জরিমানা
জরিমানা
তিতলি আমার জীবনের কোন দিন কোন মিল ছিলো না। ছোটবেলা থেকে ওর ঘুম ভাঙে পাখির শব্দ, ফুলের গন্ধ নাকে। আমার ঘুম ভাঙতো উনানের ধুঁয়া খেয়ে মায়ের না থামা কাশিতে। ও যখন পুতুল নিয়ে ব্যাস্ত থাকতো তখন আমি পুকুর থেকে শাপলা কলমি শাক তুলে বাজারে বেঁচেতাম। ওকে বেবি সিটার মানে আমার মা যখন ছড়া রাইম শোনাতো তখন আমার শুনতে হতো খিস্তি খেয়ুর।
ওর বাড়িতে হঠাৎই আমার জায়গা হলো কোন এক অজানা শর্তে। মা ধারণা ছিলো পড়াশোনা শিখতে পারলেই আমরা আমাদের অভিসপ্ত জীবন থেকে মুক্তি পাবো। কারণ মা একটু শিক্ষার মুখ দেখেছিলো। মা বললো , আমিও ইংরেজি স্কুলে পড়বো তিতলির সাথে। তবে বিনময়ে ওদের বাড়ির দুই একটা কাজ করে দিতে হবে। তিতলি সাথে আমার পার্থক্য আরো চোখে পরেছিলো তখন। পুতুল খেলার বয়স তখন নেই আমাদের।ওর ঘুম ভাঙতে চায় না, ঘড়ির এল্যামে কফির গন্ধেও। আর আমাকে কাক ডাকার আগে উঠে, ওদের সবার ব্রেকফাস্ট রেডি করা , গাড়ি ধোঁয়া বাজার করার কাজ করে দিতে হয়।
মাঝে মাঝে মনে হতো , তিতলি থেকে আমি সব সময় এক দুই নম্বর বেশি পাই, এই পার্থক্যটা কতো বেশি হতো যদি আমিও ওর মতো সুযোগ সুবিধা পেতাম। আমি ওকে ঘৃনা করতাম। কারণ ও সুযোগ পেলেও কোনোও কিছু শেখার জানার আগ্রহ দেখায় না। ওর সাথে আমার কোনদিন কোন মিল ছিলো না। তবে পরে দিকে একটু মিল পেতে শুরু করেছিলাম। সেটা হলো আমরা দুইজনেই খুব একা। যদিও আমার বাবা মায়ের অভাব ছিলো বলে, আমার ভবিষ্যৎ কথা ভেবে দূরত্ব তৈরি করেছে। আর ওর বাবা মা ওকে ওর সব চাহিদা মিটিয়ে দিলেও সময় দিতো না।
তাই ও কিশোর জীবনটাও বেশ অগোছালো অনিয়ম ভরা ছিলো ।
হঠাৎ করেই আমরা বড় হয়েও গেলাম। আমার কিশোর বয়সটা অতোটা বেপরোয়া ছিলো না। আমার মা জীবনের সাথে অনেক আপোষ করেছে আমার পড়াশোনার জন্য। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার টাকা পয়সা আমার নেই। তাই বিকালগুলো সেই চিন্তায় নষ্ট করতাম সন্তুদা গেরেজে । ওখানে গিয়ে একটু কাজ শিখতাম । ইঞ্জিনিয়ারিং সুযোগ পেলে যাতে কলেজ খরচটা ওর ওখানে কাজ করে তুলে নিতে পারি।
তিতলিকে আমি ঘৃণা করতাম প্রথম প্রথম কারণ আমাদের সামাজিক অবস্থান এর পার্থক্য। সেই দিনের ঘটনা আরো ওর প্রতি ঘৃণাটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো। কারণ মানুষের ভালোবাসা ভেঙে যায় তখন আরো ঘৃণার পরিমাণ বেড়ে যায় ।
ওরা বড়লোক হলেও ওদের পরিবারের মধ্যে কোন আত্মীয়তা ছিলো না। তিতলি সত্যি একা ছিলো।ওর প্রতি কিছু সহানুভূতি ওর প্রতি একটু দুর্বল করে দিয়েছিলো।ও আমার পড়াশোনার জন্য টুকটাক খরচ দিয়ে দিতো। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সুযোগ পাওয়ার পর। ও আমার কলেজ ভর্তি ফিস্ টাও দিয়ে দিয়েছিলো । ওর বাবা আমাকে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনা করানোর দায়িত্ব নিয়েছিল তাছাড়া, উনার থেকে সাহায্য আমি নিতেও চাইতাম না। যে শর্তে
উনি আমার পড়াশোনার খরচ দিতো সেটা আমার অপছন্দের ছিলো।
তিতলির সাতেরোতম জন্মদিন থেকে আমার মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই দিন ওর বাড়িতে কেউ ছিলো না। ওর বন্ধুবি উর্মি ও বিয়ার খেয়েছিল। আমাকে কিছু বাড়তি পয়সা দিয়ে A মার্ক ছবির সিডি এনে দেখেছিলো। উর্মি যাওয়া পর , ও আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। সেইদিনের ঘটনাটা বিচ্ছিন্ন দূর্ঘটনা বলে ধরে নিয়েছিলাম, কিন্তু এটা পরে নিয়মিত হয়ে যায়। আমি পড়ালেখা ভালো ছিলাম তাই আশির দশকের সিনেমার নায়কদের মতো স্বপ্ন দেখছিলাম যে তিতলি আমি ঘর বাঁধবো। সেই দিন ও আমার স্বপ্ন ভেংগে দিলো। আমার গোপন ক্ষতটাও খুঁচিয়ে দিয়ে জানালো। আমার মা যেমন ওর বাবার বিনোদনের সামগ্রী। আমি ও তেমনই ওর বিনোদনের সামগ্রী। কথা গুলো শুনে মাথা গরম হয়ে গেল। আমি ঠিক করলাম যাই হয়ে যাক ওদের নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে বেরিয়ে যেতেই হবে আমায়। নিজেকে ঠিক প্রতিষ্ঠিত করবো যে ভাবেই হোক।
আউট হাউসে যখন আমি সম্পূর্ণ তৈরি করে নিয়েছি ওদের বাড়ি থেকে চলে যাবার জন্য। তখন ওর ঘর থেকে চিৎকার শুনতে পেলাম। আমার নাম ধরে সাহায্য চাইছে ও। ওর চিৎকার অনুসরণ করে গিয়ে দেখি অদ্ভুত ব্যাপার ওর মামা বাবু মদপ অবস্থায় ওর শীলতা হানির চেষ্টা করছে। এই লোকটি আমার মাকেও কুনজরে দেখে। ঘৃণা করলেও তিতলির ওপর একটা দুর্বলতা আছে। তাই মাথা গরম হয়ে যাওয়ায় ওর মামা ততক্ষন পর্যন্ত মারতে থাকলাম যতক্ষণ না উনি জ্ঞান হারালো। থানা পুলিশ হলো।
লকআপে একটা রাত অর্ধেক দিন কাটানোর পর সন্ধ্যায় জামিন পেলাম । জামিন করালো তিতলি। ও জানালো ওর আমার সম্পর্কে র কথা ওর মামা জেনে গিয়েছিলো। তাই আমাকে ও ওভাবে অপমান করেছে। আমি রাগ করে দেখে জরিমানা হিসেবে ও একটু আদর করলো ও। কিন্তু ক্ষতটা যে কত গভীর আর পুরনো ওটা ও বুঝতে পারলো না।ওই টুকু জরিমানা তে কিছু হবে না। আমি প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলতে থাকলাম ভিতরে ভিতরে।