিরভাগ সময় এখন ঘুমায়।
প্রায় দশদিন রঞ্জনবাবু বাড়ি থেকেই বের হননি শুধু নাতনির সেবাযত্ন করতেই তিনি ব্যস্ত।
দশ দিন পর এক সকালবেলায়,
রঞ্জনবাবু আগের মতো শাকসবজি আর মাছ কিনে ঘর ফিরছেন।
মল্লিকমশাই- কি হে মিত্তির তুমি যে সব্বাইকে ভুলে গেলে দেখছি।বলি এই পুরোনো বন্ধুটিকেও একটু সময় দাও(বেশ রসিকার সুরে বলেন)
রঞ্জনবাবু স্মিত হেসে এগিয়ে যেতেই মল্লিকমশাই বটুককে দুটো চা দিতে বলেন......
আজ বহুকাল পর পুরোনো বন্ধুটিকে অনেক সাবলীল দেখে মল্লিকমশাই খুশি হয়ে বলেন তোমাকে যে আর এভাবে দেখবো ভাবতে পারিনি মিত্তির।
রঞ্জনবাবু খানিক হেসে বলেন কি করবো বলুন।ভেবেছিলাম আর বেঁচে কি লাভ,মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, এবার গেলেই বাঁচা যায়, কিন্তু ঈশ্বরের কি পরিহাস দেখুন..........জীবনের শেষ সময়ে দাঁড়িয়ে এখন আবার মনে হচ্ছে যে আমাকে বাঁচতে হবে।
মল্লিকমশাই উত্তর দেওয়ার ভাষা পেলেন না।তিনি রঞ্জনবাবুকে দেখে বুঝলেন, যে আজ তিনি পুনরায় বেঁচে উঠেছেন।তবে তার নিজের জন্য নয়,তার নাতনির জন্য।তিনি খুশি হয়ে বটুককে বললেন বুঝলে বটুক,চা'টা বানাও জলদি আর মিত্তিরকে আজ মিষ্টি দাও বেশি করে।
তবে মল্লিকমশাই এর কথা কেটে রঞ্জনবাবু বললেন না না।আমার মিষ্টি খাওয়া চলবেনা মশাই,এখনো অনেকদিনের যাত্রা বাকি........বটুককে উদ্দেশ্য করে বলেন শুধু এক কাপ চা দাও মিষ্টি ছাড়া।