জীবনযাপনপর্ব- দশ
জীবনযাপনপর্ব- দশ
সুজিতের সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বাড়িতে ঢুকে উঠোনের তুলসীমঞ্চে প্রদীপ দেওয়া দেখে সাইকেলটা কোনো মতে ছুটে গেল ঘরের দিকে।
ঘরের চারিদিক দেখে নিয়ে সুজিত বললো "কি রে অয়ন তোর মা কই?"
সমস্বরে "মা..." বলে তিনজনের বাবার দিকে তাকালো।
সুজিত তারদিকে ছেলে মেয়েদের এমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে, বিরক্ত হয়ে বললো " ওমন করে তাকিয়ে আছিস কেন তোরা? যা জানতে চাইছি তার উত্তর দে না।"
নয়ন বাবাকে তুলনামূলক ভাবে কম ভয় পেতো, তাছাড়া সে আজ অসুস্থ, তাই চয়ন বোনকে খোঁচা দিয়ে ঈশারা করে জিজ্ঞেস করতে বললো।
নয়ন দাদার কথায় বাবাকে বললো "বাবা তুমি তো মাকে খুঁজতে গিয়েছিলে, আমরা জানবো কি করে? "
সুজিত অধৈর্য্য হয়ে মেয়েকে ধমকে উঠলো। " আমার সাথে ইয়ার্কি করা হচ্ছে?"
নয়ন এই বাবাকে ঠিক চিনতে পারলো না। ভয়ে দাদাদের জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল সে।
মেয়েকে কাঁদতে দেখে সম্বিত ফিরে পেলো, মনে মনে বললো " কি করছিস সুজিত? শান্ত হ।"
তারপর কাষ্ঠ হেসে ছেলে মেয়েদের দিকে এগিয়ে যেতে দেখেই ছেলেমেয়েরা কেমন যেন ভয় পেয়ে গেল।
সুজিত ছেলেমেয়েদের ওকে ভয় পেতে দেখে মনে কেমন একটা ধাক্কা পেলো, সেখানেই ধপ করে বসে মুখে হাত দিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
প্রথমে নয়ন এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো,তারপর দুইভাই পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে বাবা এসে জড়িয়ে ধরলো। সুজিত দুইহাতে ছেলেমেয়েদের জড়িয়ে ধরলো। আজ ওই কথাটার মানে বুঝতে পারছে "দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম কেউ বোঝেনা। তেমনি ও বোঝেনি আরতি কি ছিল ওর কাছে আর এই সংসারের কাছে।"
কিছুটা শান্ত হয়ে বললো "তুলসীমঞ্চে কে প্রদীপ দিয়েছে? "
তিনভাইবোন উঠে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললো "আমরা। "
" তোরা?"
" হ্যাঁ বাবা, বকোনা আমাদের। মা তুলসী তলায় প্রতিদিন প্রদীপ দিতো, মাঝে মাঝে না দিতে পারলে কাকিমাকে ডেকে এনে দেওয়াতো। মা বলতো সন্ধ্যার সময় সন্ধ্যা প্রদীপ বাড়িতে না দেওয়া বাড়ির জন্য অকল্যাণের। তাই.."
সুজিতের চোখ আবার জলে ভরে এলো। ছেলেমেয়েদের আবার বুকে টেনে নিয়ে বললো "কত্তো বড় হয়ে গিয়েছে আমার ছেলেমেয়েরা। "
তারপর চোখ মুছে সাইকেল থেকে টিফিনবাক্সগুলো এনে ছেলেমেয়েদের খেতে দিলো।
ওরা এতো খাবার দেখে খুব খুশি হলো, ওদের বড্ড খিদে পেয়েছিল। ওরা চারটি থালা এনে খাবারগুলো সাজিয়ে, একটা থালা সুজিতকে এগিয়ে দিতেই, সুজিতের আবার কান্না পেয়ে গেল, সত্যি কি ভালো শিক্ষা দিয়েছে আরতি ছেলেমেয়েদের। সবাইকে সমান ভাগ করে খাবারগুলো দিলো। খাবারগুলো খেতে খেতে খুব কষ্ট হলো সুজিতের, মনে হলো তাকে তো ছেলেমেয়েদের দিয়ে গেলো আরতি, নিজে খালি হাতে চলে গেল। কোথায় আছে কেমন আছে কেন জানে?
হঠাৎ ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ পড়লো, ওরা একে অপরকে খাইয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে কেমন একটা বল পেলো সুজিত। তার মনে হলো " না আমার ছেলেমেয়েরা কখনোই একা হবে না,থাক তোরা এমনই থাক।ঈশ্বর ওদের মাঝে এই ভালোবাসাটা সারাজীবন রেখো।"
সেইদিন কেটে গেল কোনো মতে। সুজিত ভেবে পেলোনা কি করবে। পরের দিন সকালে সুজিত উনুন জ্বালানোর জন্য কসরত করছে, এমন সময় বাইরে ওর নাম ধরে ডাক শুনে বাইরে এসে দেখে ওর দাদা অজিত দাঁড়িয়ে।
" দাদা তুমি? এসো এসো বসো। "
" হ্যাঁ আমি, কাল তুই গিয়েছিলি, দেখা হয়নি,আমি তখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।আগেরদিন রাত জাগতে হয়েছে তো তাই।"
" তাতে কি হয়েছে? "
"তা তুই কি করছিলি রান্নাঘরে ?"
" ও তেমন কিছু না।"
" তা আমার বৌমা ওরফে আমার শ্যালিকাটি কই?"
সুজিত মাথা নিচু করে নেয়।
অজিতের বিষয়টি ভালো ঠেকেনা। কারণ আরতির সাথে সুজিতের বিয়ের পরে ও যতবার এই বাড়িতে এসেছে, বাড়িতে একটা লক্ষ্মীশ্রী বিরাজ করতো। আজ ঢুকেই কেমন ছন্নছাড়া ভাব।
" আহ্ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? উত্তর দে? বৌমা কি অসুস্থ? "
নয়নের আজ জ্বরটা সামান্য বেড়েছে, তাই ও পড়তে যায়নি৷ শুয়েছিল। বড়বাবুর গলা শুনে ছুটে বাইরে এসে বলে "বড়বাবু, তুমি কখন এলে? বম্মা আসেনি? দাদারা আসেনি।"
অজিত নয়নের গলা শুনে দুইহাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায়। উনার কোনো মেয়ে না থাকার জন্য নয়নকে খুব ভালোবাসেন তিনি।
নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলেন "আমার মাটাকে কতদিন দেখিনি। মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেন মা?"
বলে কোলে তুলে নেয়।
কোলে তুলে নিতে নিতেই বেশ খানিকটা চমকে উঠে বলেন "সুজিত আমার মায়ের গা গরম দেখছি, জ্বর এসেছে বুঝি? কবে এলো আমাকে তো জানাসনি। "
সুজিত আগের মতো চুপ করেই রয়।
" দেখ আমি আগেই বলেছি, কাজের জন্য দূরে চলে গিয়েছি মানে পর হয়ে যায়নি, হ্যাঁ কাজের চাপে এখন আগের মতো আসতে পারিনা মানলাম। তা বলে জানাবি আমায় কিছু।"
বাবাকে কিছু বললেই নয়নের খুব কষ্ট হয়, সে তার বড়বাবুকে বললো "ও বড়বাবু, বাবাকে বকছো কেন?"
" না মা বাবাকে বকবো কেন? বাবাকে আমি বকতে পারি? যাও মা ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো, আর মাকে বলো আমি এসেছি। "
" মা? মা তো নেই বড়বাবু, বাবা তো তাই কাল খুঁজতে গিয়েছিল।"
" নেই মানে?"
অজিত কিছুই বুঝতে পারে না। নয়নকে ঘরে শুতে পাঠিয়ে ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে "বল তো কি হয়েছে? কোথায় গিয়েছে আরতি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা।"
সুজিত হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলে "দাদা আমি কিছুই জানিনা। চারদিন হয়ে গেল কোথায় গিয়েছে কিচ্ছুটি জানিনা। তবে সব দোষই আমার,আমার জন্য সবটা হয়েছে। এদিকে যে খোঁজ নিতে যাব সেটাও পারছিনা, মেয়েটার জ্বর কয়েকদিন থেকে।"
অজিত কি করবে বা কি বলবে বুঝতে পারলো না। শুধু মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে বললেন " চার-চারটাদিন হয়ে গিয়েছে, তুই আমাদের কিছুই জানাসনি। মেয়েটা কোথায় আছে কেমন আছে কে জানে?"
তারপর কি ভেবে নিয়ে বললো "যা গিয়ে কাপড় গুছিয়ে নে। আর বাচ্চাদের কাপড়ও গুছিয়ে দে। ওরা এই কয়দিন আমার কাছে থাকবে, আর তুই বৌমা খুঁজতে যাবি। গোরুগুলো গিয়ে কাকার বাড়ি দিয়ে আয়,আর বলিস তুই কাজে যাচ্ছিস। তোর আসতে দেরি হতে পারে। আর এই কয়দিন বাড়ির দিকে নজর রাখতে, দরকার বুঝলে রাতে এসে যেন থাকে। "
সুজিত দাদাকে দেখেই বুকে বল পায় সে।চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে গোরু দুটোকে নিয়ে কাকার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।
এমন সময় অয়ন চয়ন টিউশন থেকে ফিরে আসে, বড়বাবুকে দেখে ওরা আনন্দে এগিয়ে আসে।
দুইজনেই প্রায় একসাথে বলে উঠে "বড়বাবু কখন এলে?"
" এসেছি অনেকক্ষণ হলো, চলচল তৈরী হয়ে নে। তোদের সাথে করে নিয়ে যাব।"
অয়ন হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো।
" কি রে দাঁড়িয়ে পড়লি যে?"
" বড়বাবু আমি যাব না।"
" কেন রে?"
অয়ন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলে " তুমি জানো না, মা..."
" আমি জানি সব, সেজন্য নিয়ে যেতে চাইছি। তোর বাবা তোদের জন্য তোর মাকে খুঁজতে যেতে পারছেনা যে।"
তারপর কিছুটা উজ্জ্বল হলো অয়নের মুখখানা, সে উৎসাহিত হয়ে বললো "বাবা মাকে খুঁজতে যাবে? "
" হ্যাঁ রে.. "
" কিন্তু বাড়ি ফাঁকা করে কি যাওয়া ঠিক হবে? মা যদি একাই ফিরে আসে। আমি বরং থাকি। তুমি ভাই বোনকে নিয়ে যাও।"
অজিতের মতো পাক্কা ব্যবসায়ীরো চোখদুটো চিকচিক করে উঠলো। কি বলবে বুঝতে পারলো না। গলাটাও আর্দ্র হয়ে গিয়েছিল। নিজের গলাটা পরিস্কার করে বললো "তোকে একা ছেড়ে তোর ভাই-বোন বা তোর বাবা যেতে রাজি হবে? আর কাকার বাড়িতে বলে আসা হচ্ছে। তোর মা আসলেই খবর পাবো। এই তো এতোটুকু পথ।"
অয়ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হলো।
অজিত চোখে জল চলে এসেছিল, সেটা কোনোমতে মুছে বললেন "যা বাবা সব গুছিয়ে নে।তুই না বড়, ভাইবোনের সবকিছু গুছিয়ে দে। যত দেরি করবি, দেরি হবে বাবা।"
অয়ন ঘরে চলে গেল।
এখন সকাল দশটা বেজে গিয়েছে, কিন্তু শীতের জন্য সেটা মনে হচ্ছে না। একটা হালকা মিঠে রোদ উঠেছে। অজিত ঘরের দাওয়ায় উদাস মনে বসে রইলেন। কত কষ্টে আবার ভাইটাকে সংসারী করতে পেরেছিলেন তারা। বাড়িতেও শ্রী ফিরে এসেছিল। আবারও কি থেকে কি হয়ে গেল কে জানে? মেয়েটা কোথায় আর কি পরিস্থিতিতে আছে কে বলবে? অজিত সম্পূর্ণ বাড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
চলবে..
বিঃদ্রঃ গল্পটা কেমন লাগছে মন্তব্যে অবশ্যই জানাবেন, আপনাদের প্রতিটি মন্তব্য আমাকে উৎসাহিত করে।।
