STORYMIRROR

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Tragedy

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Tragedy

জীবনযাপন (পর্ব তিন)

জীবনযাপন (পর্ব তিন)

6 mins
342

সুজিত ক্ষীপ্রতার সাথে স্ত্রীর কাছে ছুটে গেল। অয়ন মায়ের অবস্থা দেখে কেঁদে উঠেছে। সুজিত স্ত্রীর মাথা কোলে নিয়ে ছেলেকে নির্দেশ দিলো ছুটে জল নিয়ে আসার জন্য। স্ত্রীকে এমন করে জ্ঞান হারাতে কোনো দিনও দেখেনি। অয়ন জলের ঘটিটা নিয়ে আসতেই সুজিত স্ত্রীর চোখে মুখে জল ছিটিয়ে দিতেই থাকে। তারপর সুজিতের মা যেমনটি করতেন, তেমনি করে মাথায় অল্প অল্প করে জল ঢালতে শুরু করলে ধীরে ধীরে চোখ মেলে আরতি। সুজিত তা দেখে আশেপাশে কে আছে, তা সব ভুলে স্ত্রীকে বুকে টেনে নিয়ে শিশুর মতো কেঁদে ফেলে। আজ সুজিত বড় ভয় পেয়ে গিয়েছিল, আরতিকে হারিয়ে ফেলার ভয়। এই হারানোর কষ্ট সুজিত আগেও সহ্য করেছে। মিনতি চলে যাওয়ার পরে, ওর জীবনটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আরতি ওর জীবনে আসার পরে সবটা সামলে নেয় শুধু তা নয়। জীবনটাকে সাজিয়ে দেয়,শ্রী ফিরে আসে সমগ্র গৃহে।

আরতি ধীর গলায় বলে "কিছু হয়নি আমার, আমি ভালো আছি।" অয়ন তখন ভীত মুখে দূরে দাঁড়িয়েছিল। আরতি কাছে ডাকতেই মায়ের কাছে ছুটে এসে, মায়ের হাত ধরে কেঁদে ফেলে। আরতি হেসে বলে " আরে বোকা ছেলে আমার, কিছু হয়নি।"

সুজিত এবার বলে " হবে না এমন, সকাল থেকে নিশ্চয় কিচ্ছুটি দাঁতে কাটোনি। চলো কিছু মুখে দেবে।"

আরতি ধীরে ধীরে উঠে বসে, ছেলে মায়ের কাছে এসে আঁচলে মুখ গুঁজে বলে "আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম মা।"

আরতি ছেলের কপালে স্নেহ-চুম্বন এঁকে বললো "আমি কোথায় যাব তোদের ছেড়ে, তোদের ছাড়া কেউ আছে আমার?" কিন্তু মনের ভিতর সেই ভয়টা অনুভব করলো।

ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে গিয়ে অনুভব করলো, সামান্য গরম গরম ঠেকছে। তখন সে নিজের কথা ভুলে গিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল " অয়নের গা যে এখনো গরম। বলি ডাক্তার কি বললেন? কবে ভালো হয়ে যাবে আমার ছেলেটা?"

সুজিত বললো "ডাক্তার বললেন ভয়ের কিছু না, আবহাওয়ার পরিবর্তন হয়েছে, তাই হয়েছে। ইনফুয়েণজা বললো। "

আরতি সামান্য চিন্তা করে বললো "ইনফ্লুয়েঞ্জা, ও আচ্ছা। যা বাবা হাত-মুখে জল দিয়ে এসে বিশ্রাম নে। এতোটা পথ এলি। আমি খাবার নিয়ে যাচ্ছি।"

অয়ন গোমড়া মুখে বললো " আমি দুধ সাবু খাবো না" তারপর আবদারের সুরে বললো " ভাত খাবো মা।"

" না বাবা ভাত তো চলবে না বাবা, ঠিক আছে আমি রুটি করছি, তুই আর আমি খাবো।"

অয়নের রুটি তেমন ভালোলাগে না, কিন্তু মা যে ভাত দেবেনা তা বুঝতে পেরে মুখ কালো করে চলে গেল।

" আরতি তুমি পাগল হলে? ছেলের সাথে এখন তুমিও রুটি খাবে? তোমার শরীরটা ভালো না। ভাত পেটে না পড়লে.."

"আরে আমার কিছু হয়নি, ছেলেটা ভাত খেতে কত্তো ভালোবাসে। ও খাবে না, আমি মা হয়ে খেতে পারি? তা কি হয় বলো?"

" যা ভালো বোঝো, তুমি কি ছেলের বিষয় আমার কথা শুনবে?"

" না শুনবো না তো, অয়ন আমার ছেলে। ওর ভালো মন্দ আমার চেয়ে ভালো কেউ বুঝবে না। আর ওর জন্য এতটুকু ত্যাগ করতে পারবো না তো কিসের মা আমি?"

সুজিত মৃদু হেসে বলল "শুধু কি এই ত্যাগ, ছেলের জন্য জীবনে কি কি ত্যাগ করতে পারো, তা আমার চেয়ে ভালো কে জানে।"

আরতি স্বামীর চোখের ভাষা পড়তে পেরে কপট রেগে বললো " কি গো তুমি? এখনো ভুললে না পুরোনো কথা।"

সুজিত নৈরাশ্যের ভাব করে বললো " কি করে ভুলি বলো, আমাদের জীবনের ওই দিনটা.."

এবারে আরতি লজ্জা পেয়ে,তাড়াতাড়ি করে কথাটা ডেকে বললো, " উঠো তো উঠো, কি ওষুধ এনেছ আমাকে দাও। ছেলেকে দিতে হবে। "

সুজিত ব্যাজার মুখে বললো " হ্যাঁ দিচ্ছি, আসার সময় অল্প মাছ নিয়ে এসেছি। বেশী কিছু করতে হবে না। ভেজে দাও।"

"তোমাকে সেসব নিয়ে ভাবতে হবে না, যাও তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আসো।"

বিল্টুর কথা সবাই ভুলেই গেছিলো, বিল্টু আরতিকে জ্ঞান হারাতে দেখে দূরের দাওয়ায় গিয়ে বসে বসে সব দেখছিল। আর মনে মনে ততই ফুঁসছিলো। ভেবেছিল স্বামীর থেকে দূরে করবে, কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছে না।

সুজিত পেছন ঘুরতেই বিল্টুকে বসে থাকতে দেখলো। আরতিরও চোখ এড়ালো না, সে সোজা ঘরে ঢুকে গেল কাপড় বদলাতে।

সুজিতকে বিল্টুর দিকে এগিয়ে দেখে বিল্টু কেমন একটা মুখ করে বললো "আরতিকে আমি যখন দেখেছিলাম, তখন বেশ সুস্থ ছিল। কি আপনি যত্ন নেন না নাকি?"

সুজিত কথাটায় বেশ অপমানিত বোধ করলেও তেমন কিছু মুখে না বলে বললো " আমি কি যত্ন নেবো, সারাদিন সংসার সংসার করে। আপনি চলুন স্নান সেরে কিছু মুখে দিন।আরতির আত্মীয় বলে কথা। তার উপর প্রথমবার বাড়ি এলেন, আবার কবে আসবেন ঠিক নেই।"

" আসবো না কেন আসবো, আগে তো আর এখানে ছিলাম না, তাই আসা হয়নি।"

সুজিত আর কথা না বাড়িয়ে স্নামঘর দেখিয়ে দিলো বিল্টুকে। নিজে দুই বালতি জল চৌবাচ্চায় দিয়ে এলো। সে প্রতিদিনের মতো কল থেকে জল নিয়ে বালতি দিয়ে জল ঢেলে নিলো। বেলা অনেক হয়েছে, তাই বেশি সময় নিলো না। স্নান সেরে প্রতিদিন গুরুমন্ত্র জপে। আজ সেটা সেরে সোজা রান্না ঘরে গিয়ে দেখে মাছের ঝোল চাপিয়ে দিয়েছে এর মধ্যেই। স্বামীকে আসতে দেখে বললো "বাড়িতে একটা মানুষ খাবে, অন্য দিন তো অনেক কিছু থাকে। আজ তো মাছের ঝোল আর আলু সেদ্ধ। "

সুজিত বললো "তোমার পরিচিত না আত্মীয়, তুমি জানো কি খাওয়াবে।"

কথাটা সাধারণ, হলেও কথা বলার ধরণটা মোটেও সাধারণ নয়। আরতির বড় চেনা। আরতি অনেক বছর পরে এই ভাবে কথা বলতে দেখল সুজিতকে। বিয়ের পরে শ্বাশুড়ি যখন ওকে পছন্দ করতেন না, উনার কোনো কথায় প্রভাবিত হয়ে এমন কথা বলতে দেখেছিলো সুজিত।

সে হেসে বললো "মিত্র কি শত্রু তুমি জানলে কি করে? "

সুজিত চুপ করে বসে রইলো।

" আমি হলে আজ কোনো মতেই খেতে বলতাম না। আমার ছেলে অসুস্থ, মাথার ঠিক নেই আমার। বাড়িতেও রান্না হচ্ছে কই দিন দুই থেকে। তুমি নিজে মুখে বললে, আমি কি আমার স্বামীর কথার মান না রেখে পারি?"

সুজিতের মুখ এবারে কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ঠিকই তো সে তো বিল্টুর সাথে তেমন কথা বলতে দেখেনি বা বিল্টুকে খেতে বলেনি। সেই যেচে বলেছিলো।

এবারে হেসে বলল "একটু ডাল করলে পারতে।"

"এখন করার সময় হবে না, আমার রোগা ছেলেটাও না খেয়ে আছে কতক্ষণ থেকে। "

" তবে তোমার হাতের চালের পাপড় ভেজে দাও আর আচার দিও সাথে। "

" সে আচার তুমি নিয়ে এসো মায়ের ঘর থেকে, তবে তুমি পাবে না বলে দিলাম।"

" একটু খাব।"

" না, বেলা অনেক হয়েছে। "

"আচ্ছা" বলে নিরাশ মুখে সুজিত বাটি হাতে চলে গেল। আরতি স্বামীর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে হেসে ফেললো।

রুটির আটা আগেই মেখে রেখেছিলো আরতি। ওদের দুইজনের ভাত বেড়ে দিয়ে দ্রুত হাতে রুটি করে নিলো নিরামিষ উনুনে। এই উনুন তেমন ব্যবহার হয়না আজকাল। শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকতে এতেই নিরামিষ পদগুলো হতো।

সামনে একটা পাত্রে ভাত ও মাছের ঝোল দিয়ে এসে সুজিতকে বলেছে অতিথির খেয়াল রাখতে। ছেলে অভুক্ত এই জন্য সুজিত বিষয়টা নিয়ে ভাবেনি। অয়ন ঘুমিয়ে পড়েছে, খাবারের থালাটা একটা টুলের উপর রেখে ছেলেকে আদর করে উঠালো আরতি। রুটি দেখে কিছুতেই খাবে না। আরতি অনেক কষ্টে রাজি করালো, বিশেষত আরতি নিজেও কিছু খায়নি শুনে অয়ন অনিচ্ছা সত্ত্বেও খেতে শুরু করলো। এখন সে বছর চৌদ্দর ছেলে। তবুও মায়ের কোলে বসে এখনো খায় মাঝে মাঝে সুযোগ পেলে। ছেলেকে গল্প শুনিয়ে খান দুই রুটি আর দুটো মাছের টুকরোর প্রায় সবটাই খাইয়ে দিলো। বাকি তিনটে রুটি মাছের ঝোল দিয়ে খেয়ে নিলো। সুজিত লক্ষ্য করেছে আরতি নিজের জন্য ভাবেনা। তাই অনেক সময় নিজের পাতে মাছ কিংবা মাংসের টুকরো রেখে দেয়, সুযোগ বুঝে স্ত্রীর পাতে তুলে দেয়।

খাওয়া শেষে বাইরে এসে দেখে বাড়িতে কেউ নেই, মনে মনে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে এঁটো থালাগুলো ও জায়গাগুলো পরিস্কারে মন দেয়। তবে যতই বাইরে দেখায় সে ঠিক আছে, কিন্তু ভেতরটা উথাল-পাতাল করতে থাকে। আজকে যা ঘটতে যাচ্ছিল, যদি ঠিক সময় সুজিত না আসতো কে জানে? সে আর ভাবতে পারে না। মনটাকে শক্ত করে কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে।


চলবে...



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy