রম্যকথা: চায়ের কাপ
রম্যকথা: চায়ের কাপ
হাসি কান্না হীরা পান্না : চায়ের কাপ
চা আর সিঙ্গারার মধ্যে মিল এটাই যে ঠান্ডা হয়ে গেলে দু'টোর কোনোটাই ভালো লাগে না।
তবে লক্ষ্য করে দেখবেন, কোনো সিঙ্গারার দোকানদারকে যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন যে সিঙ্গারা গরম আছে কিনা, সে কখনোই না বলবে না। 'এই সবে বানানো', 'ধরে দেখুন' থেকে শুরু করে 'অল্প গরম আছে' - অবধি নানান মাপের উত্তর পাবেন। কিছু কিছু সিঙ্গারা হয় এমনকি আগের দিনের বানানো। হিমশীতল ঠান্ডা। খাওয়া যায় না, কিন্তু তবু তাও কাজে লাগে। পা মচকে গেলে বা হাঁটুতে চোট লাগলে ওই সিঙ্গারা সেখানে ঘষতে পারবেন - বরফের চেয়েও ভালো কাজ দেবে এতোটাই ঠান্ডা। অথচ দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, সিঙ্গারা গরম আছে কিনা। উত্তর পাবেন, "এতো রাতে কি আর খুব গরম থাকে ?" ছোটবেলায় পড়েছিলাম পরম ঠান্ডা নাকি মাইনাস দু'শো তিয়াত্তর ডিগ্রীর কাছাকাছি হয়। কী জানি, সিঙ্গারার দোকানদাররা সেই তাপমাত্রার সাথেই তুলনা করেন কিনা।
তবে কথা হচ্ছে এটা তো চায়ের কাপ নিয়ে রচনা। সিঙ্গারা এখানে নেহাতই গেষ্ট আর্টিষ্ট মাত্র। যেমন চায়ের সাথে চানাচুর বা বিস্কুট। অতএব ওদের ছেড়ে চায়ের কাপে যাওয়া যাক।
চায়ের তুলনায় বিস্কুটের ভূমিকা নগণ্য হলেও দুজনের মধ্যে এক অদ্ভুত শত্রুতা আছে। আমি অনেক লক্ষ্য করে দেখেছি, এরা একজন আরেকজনকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না। এই তো গত সপ্তাহেই, এক মান্যগন্য লোকের বাড়িতে গিয়েছি কোনো এক প্রয়োজনে। গৃহকর্তা আপ্যায়ন করে সাদরে চা-বিস্কুট দিয়েছেন। দারুণ সুন্দর বোন-চায়নার কাপ। রয়ে-সয়ে বিস্কুটটা চায়ে অর্ধেক ভিজিয়ে যেই তুলতে যাবো, অনুভব করলাম বিস্কুটের ভিজে অংশ যেন নীচে পড়ে যেতে চায়। ত্যাঁদোড় বিস্কুট, এই ভাঙ্গলো- এই ভাঙ্গলো ব্যাপার। তখন আমার অবস্থা ঠিক সেই জলে কুমির, ডাঙ্গায় বাঘ। ঝুলন্ত সেই বিস্কুটের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছি কোন পন্থা আমার অবলম্বন করা উচিত। তার তখন অন্তিম দশা। চায়ের কাপ থেকে ভিজে বিস্কুটটিকে ধীরেসুস্থে আমার কাছে যে আনবো, ততক্ষণে বিস্কুট ভেঙ্গে পড়ে যেতে পারে। আবার দ্রুত আনতে গেলেও ঝাঁকুনিতেই ভেঙ্গে পড়তে পারে। বিস্কুটকে বিস্কুটের জায়গায় স্থির রেখে আমি নিজেই টি-টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বিস্কুট কামড়ে নিতে পারি,কিন্তু বড়ো বিসদৃশ লাগে সেটি দেখতে। গৃহকর্তা আমার সামনে বসে তখন গুরুতর কোনো বিষয়ে কথা বলছেন। আর আমিও সেসব মন দিয়ে শোনার ভাণ করে যাচ্ছি। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে ওই ঝুলন্ত বিস্কুটে। আমার সিদ্ধান্তহীনতার সুযোগ নিয়ে একসময় আমার চোখের সামনে দিয়েই ওই ভেজা বিস্কুট খসে পড়ে চায়ের কাপের তলায় চলে গেলো, আর আমি অসহায়ের মতো দেখলাম তাকিয়ে তাকিয়ে।
কিন্তু আসল সমস্যার শুরু ঠিক এর পরেই। অল্প অল্প চুমুকে আমি বাকী চা খাচ্ছি, কিন্তু মনের খচখচানি কিছুতেই যাচ্ছে না। কাপের তলায় সলিলসমাধি নেওয়া ওই বিস্কুটের কাছে আমি কিছুতেই হেরে যেতে পারি না। অসম্ভব। সামান্য একটা বিস্কুটের কাছে পরাজয় মেনে নিতে হবে ? কক্ষনো নয়। আমার শরীরের রাজপুত রক্ত চাগার দিয়ে উঠলো। অতএব, অধীর আগ্রহে আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। গৃহকর্তা কোনো কারণে একটু ঘরের বাইরে যেতেই আমি সার্জিকাল স্ট্রাইক শুরু করলাম। সত্ত্বর একটা আঙ্গুল ডুবিয়ে চায়ের কাপের তলা থেকে সেই বিস্কুটের গলে যাওয়া আত্মাকে তুলে আনার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সোজা আঙুলে ঘিই ওঠে না, বিস্কুট তো অনেক দূরের কথা। আঙুল দিয়ে অনুভব করতে পারছি বিস্কুটের অস্তিত্ব। কিন্তু তুলতে গেলেই সে কেমন যেন এড়িয়ে যায় ছুঁ-না-না ছুঁ-না-না করতে করতে। আমি আবার উল্টোদিক থেকে চেষ্টা করতে লাগলাম আঙ্গুল ঘুরিয়ে, আর সেই চরিত্রহীন বিস্কুট আবার অন্যদিকে পালিয়ে গেলো। আর ততই আমার রাগ চড়তে থাকলো। জেদের বশে প্রথমে দুটো, পরে তিনটে আঙ্গুল ডুবিয়ে যখন সেই বালখিল্য বিস্কুটের অংশকে প্রায় পাকড়াও করে এনেছি, আমার অন্তিম জয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণে গৃহকর্তা ঠিক আবার এসে ঢুকলেন ঘরে। আর আমাকে চায়ের কাপে চার আঙ্গুল ডুবিয়ে বসে থাকতে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, "সে কি, আপনি এখনো চা শেষ করেন নি - কী খুঁজছেন ?"
তবে কখনো কখনো এর চেয়েও বেশী অপ্রস্তুতে পড়তে হয় আমাকে যখন অনেক অতিথি একসঙ্গে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয়। বাড়িতে প্রচুর কাপ। কিন্তু কোনোটার সাথে কোনোটার বিন্দুমাত্র মিল নেই। ব্যাপারটা হয় এরকম যে যখনই নতুন কাপের কোনো সেট কেনা হয়, তার সবকটাই আস্তে আস্তে ভাঙ্গতে থাকে। যেগুলো ভাঙ্গে না সেগুলোও কোথায় কীভাবে যেন হারিয়ে যায়, আর খুঁজেই পাওয়া যায় না। এইভাবে ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে সবশেষে একটাতে এসে ঠেকে। আর তারপর সেই সবেধন নীলমনিটি কিছুতেই আর ভাঙ্গে না বা হারিয়েও যায় না। ওই একটি কাপ সারাজীবনের জন্য আমাদের বাড়িতে রয়ে যায়। এইভাবে বিভিন্ন সময়ে কেনা বিভিন্ন ডিজাইনের বিভিন্ন রঙের এমনকি বিভিন্ন মেটেরিয়ালের একটা করে কাপ রয়েছে আমাদের। মাত্র একটা করে। অতিথিরা এলে ট্রেতে করে সেইসব কাপ সাজিয়ে যখন চা পরিবেশন করা হয়, সে এক দেখবার মতো দৃশ্য তৈরী হয় বটে। একটা কাপ হয়তো সাদার উপর বেগুনি দিয়ে ফুল ফুল ডিজাইন করা। তার পাশে ডিপ কমলা রঙের বেঁটে একটা কাপ। তার পাশেই হয়তো একটা স্বচ্ছ কাঁচের চৌকো কাপ। তার পাশে একখানা স্টিলের কাপ। আর সবশেষে সুদৃশ্য ফাইবারের কাপ। কারুর সাথে কারুর কোনো সম্পর্কই নেই। ভারতের সনাতন ধর্ম - বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য - চায়ের কাপে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই এতসব কাপের মধ্যে একটি কাপ সবসময় থাকবেই যার অবস্থা শোলে সিনেমার সেই সঞ্জীবকুমারের মতো। হ্যান্ডেল নেই। পুরো বডি অক্ষুন্ন ও অক্ষত আছে, কিন্তু কাপের হাতলটা অনেক আগেই ভেঙ্গে গেছে। আর কোনো এক অজানা কারণে এই কাপটিই সবসময় আমার জন্য বরাদ্দ করা হয়। সে কী অবস্থা! একবার চায়ের কাপ তুলি, পরক্ষণেই গরমের চোটে আঙ্গুলে ছ্যাঁকা লাগে, সঙ্গে সঙ্গে নামিয়ে রাখি। একবার তুলি, একবার নামাই। চুমুক দিতে গিয়েও দেওয়া আর হয় না। অতিথি অভ্যগতরা তাই দেখে হয়তো ভাবেন ব্যাটা ব্লুটুথে চা খাচ্ছে নাকি, ঠোঁটের সাথে সংযোগই তো হতে দেখছি না।
তবে চায়ের কাপ নিয়ে পাগলামির এখানেই শেষ নয়। এর চেয়েও বড়ো পাগল আমি দেখেছি।
একবার এক রৌদ্রতপ্ত দিনে কলকাতার নামী এক রেস্তোরাঁয় বসে চা খাচ্ছিলেন মৌলানা আবুল কালাম খান সাহেব। এমন সময় তার পরিচিত কোনো বয়স্ক ভদ্রলোক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বসলেন তার সামনে। ভদ্রলোককে দেখে খুব স্বাভাবিক মনে হলো না। তিনি উত্তেজিত স্বরে বললেন, "খান সাহেব, আমার ছেলেটি মনে হয় পাগলই হয়ে গেলো শেষে। আজকাল সে চায়ের কাপ খাওয়া ধরেছে। পুরো চায়ের কাপশুদ্ধু খেয়ে নিচ্ছে, জানেন ?"
মৌলানা সাহেব শান্তকণ্ঠে বললেন, "আপনি ঠিক করে বলুন তো কী বলছেন। চায়ের কাপ খেয়ে নিচ্ছে মানে কি কাপের হ্যান্ডেলটাও খাচ্ছে ?"
সেই ভদ্রলোক বললেন, "না, সেটাই তো আশ্চর্যের। পুরো কাপ খাচ্ছে, কিন্তু হ্যান্ডেলটা সযত্নে বাদ দিয়ে দিচ্ছে, খাচ্ছে না।"
তখন মৌলানা সাহেব সত্যি সত্যিই উদ্বিগ্ন হলেন। চিন্তিত সুরে সেই ভদ্রলোককে বললেন, "তাহলে তো মহা চিন্তার বিষয়। চায়ের কাপের তো হ্যান্ডেলটা খেতেই সবচেয়ে সুস্বাদু লাগে।"
আরেকবারের কথা। স্থান সেই এক, কলকাতার কোনো এক বড়ো রেস্তোরাঁ। পাত্র আমাদের খান সাহেব নন, শহরের কোনো এক হিরে ব্যবসায়ীর পুত্র, সিরাজ। সে বসে হুইস্কি পান করছিলো। এমন সময় স্থানীয় গির্জার এক পাদ্রীর আবির্ভাব। এদিক ওদিক দেখে তিনি এলেন সিরাজের টেবিলে।
"আমি কি এখানে বসতে পারি ?"
"নিঃসংকোচে বসুন।" সিরাজ জবাব দিলো।
"মাই সন", পাদ্রী বললেন, "তুমি জানো মদ্যপান ঘোর পাপ, শরীরের জন্য মদ্যপান কত খারাপ হতে পারে ? দরকার হয় চা খাও, চা ক্ষতিকর নয়।"
একটু ইতস্ততঃ করে সিরাজ বললো, "আপনি কি কখনো খেয়েছেন হুইস্কি ?"
"ছিঃ ছিঃ - না, কখনোই না।"
"আপনি তাহলে জানলেন কী করে যে মদ্যপান কত খারাপ হতে পারে ?"
পাদ্রী মহাশয় এবার তো তো করে বললেন, "মানে আমরা জানি, আমাদের অগ্রজরা বলে গেছেন মদ্যপান খারাপ। মদ খাওয়া পাপ কাজ।"
"তাহলে তারা নিয়মিত মদ্যপান করতেন বলুন ? ওই আমাদের অগ্রজরা।"
"না, তারাও নিশ্চয়ই কোনোদিন এইসব কুখাদ্য খাননি।"
"তাহলে তো মুশকিল পাদ্রী মশাই। একটা জিনিষ কোনোদিন না-খেয়েই যদি সেটা খেলে পাপ হয় বলে চিহ্নিত করে ফেলা হয়, সেটা কি ঠিক বিচার হলো ? একদিন খেয়েই দেখুন তো, পাপ হয় কিনা।"
পাদ্রী সাহেব পড়লেন মহা বিপদে। তিনি তখন বললেন, "ঠিক আছে, তুমি যদি বলতে চাও যে নিজে মদ খেয়ে পরখ না করলে মদ্যপানের ক্ষতি নিয়ে বলা যায় না, তাহলে আমি তোমার কথা ভেবে একবার নিজেকে এই পাপের জন্য উৎসর্গ করতে নাহয় রাজি আছি। কিন্তু একবারই। আর, কেউ যেন জানতে না পারে।"
উৎফুল্ল হয়ে সিরাজ সোজা রেস্তোরাঁর কাউন্টারে গিয়ে বললো, "দু'টো হুইস্কি চার নম্বর টেবিলে। একটা হুইস্কি গ্লাসে, আরেকটা সাধারণ চায়ের কাপে দেবেন। একটু গোপনীয়তার ব্যাপার আছে।"
কাউন্টারের ভদ্রলোক পান চিবোতে চিবোতে বললেন, "সেই মদখোর পাদ্রীটা আবার এসেছে নিশ্চয়ই।"
~ সমাপ্ত
