Sourya Chatterjee

Tragedy Classics Others

4.8  

Sourya Chatterjee

Tragedy Classics Others

হিসেবের খাতা

হিসেবের খাতা

5 mins
250


এখন অভ্যেস হয়ে গেছে, এলার্ম বাজার আগেই ঘুম ভেঙে যায় সুতনুর। টানটান ব্যায়াম করা শরীরটাকে নিয়ে উঠে বিছানায় বসে তারপর সে। বাবু হয়ে বসে জোরে প্রশ্বাস নেয় সুতনু। ধীরে ধীরে তারপর নাক দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ে। এরম ভাবে মিনিট দুয়েক নিশ্বাস প্রশ্বাস চালানোর পর মোবাইলটা হাতে নেয় সে। মোবাইলে ব্যাক কভারটা সমানে খুলে যায়। সারাবে সারাবে করেও সারানো হচ্ছে না। কোনোরকমে রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা এখন। বড্ড অদ্ভুত ব্যাপার, জানেন তো! এলার্ম সেট করা থাকে ভোর সাড়ে চারটেয় আর সুতনুর ঘুম ভাঙবে ঠিক চারটে পঁচিশ মিনিটে। তো মোবাইলটা হাতে নিয়ে মোবাইলে সেট করা এলার্মটা বন্ধ করা ওর পরের কাজ। তা না হলে এখুনি বীভৎস শব্দ করে বাজতে থাকবে।

শহরের উত্তরের একটা ঘিঞ্জি গলিতে প্রায় একশো বছরের একটা পুরোনো রংচটা বাড়িতে একতলার একটা ভাগে ভাড়া থাকে সুতনু। একটা প্যালেস্তরা খসা ঘর, একটা রান্নাঘর আর একটা ছোট বাথরুম! মাসে চার হাজার টাকার ভাড়ার বিনিময়ে আর কি-ই বা ভালো পাবে এর থেকে! এখানেই দিব্যি রয়েছে সুতনু। 

হাতমুখ ধুয়ে এসে বিছানাপত্র তুলে রান্নাঘরে ঢোকে সুতনু। তার আগে রেডিওটা চালিয়ে দেয়। মৃদুস্বরে রেডিওর হিন্দি গান শুনতে শুনতে সূর্যটাও কখন যেন মেঘের পর্দা সরিয়ে পূর্ব আকাশে উঁকি মারে। রান্নাঘরের জানলা দিয়ে তা নজরে আসে সুতনুর। যেটুকু রান্না হয়েছে তা পড়ে থাকে কড়াইয়ে। গ্যাস বন্ধ করে জামা প্যান্ট পরে হিসেবের খাতাটাকে বগলদাবা করে ঘরের দরজা তালা মেরে রওনা দেয় সুতনু। আশেপাশে টুংটাং বাসনের আওয়াজ, সাইকেলের বেলের শব্দ কিংবা দূর থেকে ভেসে আসা একটা দুটো বাসের আওয়াজে শহরের তখন সবে ঘুম ভাঙতে শুরু করেছে। প্যান্টের পকেট থেকে চাবি বের করে নিজের দোকানের পাল্লা খোলে সুতনু। একজন দুজন রোজকার খদ্দের আসতেও শুরু করেছে।

-   সুতনুদা, আজ দু মিনিট লেট! ছ’টা বেজে গেছে!

হাতের ঘড়িটা দেখে সুতনু উত্তর দেয় 

-   এক মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ড লেট।

হাসে সুতনু। ভাঙা এবড়োখেবড়ো দাঁতগুলোর উপর সূর্যের নতুন রশ্মির ছটা প্রতিসরিত হয়ে ওঠে। হিসেবের খাতাটা তাকের উপর রেখে স্টোভের নব অন করে দুধ ফোটাতে দেয় সুতনু। কৌটো থেকে চা পাতা বের করতে করতে প্যানের মধ্যে দিতে দিতে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ওর।

ভোরবেলা দাদা, দিদিদের সাথে চায়ের দোকানে এসছে সুতনু। তখন সুতনু ক্লাস নাইন। বহু দূরের পথ যেতে হবে। সন্ধ্যেবেলা প্রোগ্রাম, কিন্তু সকাল সকাল না বেরোতে পারলে পৌঁছাতে পারবে না। “ও, ভুবনদা তাড়াতাড়ি তেরো টা চা দাও তো। এই কেকগুলোও নিচ্ছি তেরোটা। বেশি সময় হাতে নেই। তাড়াতাড়ি করো”। 

আর এখন ও ভুবনদার জায়গায়। “সুতনু, তাড়াতাড়ি চা দে, নাতিটাকে স্কুলে দিতে যেতে হবে আবার” , “সুতনুদা, একটু কড়া করে কোরো তো চা টা। আজ অফিসে হেব্বি প্রেসার আছে গো”, “কাকু, কাপ কেক দাও গো। মা বলেছে আজ টিফিনে কাপ কেক দেবে” এরম নানার শব্দের ঢল এখুনি নামতে শুরু করবে তার চা গুমটিটার টিনের চালা বেয়ে। আর সেই শব্দের কম্পাঙ্কর সাথে তালে তাল মিলিয়ে কাজ করতে হবে সুতনুকে। খদ্দেরের হিসেব জমতে থাকবে হিসেবের খাতাটায়।

টানা চার পাঁচ ঘণ্টা অবিরাম বিশ্রামহীন খাটুনির শেষে সকাল এগারোটা বাজলে একটু কাজের চাপ কমে সুতনুর। গামছাটা কাঁধে নিয়ে জামার ওপরের দুটো বোতাম খুলে নিজের দোকানের সামনের বেঞ্চিটায় এসে বসে ও। রতনরা আসে তখন গল্প করার জন্যই। সিগারেটের ধোঁয়ায় জমে ওঠা গল্পগুলোর ভাগীদার হয় সুতনু। 

সূর্য যখন মাঝ আকাশ থেকে পশ্চিম দিকে ক্রমশ হেলতে শুরু করে দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে ফেরে সুতনু। ভোরবেলা কড়াইয়ে যেটুকু অসম্পূর্ণ রান্না ছিল, তা সম্পূর্ণ করে স্নান সেরে আসে ও। একটা ক্যালেন্ডারের শিব দুর্গার ছবির সামনে ধুপ ধুনো দিয়ে মন্ত্রপাঠ করে খেয়ে দিয়ে নিয়ে তারপর একটু বিশ্রামের পালা। রেডিওটার বিশ্রামের পালা তখন শেষ। সে আবার এখন গল্প বলবে আর গান শোনাবে সুতনুকে। সুতনু পায়ের উপর পা তুলে সেসব শুনবে। আধপোড়া বিড়ির ছাইয়ে ভরে উঠবে ঘর।

ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে যখন ঘন্টা আর মিনিটের কাঁটার মধ্যে দেড়শো ডিগ্রি কোণ তৈরি করে, পাখির কিচিরমিচির শব্দে সূর্যটা ঝুপ করে পশ্চিম আকাশে ডুব দেয় তখন আবার উঠে বসে সুতনু। চোখ দুটো কচলিয়ে আরো একবার নিশ্চিত হয়ে নেয়, হ্যাঁ, পাঁচটাই বাজে। আবার দোকান খোলার জন্য রওনা দেয় সুতনু, দোসর হয় হিসেবের খাতা। সকালবেলার মত ব্যস্ততা সন্ধেবেলা থাকে না। যারা আসে তারা ওই চায়ের সাথে পাঁচ টাকার গজা কিংবা বাপুজি কেক কেনে। চায়ের থেকে “টা” তেই সন্ধ্যেবেলা লোকজনের উৎসাহ বেশি থাকে আর কি! আটটার মধ্যেই যা টুকটাক বিক্রিবাট্টা হয়, তারপর আর তেমন বিক্রি হয় না। হিসেবের খাতার হিসেব মিলিয়ে ঘরে ফেরে সুতনু।

রাতের ভোজনপর্ব মিটিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে বসে সুতনু। ওপরের তাকে ট্রাঙ্কটা রাখা। প্রতি রাতে ট্রাঙ্কটা যেন নিজের দিকে কোনো এক অদৃষ্ট জাদুবলে সুতনুকে আকর্ষণ করে। অঝোর ধারায় দু চোখ বেয়ে জল ঝরে পড়ে সুতনুর। সুদূর জলপাইগুড়ি থেকে যখন সুতনু কলকাতায় এসেছিল তখন এই ট্রাঙ্কটাতে ভরা ছিল একরাশি স্বপ্ন। আজ-ও রয়েছে তারা। শুধু বাস্তবের সাথে মুখোমুখি হয়ে লড়াইয়ে টিকে থাকতে পারেনি। আজীবনের জন্য ট্রাঙ্কেই রয়ে গেছে তারা। রোজ রাতে সুতনুর চোখের জলের সাক্ষী থাকে তার রেডিওটা। এই সময়টা রেডিওতে রবীন্দ্র সংগীত বাজে, ঠিক চল্লিশ বছর আগে বাবার রেডিওটায় যেমন বাজত। সুতনু তাল দিত সেই ছন্দে। তারপর সেই ছন্দ, তালের উপর ক্রমশ তার ভালোবাসা বাড়তে থাকে। নিজের দিদিকে তার এই ভালোলাগার কথা বলায় দিদি তাকে একটা নাচের স্কুলে ভর্তি করে দেয়। ভালোবাসা, উৎসাহ থাকলে কে কাকে আটকায়! মাধ্যমিকের গন্ডি পেরোতে না পেরোতেই সুতনু নিজের এলাকায় নাম করা নৃত্যশিল্পী তখন। 

তখনো অবধি টুকটাক আপত্তি উঠলেও তেমন বড়সড় কোনো অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়নি সুতনুকে। বয়স বাড়ল, ক্রমশ চাপ বাড়তে থাকল। বাড়ি থেকেও নানান বাধা আসতে থাকল। অবশ্য বাবা মায়ের আর দোষ কি! “আরে! তপনবাবু, ছেলেকে নাচ শেখাচ্ছেন কি মশাই! নাচ তো মেয়েদের জিনিস!”, “পড়াশুনায় মন দিতে বলুন, ভবিষ্যতে খাবে কী”। এরম নানান উপদেশে তারাও কি আর চাইবেন তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ুক। বাইরে প্রোগ্রাম থাকলে তার জন্য টাকা পয়সা চাইলে আর দিত না বাবা। দিদি এক দু বার দিয়েছিল বটে, কিন্তু তিন নম্বর বারে দিদিও আর সাহায্য করল না সুতনুকে। 

নাচের দিদিমণি বাড়িতে বোঝালেও কাজ হলো না। সুতনু যেন মাঝখানে গোলকধাঁধায় আটকে গেল। তার না হল আর নাচ শেখা, না হল পড়াশুনা। উচ্চমাধ্যমিকটা কোনোরকমে পাশ করলেও তারপর আর এগোতে পারেনি সুতনু। এদিকে নাচের দিদিমণি ক্রমাগত উৎসাহ যোগাচ্ছে তখন সুতনুকে। 

-   সুতনু তুই কলকাতা যা। ওখানে ভালো টিচারের কাছে নাচ শেখ। তোর হবে। তোর মত প্রতিভা এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। তুই অনেক বড় হবি।

বাড়িতে রাজি হল না কেউই। নিজের পরিবারের সাথে দূরত্ব যেমন বাড়তে থাকল, তেমনই বাড়তে থাকল নৃত্যশিল্পের সাথে দূরত্ব। কোন অজানা মহাসাগরের একাকীত্বর মাঝে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকল সুতনু। 

একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হত। এক বন্ধুর থেকে কিছু টাকা ধার করে কলকাতা চলে এল সুতনু। এখানে ভালো টিচারের কাছে নাচ শিখবে। কিন্তু এখানকার টিচাররা তো খুব বেশি মাসিক মাইনে চাইছে। তা দেবার সাধ্য কই সুতনুর! এক শুভানুধ্যায়ী সুতনুর জন্য চায়ের দোকান খুলে দিল, কিন্তু ওইটুকু ছেলে ব্যবসা করতে পারে নাকি! 

ব্যবসাটা দাঁড় করালো বটে ছেলেটা, কিন্তু ততদিনে অনেকগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, স্বপ্নগুলো না মরলেও ইচ্ছেরা মরে গেছে ততদিনে। নিজের রান্নাবান্না, চায়ের দোকান চালানোর পর এখন আর নাচ নিয়ে বসতে ইচ্ছে করে না। চোখে বারবার জল আসে সুতনুর। ট্রাঙ্কের মধ্যে সবার চোখের আড়ালে পড়ে আছে ঘুঙুর, মেডেল, সার্টিফিকেট। কেউ খবর রাখে না ওদের আর। শুধু রেডিওটা হয়তো সাক্ষী সুতনুর যন্ত্রণার, সুতনুর চোখের জলের। সুতনু চোখ বন্ধ করে জীবনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করে। মেলে না, চায়ের দোকানের হিসেবখাতার হিসেব মিললেও কিছুতেই জীবনের হিসেব মিলিয়ে উঠতে পারে না সুতনু।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy