হাতছানি
হাতছানি


"ডানদিকে একটা শর্টকাট রাস্তা আছে না? ওটা দিয়ে চল না ..." বিশুর কথায় পালিয়ে বাঁচার ইচ্ছা প্রবল।
"না বাবা, আমি যাব না ওপথ দিয়ে। ওপথেই ডাক্তার চৌধুরির সেই পোড়া হাসপাতাল পড়ে। আমি নেই ভাই।" বিল্টুর গলায় ভয়। স্টিয়ারিং ওর হাতে। ও কোনোভাবেই সেই হাসপাতালের ধারে পাছে দিয়েও যেতে ইচ্ছুক নয়।
"আরে, শালা। আগে তো পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে হবে। তারপর অন্যকিছু ভাবব। আর তুই আজ এত শুকাচ্ছিস কেন বে? সেদিন এ কাজে তো তুইও ছিলি আমাদের সাথে। তখন তো দাদার মুখে টাকার পরিমাণটা শুনে চমকে গিয়েছিলি! লাফিয়ে উঠে বলেছিলি, কাজ হয়ে যাবে দাদা। চিন্তা কোরো না।" সন্তুর গলায় নেশা আর বিদ্রুপের মিশ্রণ।
"ছিলাম বলেই তো বলছি। সেদিন সচক্ষে দেখেছিলাম ... কতগুলো অসুস্থ মানুষ চিৎকার করছিল। আমাদের হাতে লাগানো আগুনে অসহায়ভাবে দাউদাউ করে পুড়ছিল।" বিল্টুর ভীত গলার স্বর।
"যাই বলিস, এটা সেদিন আমরা ঠিক কাজ করিনি। ডাক্তার চৌধুরির সাথে দাদার কি ক্যাচাল ছিল, সেটা অন্যভাবেও সালটে দেওয়া যেত। তার জন্য একটা ডেডবডিকে এনে নাটক করিয়ে চিকিৎসার গাফিলতি বলে হাঙ্গামা করাটা ঠিক হয় নি। তাও যদি শুধু ভাঙচুর অবধি ব্যাপারটা চুকে যেত, তাও ঠিক ছিল। আর দাদাতো আমাদের সেটা করতেই বলেছিল। পরে তো বলল, সব প্রমাণ মিটিয়ে আয়। নইলে তোদেরই বিপদ বাড়বে।" আফশোষের সুর বিশুর বক্তব্যে।
"আমিও পরে বুঝেছি রে। এ কাজটা একদম ঠিক হয় নি। আমরা সুপারি নিয়ে একটা কি দুটোকে ধমকে চমকে দি বা কেলিয়ে দি। সে আলাদা ব্যাপার। কিন্তু তাই বলে এভাবে ... " বলে কিছুক্ষণ থামল বিল্টু।
"আরে সাধু পুরুষের দল, আগে আজ নিজেরা তো বাঁচ। তারপর এসব বিচার করিস বসে। পুলিশ পেছনে, আগে ওপথে ঢোক এখন।" সন্তুর রীতিমতো নির্দেশ।
"দেখ সন্তু, ওই অঞ্চলে কিন্তু সবাই জানে যে ডাক্তারের হাসপাতালে সেদিনের আগুনে এতগুলো লোক মরার পর বেশ গা ছমছমে একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে ... আর তার রেশ এখন এত মাস পরেও আছে। তাই কেউ ওই পথ দিয়ে দিনের বেলাতেও না পারতে যায় না।" বিল্টু সতর্কতা অবলম্বনে বলল।
কিন্তু সন্তুর বেপরোয়া তর্ক। ও এসব ভূত ফুতের ব্যাপারটা জাস্ট তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দিতে চায় এ মুহূর্তে। আর নেশার ঘোরে এখন এসব সূক্ষ্ম জগতের প্রতি কোনো ভয় ভীতি বা সন্দেহজনক প্রশ্ন ওর মনের ধারে পাছেও জাগছে না। ও এখন শুধুমাত্র যেনতেন প্রকারেন নিজেকে পুলিশের তাড়া থেকে বাঁচাতে চায়।
অত:পর সন্তুর ধমকে একরকম বাধ্য হয়েই বিল্টু গাড়িটাকে হাসপাতালের পথে ঘোরাল।
"এতো অন্ধকার কেন রে বিল্টু?"
"জানি না। শেষে প্রাণ বাঁচাতে আমরা এই হাসপাতালে এসে ঢুকলাম?"
"দেখ পোড়া পোড়া বেডগুলো কেমন যেন চোখ বড় বড় করে চেয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। ও-ও--টা কে রে বিল্টু? আমাদের বিশু না? ও এমন রক্তাক্ত কেন? উলটে শুয়ে আছে কেন ওভাবে?"
"আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি তো কেবল লরিটার সামনের আলোটা দেখে গাড়িটা ঘুরাতে যাচ্ছিলাম। তখনই পুলিশের গাড়ির আওয়াজে কান মাথা কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠল। আর ..."
তিরতির করে কাঁপতে কাঁপতে চুপ হয়ে গেল বিল্টুর কণ্ঠ। ওর চোখের বিস্ফারিত মণি দুটোতে তখন প্রতিফলিত হচ্ছে কিছু অস্পষ্ট ছায়ার ভিড়। ধীরে ধীরে গভীর অন্ধকারের গা বেয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে তারা এক এক করে। তারপর সারিবদ্ধভাবে বিল্টু আর সন্তুর চারপাশে বেড়ী বাঁধ করে দাঁড়িয়ে পড়ছে তাদের বীভৎস শরীরগুলোর অবয়ব। এ দৃশ্যের আকস্মিক ভয়াবহতায় সন্তু ধীরে ধীরে এক এক পা করে পিছিয়ে এসে বিল্টুর গায়ে সেঁটে দাঁড়াল। আর শিহরিত হয়ে উঠল বিল্টুর শীতল স্পর্শের ছোঁয়ায়। অত:পর ওদেরকে ঘিরে চারপাশে একটা পোড়া গন্ধের ধোঁয়ার কুন্ডলী পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছে ক্রমশ। তার আস্তরণের উপরিভাগে ফুটন্ত জলবিন্দুর মতো এক এক করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে পোড়া লোহার রডের বেড, পোড়া মেঝে, পোড়া দেওয়ালের খসে পড়া কালো কালো ছাল বাকলা আর পোড়া মানুষের একত্রিত হাতছানি।
"বডি তিনটেকে তুলে পোস্টমর্টেমে পাঠাও। পালাতে গিয়ে নিজেদের পাপের জায়গাতেই মরেছে এগুলো। আর ঘাতক লরিটাকে আশপাশে কেউ দেখেছে কিনা জিজ্ঞাসা করে দেখো।" এস আই রবীন দাসের নির্দেশ।
"স্যার, বিল্টু, সন্তু আর বিশুর বাড়িতে খবর দেব তো?" ছিন্ন ভিন্ন রক্তাক্ত লাশ তিনটেকে দুর্ঘটনাগ্রস্থ গাড়ির থেকে বের করতে করতে এস আই এর কাছে পারমিশন চাইল কন্সটেবল রবি তালুকদার।
(সমাপ্ত)