জীবনযাপন (পর্ব -পাঁচ)
জীবনযাপন (পর্ব -পাঁচ)
সেদিন রাতে বিল্টু ফিরলো সুজিতের সাথে। সুজিত রাত সাড়ে আটটা-নয়টা পর্যন্ত দোকান খুলে রাখে। সবাই এসে আড্ডা মারে ওর দোকানের সামনে। আরতির কথা মতো চায়ের ব্যবস্থা রেখেছে। তারপর থেকে ভালোই হয়েছে, অন্তত বিশ-ত্রিশ ভাড় চা বিক্রি হয়ে যায়। কেউ কেউ ধারে খেলেও, দুই একজন বাদে সবাই মিটিয়ে দেয় টাকা। আর সুজিত বাড়ির খাটি দুধের চা করে, তাই বেশ চাহিদাও রয়েছে। ওদের গ্রাম বেশ বড়। মুদি বলতে গেলে ওর আর আরেকজনের রয়েছে। তবে মুদির দোকান হিসেবে ছোটই সুজিতের দোকান। তবে বেশি লাভে জিনিস বিক্রি করেনা, তাই বিক্রিও ভালোই হয় আর চা বিক্রির সুবাদে রাত পর্যন্ত খোলা থাকায় রাতে বিক্রি-বাট্টাও মন্দ হয়না, দিনমানের চেয়ে রাতেই বিক্রি ভালো হয়। বিল্টু তারসাথে দোকানে ছিল, রাতে ফিরে এলো সুজিতের সাথে। বিল্টুকে দেখে মাথাটা দুলে উঠল যেন।
সুজিত এগিয়ে এসে বললো "আজকে বিল্টু এখানেই থাকবে, পাশের ঘরখানা আমি পরিস্কার করে দিচ্ছি। ও যে পাওয়া মেটাতে এসেছে, সে এখনো মেটেনি তো।"
আরতির শরীরটা শিরশির করে উঠলো,কিছু না বলে চলে গেল সেখান থেকে।তার স্বামীর এটাই ঝামেলা হিতাহিতজ্ঞান নেই। একটা মানুষকে হঠাত করে থাকতে বলে দিলো,আরতি রান্না ঘরে গিয়ে রান্নায় মন দিলো। সে চায়না সামনে যেতে, তাহলে ওর উৎকন্ঠা সুজিতের চোখ এড়িয়ে যাবেনা। তাছাড়া খাবার খেতে দিতে হবে, সময়ও তো হয়ে গিয়েছে। নয়ন আর চয়ন ঘুমিয়ে পড়েছে, সারাদিন তো ছুটে বেড়ায়।তাই মাস্টারের কাছে পড়ে এসে আর পারে না জেগে থাকতে।আরতিকে প্রতিদিন ওদের জাগিয়ে খাইয়ে দিতে হয়। আর বাবা না ফিরলেও খাবে না একজনও আর সুজিতও ঘুমন্ত ছেলে-মেয়েদের খাওয়াতে পারেনা।সেই কাজটা আরতিকেই করতে হয়। রাতে সাধারণত তেমন কিছু রান্না করে না, খুব জোর একটা তরকারির। দুপুরের মাছ থাকলে সেটার ঝোল করে নেয় আর মাংস থাকলে গরম করে নেয়।আজ দুপুরের যে কটা মাছ ভাজা রয়ে গিয়েছে সেটা দিয়ে ঝোল করে নেবে ভেবেছিলো। এখন মুস্কিলে পড়ে গেল। সর্বসাকুল্যে পাঁচ টুকরো মাছ রয়েছে। আরতি চুপ করে ভাবতে বসলো কি করবে? মাঝে মাঝে ভয় হয়,সে চলে গেলে সংসারটা ভেসে যাবে। কিন্তু ওর মনটা কু ডাকছে , তাছাড়া স্বয়ং শয়তান তো এসে হাজির। আরতি হাজার বিপদেও কাঁদে না, কিন্তু ওর খুব কান্না পেলো। কান্নায় বুক ফেঁটে যেতে লাগলো। সে নিজেকে সামলে মাছের ঝোলটা বসিয়ে দিলো। তার আগে দুটো মাছের টুকরো অর্দ্ধেক করে নিলো। দুপুরে ছেলেকে খাওয়ানোর সময় কাটাকুটি গুলোই খেয়েছে। আরতির এমনই হয় অনেক দিন। তবে সবসময় না,কারণ তারা রাতের খাবার একসাথে খায় বেশির ভাগ দিন।আর সুজিত যদি দেখে স্ত্রীর পাতে মাছ নেই, নিজের থেকে ভেঙে জোর করে দেয়।না বললেও শোনেনা।
আরতি ডাল করেই রেখেছিল, খালি ফোরণ দেওয়া বাকি। আরতি ডাল ফোরণে বসিয়ে চুপ করে বাইরের দিকে চেয়ে রয়। ওর অজান্তে বিভৎস স্মৃতিগুলো স্মৃতিপটে ভেসে উঠতে থাকে। কখন যে সুজিত পাশে এসে বসেছে সে বুঝতেই পারেনি। আরতির গায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠে "কে কে?"
" আরে আমি, কি এতো ভাবছো?"
আরতি স্বামীকে দেখে সজল চোখ মুছে নিয়ে বলে "কই কিছু ভাবছি না।" বলে ডাল নামিয়ে দিয়ে কড়াইটা পরিস্কার করে চাপিয়ে দেয়।
সুজিত স্ত্রীকে হাত ধরে থামিয়ে বলে "তোমাকে সকাল থেকে অন্য রকম লাগছে? কি হয়েছে আমায় বলো না।"
"আহ্ কি হতে যাবে? কিছু হয়নি। যাও তো এখান থেকে, কাজ সারতে দাও। "
সুজিত তবুও বললো "বলো না?"
" বলছি তো কিছু হয়নি, যাবে এখান থেকে। " শেষ কথাটা বেশ জোরের বলে উঠে। সুজিত রাগ করে সেখান থেকে উঠে চলে যায়।
আরতির মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। স্বামীকে সে অসম্ভব ভালোবাসে, সে জানে সুজিত ভালো মনেই জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। কিন্তু আজ ওর সবকিছুতেই বিষ মিশিয়ে দিয়েছে বিল্টুর উপস্থিতি।
সে তাড়াতাড়ি করে পটল ভেজে, ঢাকা দিয়ে, ঘরের দিকে পা বাড়ালো। অয়নকে ওষুধ দেওয়া হয়নি, আর চয়ন,নয়নকেও উঠাতে হবে।
বাইরে এসে দেখে অয়ন,চয়ন বসে রয়েছে বিল্টুর কাছে আর নয়ন রয়েছে কোলে। আরতির সকাল থেকে নিজেকে সংযত করে রেখেছে, এখন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না। ছুটে গিয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বল্লো "কি হচ্ছে এখানে, কি করার চেষ্টা করছো। বেশি বাড়াবাড়ি করো না, আমি এখন আরতি না। আমি মা, মায়ের শক্তির কাছে সবাই হারতে বাধ্য। সেই ভুলটা করো না।" বলে ফুঁসতে লাগলো। সুজিত স্ত্রীর এমন রণমুর্তি কোনো দিনও দেখেনি। সে ছুটে গেল, সামান্য রাগ করে ছিল বটে। কিন্তু স্ত্রীকে দেখে সব কোথায় হারিয়ে গেল।
স্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে বললো "কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন?"
মেয়েকে স্বামীর কোলে দিয়ে বললো "যাও মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাও আর অয়ন চয়নও ঘরে যাও। "
সুজিত বুঝতে পারলো না কি ঘটছে, তাও স্ত্রীর কথা শুনে ছেলে মেয়েদের ঘরে রেখে এলো। নয়নও খুব ঘাবড়ে গিয়েছে মায়ের এমন রূপ দেখে। অন্য সময় হলে বায়না করতো, কিন্তু আজ সে সাহস পেলো না।
আরতি তখন চিৎকার করে বলছে "কি করছিলে আমার মেয়ের সাথে? আমি ছেড়ে দেবনা তোমায়, আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করতে আসলে।"
সুজিত এবার স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এসে স্ত্রীর কাঁধে হাত দিয়ে বললো "কি সব বলছো তুমি? উনি ওদের গল্প শোনাচ্ছিলেন। আমি তো পাশেই ছিলাম,তুমি তো এমন ব্যবহার করো না। আজ কি হলো? আমাকে বলো, এমন অস্থির হয়ে আছো কেন?"
আরতি কিছু বলতে পারলো না, স্বামীকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো। তারপর সুজিত অনুভব করলো আরতি আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
সুজিত আরতিকে ঝাঁকুনি দিতে লাগলো চোখ খোলার জন্য। জোরে জোরে অয়নের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। ছেলে মেয়েরা প্রথমে মায়ের কথা ভেবে চুপ থাকলেও, বাবার গলা শুনে বাইরে বেড়িয়ে মাকে ওমন করে পড়ে থাকতে দেখে জল এনে দিলো। চোখের জল দিয়েও জ্ঞান ফিরছে না দেখে আরতিকে সুজিত ঘরে এনে শুইয়ে দিলো, ছেলে-মেয়েরাও মাকে ঘিরে বসে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণ পরে আরতির জ্ঞান ফিরল। আজ দুইবার এমন হয়েছে, সুজিত বড় ঘাবড়ে গিয়ে স্ত্রীর পাশে থেকে নড়তেই চাইলো না।
আরতি চোখ মেলে প্রথমে যেন কিছুই মনে করতে পারলো না,ছেলে-মেয়ে সবাই উৎকন্ঠিত চোখে তার মুখের দিকেই চেয়ে। নয়নের দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়ে গেল কি কি ঘটেছিল আজ। লজ্জায় কেমন যেন সংঙ্কুচিত হয়ে গেল সে। মনে মনে বললো "কি ঘটিয়ে ফেললো, সুজিত নিশ্চয়ই কিছু একটা সন্দেহ করেছে। "
আরতি ধীর কন্ঠে বললো " কয়টা বাজে গো?"
সুজিত স্ত্রীর গলা শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসে বলল "তোমার জ্ঞান ফিরেছে? আমি তো ভয় পেয়েই গিয়েছিলাম।"
আরতি কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো "আমার কি হয়েছিল? "
" মা তুমি.... " নয়ন বলতে যাচ্ছিল, সুজিত মেয়েকে থামিয়ে বললো "এই নিয়ে দুইবার জ্ঞান হারিয়ে ফেললে, তোমাকে কাল ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাব। কি হচ্ছে কে জানে? তোমাকে আমাকে ফাঁকি দিতে দেবো না বলে দিলাম।"
আরতি ম্লান হেসে বলল " এখন এই কথা বলছো ঠিকই, এমন একদিন আসবে হয়তো আমার সাথেই থাকতে চাইবে না।"
" কি যে বলো তুমি? কখনোই ওমন হবে না।"
" ওটা কি বলা যায় বলো, কি আছে কপালে বলা তো যায়না।"
বিল্টু বাইরে দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিলো, নিজেও ঘাবড়ে গিয়েছিল সে আরতির ওমন রূপ দেখে। কিন্তু শেষ কথাটা শুনে একটা ক্রুর হাসি ফুঁটলো ওর মুখে।
" কি সব বলছো..."
" আমি কিছুই বলছি না, আর যা বললাম সেগুলো কথার কথা। এখন এসব ছাড়ো, চলো খেয়ে নাও সবাই।"
" ইচ্ছে করছে না.."
" তা হয়না। অয়নের জ্বরটা দেখছি নেই। অল্প গরম ভাত দেবো ভাবছিলাম।ঠান্ডা হয়ে গেল কিনা কে জানে?"
" কিছু ঠান্ডা হবে না।" বলে আরতির পিছু পিছু সুজিত আসতে শুরু করলো।
" তুমি কোথায় যাচ্ছো?"
" আমিও তোমার সাথে যাবো, তোমার কাজের সাহায্য করবো। নইলে তোমাকেও যেতে দেবো না।"
আরতি হেসে বলল " আচ্ছা এসো, দেখি কেমন সাহায্য করতে পারবে দেখি.."
চলবে..
বিঃদ্রঃ মায়ের শক্তির কাছে সকলেই হার মানে..
