Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Romance Classics

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Comedy Romance Classics

খুঁজে পাওয়া ভালোবাসাকে

খুঁজে পাওয়া ভালোবাসাকে

13 mins
569


মানুষের জীবন ভীষণ অনিশ্চিত ঘটনায় ভরা থাকে - কখন কার জীবনে কী ঘটে, কেউ জানে না আগের থেকে। তাই ভাবনার সাথে বাস্তবের মিল পাওয়া খুবই মুশকিল। প্রবাদ আছে ইংরেজিতে - Man proposes, god disposes। 


ভার্সিটির ক্লাস শেষে বের হতেই দেখি আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে প্রচণ্ড বৃষ্টি হবে। এই আবহাওয়াটা যদিও আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরার তাড়া মাথায় নিয়ে রওনা হতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি শুরু হল।

এইরে! ছাতাই তো আনিনি। তাই আর এগিয়েও লাভ নেই। আবার ভার্সিটিতে গিয়ে ঢুকলাম। 


কোথায় যাব ভাবছি। হঠাৎ মনে হল, আরে ক্লাসে যাচ্ছি না কেন? যেই ভাবা, সেই কাজ।

কিন্তু ক্লাসে গিয়েই আমি অবাকের চেয়েও বেশি অবাক হলাম। অবশ্য হাসিও পাচ্ছে খুব! একটা মেয়ের কান্না দেখে যদিও আমার মত ছেলের হাসি পাওয়ার কথা না। তবুও হাসি চাপাতে পারছি না!

--কিরে নবনী , কাঁদছিস কেন?

কোনো রকমে হাসি চাপিয়ে নবনীকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

নবনী আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। কারণ নবনীর সাথে সাধারণত কেউ কথা বলে না! টানা দুই বছর একসাথে ক্লাস করার পরও আমিও তো ওর সাথে কোনোদিন কথা বলিনি! অবশ্য ও বড়লোকের মেয়ে বলে অনেকে ওর সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তারা কেউই নবনীর সত্যিকারের বন্ধু না।

--জানিস সূর্য, আমাকে না রাজা অনেক বাজে বাজে কথা শুনিয়েছে! আমি এখন কি করব বলতো?

এতক্ষণে আমি নবনীর কান্নার অর্থ খুঁজে পেলাম। রাজা আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে স্মার্ট ছেলে। কথাবার্তায়, চালচলনে কেউই ওর সমান হতে পারবে না। আর অনেক ধনীও।

আমি ভার্সিটির সেই প্রথম দিন থেকেই দেখছি, নবনী রাজার পিছনে ঘুরছে। রাজা ওকে তো পাত্তা দিচ্ছেই না, উল্টো যা নয় তাই বলে যায়। ইচ্ছে মত ওকে দিয়ে এটা ওটা করিয়ে নিচ্ছে। ক্লাসের যত এ্যাসাইনম্যান্ট আছে, সব তো নবনীই ওকে করে দেয়। তারপরেও মেয়েটাকে বাজেভাবে গালিগালাজ করে রাজা । শুধু নবনী বোকাসোকা আনস্মার্ট একটা মেয়ে বলে। রাজা পারেও বটে!

রাজাকেও অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। ও আমাদের ক্লাসেরই সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে অর্পিতাকে পছন্দ করে। অর্পিতা আর রাজাকে প্রায়ই একসাথে ঘুরতে, আড্ডা দিতে দেখা যায়। তারপরেও দেখছি নবনী হাল ছাড়েনি!

--কি বলল রাজা তোকে আজকে?

--আমি আজকে রাজাকে আমার মনের কথা, আমার ফিলিংসের কথা সব বলেছি। কিন্তু ও আমাকে কি বলল জানিস?

বলেই আবার ফোঁপাতে শুরু করল নবনী।

--আরে বলনা! এত নাটক করছিস কেন?

--ও বলেছে, কোনোদিন পেঁচা দেখেছ? আয়নায় গিয়ে দেখ, তাহলেই দেখতে পাবে! বলে ও আর ওর বন্ধুরা সবাই মিলে হাসাহাসি করেছে।

এই বলে নবনী আবার কাঁদতে শুরু করল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসি চেপে বললাম,

--আসলে কি হয়েছে জানিস? আমরা সবাই সবসময় সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে থাকি। যা আমার কোনোদিনই হবার নয়, তার দিকেই হাত বাড়াই। আমাকেই ধর, আমি ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই অর্পিতার উপরে ক্রাশ খেয়েছিলাম। তারপর আস্তে আস্তে যখন দিন গেল, তখন নিজে থেকেই বুঝলাম, ওর পিছনে ছুটে লাভ নেই। তাইতো এখন আর ওকে নিয়ে কোন ফিলিংস কাজ করে না।

--কিন্তু আমি যে রাজাকে সত্যিই খুব ভালবাসি। আমি ওকে ছাড়া কিছুই ভাবতে পারি না..

আমি আর হাসি ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না। হাসতে হাসতেই বললাম,

--তাহলে তো তোকে ম্যাডাম ফুলির মত চেঞ্জ হতে হবে। অর্পিতার মত না হলে তো রাজা তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না..

আমার কথায় দেখলাম নবনীর চোখ চকচক করছে! আমাকে জিজ্ঞেস করল,

--কিভাবে নিজেকে চেঞ্জ করব? বলনা!

আমার হাসি এবার আর থামছে না। মেয়েটা আমার মজাকেও যে সত্যি ভাববে, তা কে জানত?

কতক্ষণ হাসার পর খুব সিরিয়াস লুক নিয়ে বললাম,

--তোর গেট আপে চেঞ্জ আনতে হবে! তোর এই খ্যাত মোটা ফ্রেমের চশমা আর এই অতি সাধারণ লুক, সব বদলাতে হবে।

আমি এবার নবনীর দিকে ভাল করে তাকিয়ে বললাম, 


--তোর চেহারা তো ঠিকই আছে, গায়ের রঙও ভাল। কিন্তু তুই তো একটু সাজিসও না। আর এত লম্বা চুলে বেণী করিস কেন? আসলেই তুই একটা ক্ষেতের ডিব্বা! 


--আচ্ছা, এগুলো চেঞ্জ করার জন্য কি কি লাগে?

আমি এবার আরও সিরিয়াস লুক নিয়ে বললাম,

--সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফ্যাশন ডিজাইনার!

এবার আমার হাসি আর কোনো বাধাই মানল না। আমি হো হো করে হেসে উঠলাম।

--সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফ্যাশন ডিজাইনার? ওরা কি করবে?

--ওরা তোর এই বোকা বোকা ভাব আর বোকা বোকা চেহারা চেঞ্জ করবে। বুদ্ধু কোথাকার!

বৃষ্টি থেমেছে। তাই আমি ওখানে বসে থেকে মেয়েটার বোকা বোকা কথা আর শুনতে চাইলাম না। নবনীকে ওখানে বোকার মত চিন্তিত অবস্থায় বসিয়ে রেখেই আমি হাসতে হাসতে চলে এলাম।

কয়েকদিন পর।

নবনী এখন রাজার পিছনে না, বরং আমার পিছনে ঘুরছে। আর সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার মনে হচ্ছে আমি উটপাখির মত গর্তে মাথা দিয়ে মাটি চাপা দেই! কি যে করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।

ক্লাসের সবাই ভাবছে, নবনী এখন রাজাকে ছেড়ে আমাকে ধরেছে। পবন তো সরাসরি বলেই বসল,

--সূর্য, তোর তো দারুণ লাভ হয়েছে রে দোস্ত!

--কেন দোস্ত?

--আরে ব্যাটা আগে মিষ্টি তো খাওয়া!

--কারণ না বললে মিষ্টি খাওয়াব কিভাবে? 


--আরে ব্যাটা এত ধনী একটা মেয়েকে পটাইলি, এখন তো তুই সোনায় সোহাগা!

--ধনী আবার কে?

--আরে আমাদের ক্লাসের ধলা চশমা, নবনী!

--ফালতু কথা বাদ দে। আমি গেলাম। 


বলে না হয় ওর কাছ থেকে চলে যাওয়া গেল, কিন্তু ক্লাসের বাকিরা? ওদের কাছ থেকে কিভাবে পালাব? কি বলব ওদেরকে?

আজকে আবার নবনী আমার কাছে এসেছে। আজকে আর পালালাম না। যা হয় হবে,ওর মুখোমুখি হলাম।

-- কি চাস তুই?

--এতবার তোকে ডাকি, তোর কি কানেও ঢোকে না নাকি? কানে তুলো দিয়ে রেখেছিস?

--আমি কানে ভালই শুনি। কি বলবি সরাসরি বল।

--সরাসরি বলার জন্যই তো তোর পিছনে এতদিন ঘুরছি!

--আরে বলনা!

--তুই যে সাইকিয়াট্রিস্ট আর ফ্যাশন ডিজাইনারের কথা বলেছিলি, সেটা একটু খুলে বল।

--আগে বল, আমি তোকে এই ব্যাপারে সাহায্য করলে তুই আমাকে আমার ব্যাপারে সাহায্য করবি?

--আচ্ছা করব।

--শোন, আমি যেটা এতদিনে বুঝেছি, তা হল, তোর সবকিছুতেই স্মার্টনেসের অভাব আছে। তোর চলাফেরা, কথাবার্তায় চেঞ্জ আনার জন্য একটা সাইকিয়াট্রিস্ট আর গেট আপে চেঞ্জ আনার জন্য একটা ফ্যাশন ডিজাইনার লাগবে। এটাই আমি সেদিন বলেছিলাম।

কোনোমতে একটা কিছু নবনীকে বুঝিয়ে দিলাম। কারণ আমার এখন দরকার ওর কাছ থেকে দূরে থাকা আর ক্লাসমেটদের বিরক্তিকর হাসাহাসি থেকে বাঁচা।

নবনী আমার কথা শুনে বলল,

--সেটা না হয় বুঝলাম। আমার পরিচিত একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আছে। কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনার কোথায় পাই?

এবার আমি পকেট থেকে আমার চেনাজানা এক আপুর কার্ড বের করে নবনীর হাতে ধরিয়ে দিলাম। আমার চেনাজানা সবার কার্ড আমি সবসময় পকেটেই রাখি।

নবনীi আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। আমি এতদিনে ওর হাসি দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটার হাসিটা তো খুব সুন্দর! একেবারে যেন বুকে গিয়ে বিঁধে। আমি নবনীর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি, হঠাৎ শুনলাম ও বলছে,

--কিরে, কিছু বলছিস না যে?

আমি বাস্তবে ফিরে এসে বললাম,

--কি বলব?

--জিজ্ঞেস করছিলাম, তোকে কি ব্যাপারে যেন সাহায্য করার কথা বলছিলি। কাজটা কি? 


--ও, হ্যাঁ । কাজটা হল, এই এক বছর তুই আমার সামনে ভার্সিটিতে আসতে পারবি না। কোনো দরকার হলে ফোনে কথা বলবি, কিন্তু সবার সামনে কথা বলতে পারবি না। দেখছিসই তো, সবাই আমাদেরকে নিয়ে উল্টাপাল্টা গুজব ছড়ায়, এতে তোরই ক্ষতি হবে।

--আচ্ছা ঠিক আছে। আর কিছু?

--আমার জন্য এইটুকু করলেই চলবে।

বলে আমার মোবাইল নাম্বারটা নবনীর হাতে দিয়ে চলে আসলাম। 


রাতে হঠাৎ দেখি আমার মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। তাতে লেখা-

'তুই কি সত্যিই মনে করিস আমি চেঞ্জ হতে পারব?-নবনী'।

কেন যেন ওর প্রতি খুব মায়া হল। মনে হল মেয়েটাকে সাহস দেই। এই মূহুর্তে ওর সাহসের খুব দরকার। আমি ওকে সাহস দিয়ে মেসেজ পাঠালাম, 'আমার বিশ্বাস, তুই একদিন নিজেকে চেঞ্জ করে খুব সহজেই রাজার মনে জায়গা করে নিবি। তখন দেখবি, তুই না, রাজাই তোর পিছনে পিছনে ঘুরবে!'

নবনী রিপ্লাই দিল, 'আমার এই বিপদের সময় তোর মত একজন ভাল ফ্রেন্ডের সাহসই আমার খুব দরকার ছিল রে।'

এরপরের দিন থেকে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ক্লাসে স্যার নবনীর রোল ডাকলে একটা বোরখা পড়া মেয়ে এটেনডেন্স দেয়। বুঝলাম, আমার সাথে যাতে দেখা না হয়, তাই নবনী বোরখা পড়া শুরু করেছে! আমি সেদিন বাসায় ফিরে অনেক হাসলাম। এত সহজ সরল মেয়ে আসলে আমি আমার জীবনে এই পর্যন্ত দেখিনি!

এর কয়েকদিন পর দেখি নবনী আর কারো সাথেই মিশছে না! সবার থেকেই আলাদা হয়ে চলছে। মুন্নী ওর খুব ভাল ফ্রেন্ড। ওকে জিজ্ঞেস করতেই ও রেগে বলল,

--ওই ম্যাডাম ফুলির কথা বলছিস? ওকে তো এতদিন আমরা ভালমত চিনতেই পারিনি যে, ও এত দেমাগি! কি হয়েছে জানিস?

--কি হয়েছে?

--নবনী সেদিন এসে আমাদেরকে বলেছে, ও নাকি নিজেকে চেঞ্জ করে ম্যাডাম ফুলি হবে! আমরা কি বলব? হাসতে হাসতেই গড়াগড়ি খাচ্ছি। বললাম, যা কখনো সম্ভব না, তা করার চেষ্টাও করিস না, পস্তাবি। আর তুই হবি চেঞ্জ? আয়নায় নিজের চেহারা দেখেছিস? ও তখন কি বলল জানিস?

--কি বলল? 


--ও বলল যে, আমরা নাকি কেউই ওর দুঃসময়ের বন্ধু না। বলে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল! ন্যাকা একটা।

আমি মুন্নীর কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। বুঝতে আর বাকি রইল না, নবনী নিজেকে পরিবর্তন করার জন্য সবকিছু বিসর্জন দিচ্ছে! কেন যেন এই ভেবে নবনীর জন্য মন খারাপ হতে লাগল যে, এখন থেকে ওকে পুরো একাই চলাফেরা করতে হবে!--------------------

একবছর পর।

এত তাড়াতাড়ি যে কিভাবে একবছর পার হয়ে গেল টেরই পেলাম না! এই বছরটায় অনেক ব্যস্ত সময় কাটিয়েছি। অবশ্য এই ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও বারবার কেন যেন নবনীর কথা খুব মনে হয়েছে! ওর সরলতা, প্রথম খেয়াল করা সেই মিষ্টি হাসি, ওর বোকা বোকা কথা, সবকিছুই বারবার মনে পড়তে লাগল। নবনীর এই এক বছরের পুরো একাকীত্বকে ভেবে কেন যেন ওর প্রতি আমার মায়া হতে লাগল।

এই এক বছরে যে নবনীর সাথে একেবারেই যোগাযোগ বন্ধ ছিল, তা না। প্রায়ই ওর খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে, সরাসরি না। টেক্সট করে। ওকে সাহস যুগিয়েছি, ওর হতাশা কাটানোর চেষ্টা করেছি। মাঝে মাঝে ওকে মজার কথা বলে হাসানোরও চেষ্টা করেছি। নবনীও কোনো সমস্যায় পড়লে আমাকে মেসেজ দিত।

আজ ভার্সিটি বন্ধ। তাই টিউশনি করানোর জন্য বিকালে বের হচ্ছি, হঠাৎ দেখি মোবাইলে নবনীর মেসেজ এসেছে। সেখানে লেখা-

'এক বছর পর এখন তো আর তোর আমার সাথে সরাসরি দেখা করতে বা কথা বলতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না!'

আমি এর রিপ্লাইয়ে 'না' লিখে পাঠিয়ে দিলাম। এরপর আর কোনো মেসেজই আসল না!

দুইদিন পর।

আজ ভার্সিটিতে গিয়ে দেখি একটা নতুন মেয়ে আমাদের ক্লাসে এসেছে! কিন্তু ভার্সিটির কোর্সের মাঝখানে কিভাবে নতুন স্টুডেন্ট ভর্তি হতে পারে, তা আমার মাথায় ঢুকল না। আর এই নতুন মেয়ের চেহারার সাথে কার যে চেহারার খুব মিল আছে, তাও মনে করতে পারছি না!

সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে এই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে। সবার মনেই হয়ত বা একই প্রশ্ন, কে এই স্মার্ট মেয়েটা যে আমাদের ক্লাসের অর্পিতাকেও হার মানিয়েছে!

স্যার ক্লাসে এসে যখন রোল ডাকছেন, সবাই খুব সাগ্রহে মেয়েটার রোলের জন্য অপেক্ষা করছিল। স্যার নবনীর রোল ডাকতেই মেয়েটা এটেনডেন্স দিল! সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আর আমি এতক্ষণে খেয়াল করলাম, হ্যা, এটাই তো সেই নবনী!ও যাই চেঞ্জ করুক, ওর তো চেহারার কোনো পরিবর্তন হয়নি।

ক্লাস শেষে আমি বের হয়ে যাচ্ছি, দেখি নবনী আমাকে পিছন থেকে ডাকছে।

--এই সূর্য, একটু দাঁড়া।

আমি পিছন ফিরে বললাম,

--কি বলবি বল।

--আমি তোর সাথে বাসায় যাব। আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারবি না? 


আমি চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আজকেও সেই এক বছর আগের মতই সবার দৃষ্টি আমার দিকে। কিন্তু সে দৃষ্টিতে এখন আর আগের মত বিদ্রূপ নেই, আছে হিংসা।

আমি নবনীকে কিছু বলতে যাব, সেই মূহুর্তে দেখি, রাজা নবনীকে ডাকছে! নবনী প্রায় না শোনার ভান করে আমাকে টেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল।

এরপরের দিনগুলো থেকে দেখা গেল, নবনী সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকে! ক্লাসের সবাই এখন ওকে ফ্রেন্ড বানাতে চায়, ওর সাথে মিশতে চায়, কিন্তু ও কাউকেই পাত্তা দেয় না। এর মধ্যে অনেকে ওকে প্রপোজও করে ফেলেছে। কিন্তু ও সারাক্ষণ আমার সাথেই আঠার মত লেগে থাকে। আর সবাই আমার দিকে হিংসুটে চোখে তাকায়। আমার অবশ্য ভালই লাগে! কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয়, ও যদি সবসময়ের জন্য এভাবেই আমার সাথে আঠার মত লেগে থাকত! কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামাল দেই। এটা কখনওই হওয়ার নয়। একে তো আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির, তার ওপরে আবার রাজার জন্যই নবনী নিজেকে পরিবর্তন করেছে। সে রাজাকেই পছন্দ করবে, আমাকে কখনোই করবে না।

-----------------------------

তিন সপ্তাহ পর।

রাজা এতদিন নবনীকে কিছু বলার সু্যোগ পায়নি। কারণ রাজা ডাকলেই নবনী আমাকে নিয়ে প্রায় কোনোরকমে পালিয়েছে! আজকে আর রাজের সহ্য হল না। নবনী বের হওয়ার আগেই রাজা বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইল। যেই নবনী বাইরে বের হয়েছে, অমনি রাজা তার হাত ধরে বলল,

--চল আমার সাথে।

নবনী বলল, যাব কিন্তু আমার সাথে সূর্যও যাবে!

বলে আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে রাজা যেখানে নবনীকে নিয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে নিয়ে চলল। তারপর রাজাকে বলল,

--এবার যা বলার বল, সূর্যকে সামনে রেখেই তোমাকে বলতে হবে।

রাজা আমার দিকে ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর বলল,

--আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। তুমি কি আমাকে এখনও আগের মত ভালবাসো?

রাজার কথা শুনে প্রথমদিকে নবনী না করে দিল। কিন্তু রাজা অনেক কাকুতিমিনতি করার পর নবনী শেষ পর্যন্ত রাজি হল।

আমি এরপর বাসায় ফিরে আসলাম। কিন্তু এক অদ্ভুত অনুভূতিতে নিজেকে আবিষ্কার করলাম! রাজার সাথে নবনীর এই প্রেম হয়ে যাওয়ায় আমি খুশিও হলাম, আবার কেমন যেন কষ্টও আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার কি যেন হারিয়ে গেছে! খুব শূন্য শূন্য লাগছে সবকিছু। আমি কি তাহলে সেদিনই নবনীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম, যেদিন প্রথম ওর মিষ্টি হাসিটা খেয়াল করেছিলাম? কিন্তু এখন আর বুঝে কি হবে? আমি তো এতদিন নিজেই নিজেকে বুঝতে পারিনি! যা হওয়ার সব তো হয়েই গেছে। সব শেষ এখন আমার!

নবনীকে এখন প্রতিদিনই রাজার সাথে বের হতে দেখি। আমাকে সময় দেয় না, তা না। ক্লাসে সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকে, আর ক্লাসের পর রাজার সাথে। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয়, আমার সাথে নবনীর কাটানো সময়গুলো খুব তাড়াতাড়িই কেটে যায়! এখনো প্রতিদিন নবনীর সাথে মেসেজের মাধ্যমে কথা হয়। ও আমাকে প্রায়ই বলে একটা সুন্দর মেয়ে দেখে প্রেম বা বিয়ে করে ফেলতে। কিন্তু আমি তো ওর মাঝেই আটকে গেছি। নবনীই যে আমার প্রথম আর সত্যিকারের প্রেম, তা কি আমি তাকে কখনো বলতে পারব? নাকি নিজের মধ্যে চেপে রেখেই আস্তে আস্তে নিজেকে নিঃশেষ করে দেব?

----------------------

এক বছর পর।

আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সবাই যার যার ভালবাসার মাঝে আজ সুখ খুঁজে নিচ্ছে! কিন্তু আমি যাচ্ছি নবনীর বাসায় নবনীর আমন্ত্রণে । সবাইকেই ও আজকে নিমন্ত্রন করেছে । নবনীর বাবা মা নাকি ওকে চাপ দিচ্ছে বিয়ে করার জন্য। তাই সে আজ সবাইকে ডেকেছে যাতে সবার সামনে রাজার সাথে ওর রিলেশনশিপের কথা ঘোষণা করতে পারে। আমি প্রথমে যেতে চাইনি। কি দরকার আমার কাটা ঘায়ে আরও নুনের ছিটে লাগানোর? কিন্তু শেষ পর্যন্ত নবনীর অনুরোধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

নবনীদের বাসায় গিয়ে একটা ধাক্কা খেলাম। এত সুন্দর গোছগাছ বাসা আমি খুব কমই দেখেছি! বাসাটায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ নবনীকে দেখতে পেলাম। এত সুন্দর লাগছে ওকে যে আমি চোখই ফেরাতে পারছি না ওর দিক থেকে! এখন আর সেই মোটা ফ্রেমের চশমা ওর চোখে নেই, তার পরিবর্তে এখন লেন্স পরে। শাড়ি পরে খুব সুন্দর করে খোঁপা করে খোঁপায় ফুল গুঁজেছে! এতেই এত অপূর্ব লাগছে ওকে!

আমাকে দেখেই নবনী তার চিরচেনা সেই মিষ্টি হাসিটা আমাকে উপহার দিল, যেটা দেখেই আমি প্রথম ওর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছিলাম।

আমিও নবনীর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসি হাসলাম।

তারপর ওর বাবা মা এল সবাইকে আপ্যায়ন করতে। খুব হাসিখুশি তাঁরা। মেয়ের পছন্দকেই ওনারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।

একটু পরেই নবনী এল। পাশেই রাজা দাঁড়িয়ে আছে। সে এসে বলল,

--আজকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ভালবাসা দিবস। আর তাই আজকেই আমি আমার পছন্দের মানুষের কথা সবাইকে বলতে চাই, যাকে আমি বিয়ে করব বলে ঠিক করেছি। যাকে আমি আমার একাকীত্বের সেই এক বছরে চিনতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি যে তাকেই আমার দরকার! তার চেয়ে যোগ্য আর ভাল ছেলে হয়ত বা আমার জন্য কেউই হবে না। যার উৎসাহ প্রদানের জন্যই এতদূর অতিক্রম করে আমি নিজেকে জানতে পেরেছি, নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে পেরেছি। যার হয়ত টাকা নেই কিন্তু মেধা আছে, মানুষকে উপকারের মন আছে..

নবনীর কথাগুলো আমি শুনতে পাচ্ছি কিনা তাও টের পাচ্ছি না, নীচের দিকে তাকিয়ে আছি আর প্রমাদ গুনছি। আর কিছুক্ষণ পরেই আমার নবনী আর আমার থাকবে না। রাজার সাথে সুখের সংসার করবে সে, সাথে থাকবে সুন্দর ফুটফুটে বাচ্চা। আর চিন্তা করতে পারছি না আমি, চলে যাব ভাবছি। কিন্তু এখন এতজনের সামনে থেকে কি চলে যাওয়া ঠিক হবে?

নবনী আবার বলতে শুরু করল,

--কেউ জানতে চাইবেন না এত কেয়ারিং সে ছেলেটা কে? সে হল আমাদের ভার্সিটিতে আমার ক্লাসেই পড়ুয়া সূর্য! আমি তাকেই ভালবাসি।

আমি নবনীর কথা শুনে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! কিন্তু নবনী আমার দিকে তাকিয়েই মিষ্টি হেসে বলতে লাগল,

--তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছিলে আমি রাজাকে ভালবাসি? কিন্তু তুমি ভুল ভেবেছ! আমি রাজাকে ওভাবে ভালবাসতে পারিনি যেভাবে তোমাকে ওই একটা বছর ভালবাসা শুরু করেছিলাম! আমি যখন থেকে মানুষ চিনতে শিখেছি, তখনই বুঝেছি, রাজা নয়, তুমিই আমার যোগ্য। রাজা কখনোই আমার প্রেমে পড়েনি, পড়েছে আমার স্মার্টনেসের প্রেমে। আর এটা তো রাস্তার অহরহ ছেলেরাই পড়ে। কিন্তু তুমি ছিলে আমার বিপদে সাহস যোগানোর সত্যিকারের বন্ধু। আমি আমার সেই একাকীত্বের এক বছরেই তোমার প্রেমে পড়েছি, সূর্য। তোমার কি এর বিরুদ্ধে কোনো অবজেকশন আছে?

আমি হাসতে হাসতে মাথা নেড়ে 'না' বোঝালাম। এই বোকা মেয়েটা যে কখন আমাকে ভালবেসেছে, আমি টেরই পাইনি!

আর রাজা ? সে তো আমার দিকে তার ক্ষুব্ধ দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে! মনে হচ্ছে আমাকে হাতের কাছে পেলে সে আস্ত চিবিয়ে খাবে!

নবনী এসে আমাকে বলল,

--কি হল? চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু তো বল!

আমি আনন্দে কি বলব খুঁজে না পেয়ে বললাম,

--তুই আমাকে তুমি করে বললি যে?

--এখন থেকে তুমিও তাই করবে। কারণ আগামী মাসেই আমাদের বিয়ে হবে! বউকে নিশ্চয় ফ্রেন্ডের মত তুই করে ডাকতে পারবে না! ডাকলে তা বেমানান লাগবে। 


--কিন্তু আমি কি তোমাকে সুখী করতে পারব?

--সুখ কি শুধুই টাকা-পয়সা দিয়ে হয়? তুমি আমার পাশে থাকলে আমি এমনিতেই সুখী হব। আর বাবা মা তো আমি যাকেই বিয়ে করি না কেন, তাতেই রাজি। কারণ উনারা আমাকে বিশ্বাস করেন। আর আমি তোমাকে।

--আমি কখনোই তোমার বিশ্বাস ভাঙব না, দেখো।

বলে নবনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

-----------------------

তিন বছর পর।

--কি ম্যাজিস্ট্রেট সাহেব, একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে পারেন না? জানেন না, আপনি দেরি করে বাসায় ফিরলে বাবু রাগ করে!

অভিমানী গলায় নবনীর কথা শুনে হেসে বললাম,

--বাবু রাগ করে নাকি বাবুর মা রাগ করে?

--দুজনেই!

--তাহলে তো রাগ ভাঙাতেই হয়। কিভাবে ভাঙাব? 


--যদি বাবুর বাবা সারাক্ষণ বাবুর মায়ের পাশে থাকে তাহলে দুজনেরই রাগ ভাঙবে। 


--আছি তো, সারাজীবন থাকব।

বলে নবনীর দিকে তাকালাম। নবনী আমার দিকে তাকিয়ে সেই মিষ্টি হাসি হাসল। যা দেখার জন্য আমি প্রতিনিয়ত ওকে খুশিতে রাখার প্রচেষ্টায় থাকি।

এই তিন বছরে অনেক কিছু ঘটেছে আমাদের জীবনে, আর সবই সুখের ঘটনা। নবনী আমার জীবনে আসার পর থেকে যেন সুখে ভরে যাচ্ছে জীবন!

আমি ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছি। খুব ভাল বেতন পাই, আর সম্মানও। আর আমার নবনীও কম যায় না! সে এখন একটা কলেজের প্রফেসর। আমাদের এই সুখের সংসারে একটা নতুন অতিথি আসতে চলেছে! এর চেয়ে আনন্দের খবর আর আমার কাছে নেই। সবাই তাই আমাদের সবার জন্য, বিশেষ করে আমাদের বাবুটার জন্য প্রার্থনা করবেন। ও যেন ওর মায়ের মতই সাহসী আর আত্নবিশ্বাসী হতে পারে।।।হয়ত এরকম নানা ধরনের ঘটনায় ভরা মানব জীবন, আর এই বিচিত্র রূপের জন্য এই জীবন এত প্রিয় আমাদের কাছে। তবে একটা বিষয় কিন্তু ঠিক, প্রকৃত ভালোবাসা কখন হারে না। অসংখ্য লড়াই -এর মধ্যে দিয়ে সে জয়লাভ করে। সেই প্রাপ্তি, সব ব্যথা - যন্ত্রনাকে ভুলিয়ে দেয়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Comedy