হারমোনিয়াম
হারমোনিয়াম
শিয়ালদাহ বারুইপুর লোকাল হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করে রোজ সঞ্জয়। নামতে যাবে তখন হঠাৎ পিছন থেকে এক চেনা ছোকরা কন্ঠ বললো- "ওই কামড়ায় লোক নেই। এখানেই আরেকটা গান শুনিয়ে যা না দুঃখে। তবে হিন্দি গান গাইবি। তোর ওই বাংলা গানের প্যানপ্যানি ভালো লাগে না আর।"
ও হাসলো। বললো " শিখে নেবো খানে এখনো শিখতে পারলাম কৈ হিন্দি গান। আসলে বাংলা গানটা হৃদয় দিয়ে গাই।"
বলে সে " পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কিরে হায় " গাইলো। আরো একটা দয়াবান যাত্রী একটা খুচরা পয়সা দিয়ে গেলো ওর কোটোতে । "
পুরানো সেই দিনের কথা গান সত্যি ওর চোখ ভিজিয়ে দেয়। কারণ ওর নামটা দুঃখে রেখেছে পাড়ার লোকেরা। জন্ম এক বছর মধ্যে বাবাকে হারলো। মা গান গাইতেন ভালো। তিনি ওকে গান শিখিয়েছিলেন। উনিও ওকে ছেড়ে গেছেন বছর পাঁচেক হলো। আর চিকিৎসার অভাবেই ও অন্ধ হলো।
বিহারী হোটলেই যেতে হবে ওকে। রহিম চাচার হোটেল এখন ভালো চলছে না। তাই খুচরা টাকা নিতে চায় না ও। ব্যবহার ভালো করছেন সবার সাথে। আজকাল আবার ধর্ম নিয়ে মাতামাতি করছে বেশি। নতুন দোকান বিহারীর ভালো ব্যবহার করে দোকানটা ভালো চালায়। রবীন্দ্র সঙ্গীত বোঝে কিনা জানিনা তবে। রোজ ওকে গাইতে বলে। দুইটো খদ্দের ভিড় করে গান শুনতে। তাই কখনো কখনো খাবারের পয়সাও নেয় না বিহারী । ভাঙা বাংলায় বিহারী ওকে রোজ বলে " হিন্দি গানটা শিখে লেও দুঃখে বাবু , বেশি টাকা মিলবে।"
স্টেশান নেমে গান গাইতে গাইতে একটু এগিয়েছে। পিছন থেকে একটা চেনা কন্ঠ "সঞ্জয় দাঁড়াও।" এই নামে ওকে আজকাল আর কেউ ডাকে না , সুচিত্রা ছাড়া ।
ওর হাতে দুই টো কাগজের নোট গুঁজে দিলো সুচিত্রা। সুচিত্রা বললো " কাল বলছিলে না। বিহারীর দোকানে মাছ পাওয়া যায় না। তাই রুটি তরকারি খেয়ে খেয়ে পেটে শ্যাতলা পরে গেছে তাই দিলাম। রহিম চাচার হোটেলে মাছ ভাত খেয়ে নিও।"
সুচিত্রা লেখা পড়ায় ভালো ছিলো। ওর সাথেই পড়তো। ফ্যাস্ট ইয়ারে পড়ে তখন সুচিত্রা। জমিদার বাবুর ছেলের সাথে ওর বিয়ে ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তখনই ক্যামেস্টি ল্যাবে কাজ করতে গিয়ে ওর চোখটা নষ্ট হয়ে যায় ওর। বিয়েটা ভেঙ্গে গেলো ওর। ও এখন সুজিত বাবুর NGO তে অন্ধ মানুষদের গান শেখায় আর পড়াশোনা করায়।
আমতা করে সঞ্জয় বললো " আচ্ছা সুচিত্রা আমাকে কটা হিন্দি গান তুলে দেবে । "
সুচিত্রা বললো " হঠাৎ হিন্দি গান কেন !"
সঞ্জয় বললো " বাংলা গান শুনে ভিক্ষা দেয় না যে।"
সুচিত্রা বললো " ও তাই বুঝি। তুমি আসবে কয়েকটা বাংলা লোক গান শিখিয়ে দেবো। এখন লোক গান শোনার ফ্যাশান চলছে।যে ভিক্ষা দেবার সে তোমাকে এমনিতেই ভিক্ষা দেবে। গান বোঝে কয়জন । নয়তো হিন্দি গান মানে তো এখন চার বোতল ভটকা নয়তো নাচ মেরি যা। কথা কোথায় ? সুর কোথায়? তবু কালতো ছুটির দিন চলে এসো ngo তে। "
সঞ্জয় দুই দিন ngo গিয়ে, বিপদে পড়ে গেলো রোজ হাসপাতালে আসতে হয় এখন। তবে ও আসে সুচিত্রার জন্য। সুজিত বাবুর দূর্ঘটনার পর হাসপাতালে পরেছিলো সুচিত্রা। তবে ভালোই হয়েছে তাতে। সুজিত বাবুতো ওকে বিয়েও করতে চেয়েছিলো। মৃত্যুর আগে তাই সুচিত্রাকে চোখটা আর ওর বিষয় সম্পত্তি দিয়ে গেছে। আজ আবার ওর চোখ খোলো হবে। এই বিশেষ মুহূর্তে সঞ্জয় এলো। আর তো সুচিত্রার সাথে ওর দেখাই হবে না। জমিদার বাবু আবার সুচিত্রাকে ওদের বাড়ি বৌ করবে বলে ঘোষণা করেছে।
সুচিত্রা চোখ দেখতে পাচ্ছে খবরটা শুনে সঞ্জয় বেড়িয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় সুচিত্রা পিছু ডাকলো " সঞ্জয় কোথায় যাচ্ছ দাঁড়াও। জমিদার বাবু আপনার যেতে পারেন। আপানার দুঃখে চেনেন বোধহয় ওর ভালো না সঞ্জয় । আমি সঞ্জয়কে বিয়ে করবো। ও ভালো গান গায়। ওর ওটা গুন। আপানার ছেলের শুধু টাকা পয়সা আছে। সেটা তো এখন আমারো আছে। সঞ্জয় আমার চোখ যখন ছিলো না তখন বন্ধু ছিলো আজ বন্ধু আছে। তাই বোধহয় আমার জীবন সঙ্গী হবার যোগ্যতা অনেক বেশি।"