হারিয়ে যাওয়া
হারিয়ে যাওয়া
মানব জীবনের সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হল তার অনিশ্চয়তা, এক মুহূর্তের মধ্যে কত কি ঘটে যেতে পারে যা আমরা এক মিনিট আগে বা স্বপ্নেও ভাবিনি। কিন্তু তবুও এই ঘটনাগুলো ঘটে আর আমরা আঘাত পেয়ে কিছুদিন দুঃখ বুকে নিয়ে চলি। তারপর ধীরে ধীরে সময়ের আবর্তে আমাদের কাছে এর তীব্রতা হারিয়ে যায়, আমরাও ভুলে যাই। আবার জীবনে ফিরে যাই। অথবা কোন কঠিন দুঃখ সামনে এসে এই মনোকষ্টকে ছাপিয়ে যায়, আমরা এই দুঃখ ভুলে যাই। জীবন তার নিজের পথে চলে আর আমরা চলতে চলতে হারিয়ে যাই।
টেবিলের ওপর জন্মদিনের কেকটা অনেকক্ষণ হল পড়ে আছে। আঠেরোটা মোমবাতি গলে গলে প্রায় নিঃশেষিত। তার সামনে জলভরা চোখে বসে প্রদীপ । প্রদীপ রায় । এক কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। সুস্থ করে তোলার জন্য তাকে নিয়ে বহু ডাক্তারের কাছে ঘুরেছেন রায় দম্পতি, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কেউই আশার আলো দেখাতে পারেননি। তবু হাল ছাড়েনি প্রদীপ । দাঁতে দাঁত চেপে মৃত্যুর সাথে লড়াই করার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে সে।
প্রদীপের কথা -
মাঝে মাঝে যে আমার কি হয়! একপশলা বৃষ্টির মতন স্মৃতিরা এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায় আমার মনটাকে। চিকিৎসকদের নির্দেশে স্কুল যাওয়া বারণ, তাই বসে থাকি জানলার ধারে। সকালে দেখি স্কুল বাসে করে সব বন্ধুরা যাচ্ছে। বুঝি, তখন এক তীব্র হীনমন্যতা অনুভব করি - মনেহয় আমি স্থাবর হয়ে গিয়েছি, কিন্তু পৃথিবী? তা তো কোনদিনই হবার নয়। জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে ব্যস্ত সবাই। একটু বেলা হলে শান্ত হয়ে আসে পাড়াটা। অফিসবাবুদের গাড়ি এসে হর্ন বাজাতে থাকে বাড়ির দরজায়। আশেপাশের বাড়িগুলোর থেকে ভেসে আসে কাজের লোকদের কাপড় কাচার শব্দ। আমার ঘরটার জানলা দিয়ে রোজ দেখি, ঝমঝম করতে করতে দূরে ট্রেন চলেছে নিজের উদ্দেশ্যে। সামনের সজনে গাছটার গা বেয়ে দুটো কাঠবেড়ালি ওঠে আর নামে, শাল গাছটার তেল চুকচুকে সবুজ পাতা থেকে আলোর বিন্দুগুলো যেন গলে গলে টুপটাপ পড়তে থাকে,
সাদা সাদা নোটন পায়রাগুলো এসে চুপচুপ বসে থাকে, বেশ লাগে দেখতে। নীচে বাগানটার থেকে গোলাপ টগরের খুশবু ভেসে এসে হালকা করে দেয় ভার হয়ে থাকা মাথাটাকে। শুধু একটাই কথা এসময় ভীষণ ভাবে মনে হয় মাঝে মাঝে, আর কয়েকদিন পড়েই আমি তো আর থাকব না! সব কিছুই এগিয়ে চলবে নিজের তালে, আমি ছাড়া।
সারাটা দিন প্রদীপ জানলার পাশেই বসে থাকে। রোগটা ধরা পরার পরে প্রায়ই আত্মীয়স্বজন পরিচিতরা আসতে থাকে তাকে শুভকামনা জানাতে, কারোর সাথেই দেখা করতে চায়না সে। আজ জন্মদিনেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
প্রদীপের কথা -
আজ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল মা বাবা। আমি চেম্বারের বাইরে বসেছিলাম। নার্সদিদিরা যেভাবে আমার সাথে গল্প করছিলেন, আমাকে উপহার দিলেন, আমার বুঝতে বাকি ছিল না কিছুই। খানিকক্ষণ পর ডাক্তারকাকু বেরিয়ে এসে বললেন, আমাকে আর নাকি আসতে হবে না। মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মায়ের চোখ টলটল করছে। আর বাবা কঠিন হতে চেষ্টা করলেও আমি বুঝেছিলাম ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছে বাবাও। কিছু বলিনি। শুধু হাসিমুখে ডাক্তারকাকুর সাথে হ্যান্ডশেক করে নার্সদিদিদের টাটা করে বেরিয়ে শেষ দেখা দেখে নিলাম হসপিটালটাকে।
আত্মীয়দের সাথে তেমন দেখা করতে না চাইলেও, বন্ধুবান্ধবরা এলে খুশিই হয় প্রদীপ । যদিও আজ জন্মদিনে সে শুধু একজনকেই ডেকেছে। তার প্রিয় বন্ধু তপনকে। তাকে সঙ্গে নিয়েই এখন সে বসে টেবিলের সামনে।
প্রদীপের কথা -
আজ তপনকে ডেকেছিলাম জন্মদিন উপলক্ষে। আমার শেষ জন্মদিন। ও এলে ওর সাথে ঝগড়া করলাম একটু। কিছুতেই মানতে রাজি নয় যে আমি আর বেশিদিন নেই। বেশ লাগছিল ওর সাথে ঝগড়া করতে। কেউ তো আর ঝগড়া করে না এখন আমার সাথে। বুঝতে চায় না,আমি সহানুভূতি চাই না। কেকটা কাটতে ইচ্ছে করছিল না কিছুতেই। অন্য বছর কত হইহুল্লোড় করতাম, আজ অদ্ভুত নীরব ছিল সবাই। শুধু তপনই যা খানিকটা কথাবার্তা বলছিল আমার সাথে। বেশ বুঝছিলাম, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ক্রমশ হেরে যাচ্ছি এই দড়ি টানাটানির খেলায়। হয়তো আজ রাতেই….
লেখাটা আর শেষ করতে পারেনি প্রদীপ, জীবন আর তাকে সময় দেয়নি ।
ডায়েরিটা বন্ধ করে একবার ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন প্রদীপের মা। বাইরে শীতকালের ঝলমলে নরম রোদ এসে জানলার ধারে প্রদীপের ফেলে যাওয়া চেয়ারটায় পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরপায়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
শালগাছটার থেকে একঝাঁক সাদা পায়রা ডানা মেলে উড়ান দিল অনন্তের দিকে, যেন এতদিনের বন্দী দশার থেকে মুক্তি পেয়ে মনে আনন্দে হারিয়ে গেল কোন অচেনা দেশে। এই মুক্ত প্রানগুলো যেখানেই থাক ভালো থাকুক।