হরি রিক্সাওলা
হরি রিক্সাওলা
বনগাঁ থেকে রানাঘাটে জাওয়ার পথে পরে গোপালনগর স্টেশন।এই গোপালনগর স্টেশন বাইরে একটি বহু পুরোনো দিনের ভাঙ্গাচোরা প্যাডেল রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হরি সাধন শীল (হরি)।হরির চেহারা রোগ জরাজীর্ণ ,গয়ের রং ফর্সা কিন্তু রোদে পুড়ে পুড়ে বাদামী হয়ে গেছে, মাথায় আধা কাঁচা আধা পাকা চুল, মুখে অনেক দিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি।
এখন স্টেশন চত্বরে এতো বেশি টোটো গাড়ি হয়েগেছে সেই করেনে হরির ভাঙ্গাচোরা রিক্সায় কেউ উঠতে চায়না।যখন কোন টোটো থাকে না তখন নিরুপায় হয়ে কেউ কেউ ওর কাছে আসে। আজকে সেই কারনে দুটো প্যাসেনজার পেয়েছে গোপালনগর বাসস্ট্যান্ডে পর্যন্ত।
বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে হরি হিসেব করে দেখল মাত্র চল্লিশ টাকা রোজগার হয়েছে।ওর মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটা গাছের নিচে রিক্সা দাড়করিয়ে, মাথা নিচু করে বসে রইল।ওর আজকে আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। চার পাঁচ দিন ধরে ছেলে মেয়ে দুটো বায়না ধরেছে মাংস ভাত খাওয়া জন্য। হরি নানা রকম বাহানায় ওদের ভুলিয়ে রেখেছিলো কিন্তু আজকে সকালে হরির বৌ লাবন্য হরিকে বললো হ্যাগো বাচ্চা দুটোকে আর তো বোঝানো যাচ্ছেনা, সেই কবে থেকে নিরামিষ খাবার খেতে ইচ্ছে ওদের। না পারলে বাকি করে ২৫০গ্ৰামঃ মাংস যদি আনতে পারো? হরি কিছুই বলতে পারেনি সুধু হুঁ বলে বেরিয়ে এসেছে। লাবন্য তো বাকির কথা বলে দিল কিন্তু হরি জানে ওকে কেউ বাকিতে দেবে না। কারণ সবার কাছেই আগে থেকে বাকি করে রেখেছে।
হরি এতওখন চিন্তায় ডুবেছিল হঠাৎ একজন ভদ্রলোক ওর কাছে গিয়ে বলল এ যে দাদা স্টেশন যাবে ? হরি অবাক হয়ে ওনার দিকে আর একবার চারিদিকে দেখলো, বাসস্ট্যান্ডে প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে কোনো টোটো দাঁড়িয়ে নেই।ও সঙ্গে সঙ্গে বলল হ্যাঁ যাবো। তারপর সেই ভদ্রলোককে নিয়ে স্টেশনে নামিয়ে দিল। লোকটি চলে যাওয়ার পরে হরি রিক্সাটা এক কোনায় দাড়করিয়ে বসতে যাবে তখন দেখলো একটা ছোট্ট বাক্স রিক্সার কোণে পড়ে আছে।এই রকম বাক্স হরি আগেও এক দু বার দেখেছে, ওর মনে পড়ে গেল হ্যা সোনার দোকানে এমন বাক্স থাকে। হরি বাক্সটা খুলে দেখল ওতে রয়েছে একটা আংটি, সেই আংটিতে একটা পাথর বসানো হয়েছে, পাথর টা খুব চকচক করছে। হরি বুঝতে পারলো এটা খুব দামী, নিশ্চয়ই ঐ ভদ্রলোকের হবে।
হরি খুব তাড়াতাড়ি বাক্সটা নিয়ে স্টেশনের ভিতরে ঢুকে গেল। তখন ট্রেন ঢুকে পড়েছে,ও এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল এমন সময় দেখলো লোকটা ট্রেনে উঠে পড়েছে। হরি জোড়ে জোড়ে ডাকতে লাগল ও দাদা ও দাদা আপনার বাক্সটা, তখন ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ও তবুও ডাকতে লাগল। হঠাৎ ঐ ভদ্রলোক ট্রেনের গেট দিয়ে একটুখানি মাথা বারকরে তাকালো । হরি হাতে ধরা বাক্সটা দেখালো, ভদ্রলোক সেটা দেখেই চিনতে পারলো, তারপর হাত দিয়ে ইশারা করে বললো তুমি দাঁড়াও আমি পরের ট্রেনে আসছি। হরি ইশারা বুঝতে পেরেছে ও হাত দিয়ে ইশারা করে বললো ঠিক আছে।
প্রায় কুড়ি মিনিট পরে ঐ ভদ্রলোক ফিরে আসে। হরি তখন বাইরে ওর রিক্সায় বসে আছে। লোকটি হরি কাছে আসতে হরি বলল আপনাকে অনেক খন ধরে খুঁজে ছিলাম আর একটু আগে দেখলে আপনার এতো কষ্ট করতে হতো না,এইনেন আপনার জিনিষ।ঐ ভদ্রলোক বলল তোমাকে অনেক ধন্যবাদ , তুমি আমার অনেক উপকার করলে।এই বলে পকেট থেকে একটা পাঁচশোর নোট বার করে হরির দিকে বাড়িয়ে ধরে বললো এই নাও এইটা রাখো। হরি বলল না বাবু ই টাকা নিতে পারবো না।ঐ ভদ্রলোক আরও দুই বার সাধলো কিন্তু হরি রাজি হচ্ছে না দেখে বলল আচ্ছা কি খাবে বলো?কিছু খেতেই হবে তোমাকে। হরি এবারও বলল না বাবু কিছু খাবো না। কিন্তু ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা হয়ে বলতে লাগলো বলো কি খাবে। অবশেষে হরি বললো বাবু ২৫০ গ্ৰামঃ মুরগির মাংস কিনে দেন, ছেলে মেয়ে দুটোকে দুই মাস মাছ মাংস খাওয়াতে পারিনি, এই বলতে বলতে ওর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। ঐ ভদ্রলোক এই কথা শুনে অবাক হয়ে হরির দিকে তাকিয়ে দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল ঠিকাছে চলো মাংসের দোকানে।
ঐ ভদ্রলোক হরিকে একটা গোটা মুরগি কিনে দিয়েছে।আজ অনেক দিন পর হরির মনটা ভালো হয়ে গেছে। হরি যখন মুরগি নিয়ে বাড়ি ঢুকলো তখন দেখলো বাচ্চারা না খেয়ে সুয়ে আছে। হরি আস্তে করে লাবন্যকে ডেকে মুরগিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নিল।লাবন্য ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলল এখন না। তারপর ও দৌড়ে রান্না ঘরে চলে গেল। মাংস রান্নার গন্ধে বাচ্চা গুলোর ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। ওরা আস্তে আস্তে মায়ের কাছে গিয়ে বলল মা কি রান্না করছো? লাবন্য একটুখানি হেসে বলল মাংস।এই কথা শুনে ওরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। এই দেখে হরির ও খুব মজা লাগছিল। তারপর ওর একসাথে বসে মাংস ভাত খেলো।
