Sheli Bhattacherjee

Tragedy

3  

Sheli Bhattacherjee

Tragedy

খেলার ছলে

খেলার ছলে

4 mins
944


"কিসের যেন একটা আওয়াজ হচ্ছে না রে?" নেশাগ্রস্ত গলায় বলল সুবীর। 

"কিসের বলতো?" প্রতাপের গলাতেও নেশারঝোঁক। 

কারো পক্ষেই ঠিক চোখ মেলে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকানোর ক্ষমতা নেই তখন। আকণ্ঠ মাদকতায় দুই বন্ধুর মস্তিষ্ক ও মন তখন গভীর আবেশে ডুবে গেছে। বাহ্যিক অনুভূতি ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে নেশার ছাউনির তলে।


ঠিক তখনই হল আবার শব্দটা। এবার বেশ স্পষ্ট ছিল সে তার অস্তিত্ব। সুবীরের মনে হচ্ছিল, কেমন যেন একটা কান্নার রোলের মতো গুমড়ানো আওয়াজ ধীরে ধীরে পাশের ঘর থেকে ঘুরিপাক খেয়ে আসতে লাগল এ ঘরে। এবার উঠে দাঁড়াল প্রতাপ। পাশাপাশি টোলে যাওয়া পাদুটোতে বল সঞ্চয় করে উঠে দাঁড়াল সুবীরও। রোহিতের এই রেন্ট রুমে এই প্রথমবার এসেছে ওরা। অফিসের কাজে বন্ধুদের দিল্লীতে আসার খবর শুনেই আন্তরিকভাবে রোহিতের রুমে আসতে বলেছিল দুই বাল্যবন্ধুকে। বলেছিল, অনেকদিন ঠিক সেইরকম ছোটোবেলার মতো নির্ভেজাল আনন্দ করিনি। তোরা আয়, সারা সন্ধ্যা আর রাত জুড়ে নেশায় চূড় হয়ে থাকবো আমরা। ইচ্ছেমতো ফূর্তি করবো। এখানে ডাক দেওয়ার মতো না থাকবে বাড়ির লোক, আর এই বাড়িতে না আছে অন্যকোনো ভাড়াটে। বাড়িয়ালাও অন্য বাড়িতে থাকে। পুরো স্বাধীনভাবে কাটাবি তোরা। মিউজিক চালিয়ে মস্তি করবি। তিনজনে মিলে আমরা ডুবে যাবো আনন্দের গভীরে। 

কর্মব্যস্ত জীবনের মধ্যে বাল্যবন্ধুর এরকম একটা প্রলোভনের হাতছানি সুবীর আর প্রতাপের মনের ইচ্ছাগুলোকে যেন একবাক্যে চনমনে করে তুলেছিল। তাই আজ ওখলার অফিসের কাজ সেরে সোজা রোহিতের গুরগাঁওয়ের রেন্টরুমে চলে এসেছিল দুই বন্ধু। আসার আগে ওদের মনে যে আনন্দটা ছিল, তা রোহিতের রুমে ঢুকে আরো কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। ওর ওয়ান বি এইচ কের সেটটা বেশ সুন্দর ছিমছাম করে সাজানো। দক্ষিণের দিকে রয়েছে একটা মাঝারি ব্যালকনি। তাতে দু -একটা পাতাবাহার গাছও লাগিয়েছে রোহিত। সবমিলিয়ে সুবীর আর প্রতাপ এই রুমসেটে এসে তৃপ্ত হয়ে ডুবে গেল বাল্যকালের বিভিন্ন গল্পে। তারপর সন্ধ্যের আঁধার ঘন হতেই রোহিত ফ্রিজ থেকে এক এক করে নেশার আয়োজন নামিয়ে সাজাতে শুরু করেছিল। বেশ একটা আমেজ এসে গিয়েছিল তিনজনের মধ্যে। রোহিত হাল্কা স্বরে গল্প করছিল, ওদের পাশের বাড়ির একটা লোকের দুদিন আগের সুইসাইডের কথা। সুবীর সেটা শুনতেই বাঁধা দিয়ে বলেছিল 'থাক না, আজকের এই আনন্দের দিনে আবার এসব প্রসঙ্গ তুলছিস কেন?'

প্রতাপ রোহিতের দিকে চোখ টিপে হেসে কৌতুক করে বলছিল তখন 'জানিসই তো সুবীরের আবার এসবে এলার্জি আছে। ছোটোবেলাতে তো ...'

সুবীর প্রতিবাদ করে থামিয়ে দিয়েছিল তখন প্রবীরকে। হয়তো কতকটা বিব্রতবোধ করেই। 


তারপর আবার দুজনে ডুবছিল নেশার ঘোরে। তবে রোহিত কিছুটা কম নেশা করেছিল। যতই হোক, ঘরে অতিথি এসেছে। ও টাল হয়ে পড়ে থাকলে এদের খাওয়ার দেবে কে? 

তারপর নেশার জোগাড় শেষ হয়ে গেলে, রোহিত বলল "কাছেই দোকান। দাঁড়া আমি দশ মিনিটে আরো কটা বোতল নিয়ে আসছি। তোরা ততক্ষণে বাকিটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নে।"

বন্ধুর কথাতে তখন সুবীর বা প্রতাপ কেউ প্রতিবাদ করেনি। ওদেরও মনে হচ্ছিল যেন আরো আরো নেশা করি। তাই তখন বাইরে থেকে দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে যায় রোহিত। 


কিন্তু রুমের মধ্যে হঠাৎ করে এরকম একটা পরিস্থিতি হতে পারে, সেটা স্বপ্নেও ভাবেনি সুবীর আর প্রতাপ। এরকম একটা অতিপ্রাকৃত আওয়াজ ওদের সাথে রুমে সহাবস্থান করতে পারে, এটা ওদের ভাবনার অতীত ছিল। ক্রমশ আওয়াজটার তীব্রতা ও ভয়াবহতা বাড়তে থাকল। সুবীরের পা বা মন, কোনোটাতেই জোর ছিল না গিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ব্যাপারটার সত্যতা বিচার করার। প্রতাপ তখন উপায়ন্তর না পেয়ে নিজে উদ্যোগী হয়। আর পাশের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। কিন্তু প্রতাপের পাশের ঘরে যাওয়ার সাথে সাথেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে যায়।আর আওয়াজটার উৎস খুঁজতে অপারক হয় নেশাগ্রস্থ প্রতাপ। এদিকে চারদিকটা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় রীতিমতো বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেলে সুবীর। সুবীরের এই ভূতে ভয় পাওয়ার পুরানো অসুখের কথা জানা ছিল প্রতাপের। ও পাশের ঘর থেকে দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে আসতে থাকে সুবীরের ঘরে। সুবীর কান্নাভেজা গলায় বলতে থাকে "কোথায় তোরা? প্রতাপ, রোহিত ... আমি একা আর পারছি না? প্লিজ, বাঁচা আমায় ..."


রোহিত তখন নিস্তব্ধে দাঁড়িয়ে সেই রুমের জানলার বাইরে। ওর মনে পড়ে যাচ্ছে প্রায় কুড়ি বছর আগের ঘটনার কথা। তখন ওরা সবে গ্রামের পলিস্তারা খসা বাড়ি থেকে কলকাতার ঝা চকচকে ফ্ল্যাটে এসে উঠেছিল। কিন্তু সুখের মাঝেই ঘটে গিয়েছিল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। রোহিতের দাদু ওদের দীঘা বেড়ানোর ট্যুরে গিয়ে ওর সামনেই সমুদ্রের অতলে তলিয়ে গিয়েছিলেন। আর তিনি ছিলেন রোহিতের খুব প্রিয় মানুষ। সেই ঘটনার পর থেকে রোহিতের মনে জল শব্দটাকে ঘিরে একটা আতঙ্ক দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। সেসময় রোহিত একবার ওর বাবার সাথে ওদের পুরানো গ্রামে গেলে, সুবীর আর প্রতাপ ওকে নিয়ে গিয়েছিল গ্রামের নদীর পাড়ে। যদিওবা তেমন গভীর ছিল না সে নদী। তবু সুবীর রোহিতকে ওর জলের প্রতি আতঙ্কের কথা জেনেশুনেই ঠেলে দিয়েছিল ওই নদীর বুকে। রোহিতের নতুন চকচকে জীবনযাত্রার কথা সম্ভবত সুবীরের শিশুমনে একটা চাপা ইর্ষার বীজ বপন করেছিল। সেদিনের কথা মনে করলে আজও আৎকে ওঠে রোহিত। ও কিভাবে ওই নদীর বুকে বসে পড়ে চিৎকার দিয়ে কাঁদছিল। আর ওর দুই বাল্যবন্ধু সুবীর আর প্রতাপ ওকে লক্ষ্য করে উল্লাসে জল ছোড়াছুড়ি করছিল। আর খেলার ছলে তারস্বরে মজা করে হাসছিল। বন্ধুর চোখের জল আর মনের আতংকের যেন কোনো মূল্যই ছিল না তখন ওদের কাছে। 


এতো বছর পরও রোহিত সেই ঘটনাকে ভোলে নি। শুধু সময়ের অপেক্ষায় ছিল। আজ রোহিতের কাছে যেচে ওর সেই বন্ধুরাই তুলে দিয়েছে সেই সময় আর সুযোগ। তাইতো দুদিন ধরে নিজের রেকর্ড প্লেয়ারটাকে রেডি করে রেখেছিল রোহিত। আর ফ্রিজে রেখেছিল দুই বন্ধুকে পর্যাপ্ত নেশায় ডুবিয়ে রাখার আয়োজন। বাইরের দরজাটাকে শুধু বেরোবার সময় হাল্কা করে ভেজিয়ে রেখেছিল রোহিত। যাতে পরে ইচ্ছামতো ঘরে ঢুকে রেকর্ড অন করে আবার বেরিয়ে যেতে পারে। 


বাইরে তখন রোহিতের কানে ভেসে আসছে সুবীরের পাগল করা অনুরোধ। ভয় থেকে নিজেকে বাঁচানোর কাকুতি।


(সমাপ্ত)


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy