গুহার সেই আলমারিটা
গুহার সেই আলমারিটা
'অনবদ্য! পাহাড়ের এই জায়গাটা কি অদ্ভুত সুন্দর দেখছিস?' হিমালয়ের একটা বেস্ ক্যাম্প থেকে পর্বতারোহণ করতে যাওয়া কলেজ পড়ুয়া তিন বন্ধুর মধ্যে রায়ান করে এই মন্তব্যটা।
'এই জায়গাটায় একটা আলাদা চার্ম আছে ভাই! একটু ঘুরে দেখবি না কি?' এবার এগিয়ে আসে রিমো।
'শেরপা কি বলেছে মনে নেই? এই পথে উঠতে গিয়ে কোথাও দাঁড়াতে না, নাহলে বিপদ আসতে পারে। এক যদি ধস না নামে, বারণ করে দিয়েছে সোজা উঠে যাওয়া ছাড়া আর এদিক ওদিক না দেখতে' সতর্ক করে রন্তু।
'আরে এই তো সবে চড়া শুরু করলাম। এর মধ্যেই কি বিপদ আসবে? তোর এত ভয় তো এলি কেন?' রায়ানের কথায় এবার মুষড়ে যায় রন্তু।
তিন বন্ধু সমতল মতন জায়গাটায় এগোতে গিয়ে কিছুদূরে দেখতে পায়, পাহাড়ের খাঁজে একটা গুহা। তার মধ্যে উজ্জীবিত হয়ে রয়েছে অজস্র গুল্ম। তাদের ঘ্রাণে জায়গাটা মেতে উঠেছে। গুহার মুখটায় দড়ি বেয়ে নেমে যায় ওরা।
গুহার ভেতরটা অদ্ভুতরকম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। বুঝি কেউ নিয়মিত থাকে সেখানে। অবশ্য কারুর দেখা মেলে না। গুহার আরও ভেতরে এগিয়ে যেতে, একটা বাঁশির আওয়াজ কানে আসে। মনে হয় অপার্থিব কিছু। এত মোহময় তার সুর, এত গভীর তার আহ্বান! মোহাবিষ্টের মতন ওরা এগিয়ে যায় গুহার অন্ধকার ভেতরে। কোনো এক অদেখা ছিদ্র দিয়ে এক কণা রোদে ওদের পথ দেখতে সাহায্য করে। কিছুদূর এগোতে চোখে পড়ে গুহার এক কোনায় একটা সুবিশাল কাঠের আলমারি। এতই বিশাল তার গড়ন, এতই কালো তার রং যে ভালো করে না দেখলে ভুল হবে যে সেটা পাহাড়ের একটা অংশ।
রিয়ান নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে,
'এ তো যে সে আলমারি নয়! দেখ কত অজস্র কারুকার্য করা এর গায়ে! কোনো অচেনা ভাষায় লেখা কত কিছু। খেয়াল করছিস, এর দরজার ভেতর থেকেই ভেসে আসছে সুরের আওয়াজ'
হাত বাড়িয়ে হাতল ঘুরিয়ে খুলতে যায় রায়ান। রন্তু এগিয়ে এসে আটকাতে যায়,
'কি করছিস রায়ান? একটা অচেনা জায়গায় এভাবে একটা আসবাব পড়ে আছে, সেটায় হাত দেওয়া কি ঠিক হবে? কার না কার সে তো জানি না, তার ওপর অদ্ভুত সুর বাজছে নিজে থেকেই। কোনো বাঁশি কখনও নিজে থেকে বাজে বলে শুনিনি কখনও। আমার খুব গন্ডগোলের লাগছে জায়গাটা। চল না আমরা ফিরে যাই'
'আরে আলমারি খুলে দেখতে ক্ষতি কি? আমি তো আর নিতে যাচ্ছি না অন্যের জিনিস!' হাত ছাড়িয়ে নেয় রায়ান। হাতল ঘুরিয়ে ক্যাঁচ ঘর ঘর ঘর করে আলমারিটা খোলে। বোঝাই যাচ্ছে এই জিনিসে কেউ কোনোদিন হাত দেয়নি। ভেতরটা যা ভেবেছিল, তার থেকেও সুবিশাল। আলমারির উল্টোদিকে একটা ফুটো আছে। এতটাই বড়ো সেই ফুটো যে কারুর মাথা গলে যেতে পারে অনায়াসে। সেদিকে দেখা যাচ্ছে সবুজ পৃথিবী আর সেখান থেকে ভেসে আসছে বাঁশির মনভোলানো সুর।
রায়ান এগিয়ে গিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দেয় সেই ফুটো দিয়ে।
'কি দেখছিস রায়ান?' জিজ্ঞাসা করে রিমো। কিন্তু রায়ান এতটাই ব্যস্ত থাকে যে কোনো উত্তর দেয় না। ঠায় দাঁড়িয়ে ওপর প্রান্তে দেখতে থাকে সে।
দুমিনিট পর ফের রিমো বলে,
'আরে একা কতক্ষন দেখবি রে? আমাদেরও দেখতে দে!' বলে রায়ানকে ধরে সরাতে যায়। কিন্তু তখনই চমকে ওঠে রিমো আর রন্তু দুজনেই।
রায়ানের শরীরটা এই দুই মিনিটে বেশ ঠান্ডা হয়ে গেছে। যদিও শরীরে আর কিছু হয়নি, ওকে ধরে টানতে গিয়ে যে মাথাটা বেরিয়ে এলো, সেটা এক অতি বৃদ্ধ হয়ে যাওয়া রায়ানের। মুখে তার অজস্র বলিরেখা, ঘোলাটে চোখ প্রায় কোটরে ঢুকে গেছে, মাথায় কয়েকটা মাত্র সাদা ধবধবে চুল। আঁতকে উঠে পিছিয়ে যেতে থাকে দুজনে।
রায়ানের বয়স্ক মাথাটা দুলে ওঠে। টলে যায় বেসামাল হাঁটতে গিয়ে। তারপর ক্ষীণ কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে বলে,
'তোরা কে? আমার সাথে হিমালয় জয় করতে আসা রিমো আর রন্তু না? তোরা এখনও এখানে দাঁড়িয়ে? আমি এখনও সেই পুরোনো পৃথিবীতে বেঁচে? কিন্তু... কিন্তু... সেই কত শতবর্ষ আগে হিমালয়ের একটা গুহায় এসে এক আলমারির ভেতর দিয়ে এক নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছিলাম! ওপারের পৃথিবী তো এক অন্য অনন্য জগৎ, ওখানে হাজার বছর বেঁচেছিলাম। সেখানকার বাসিন্দা হয়ে বেশ তো জীবনযাপন করছিলাম চিরযুবক হয়ে। ওখানে থেকে গেলে হয়ত আরও অগুন্তি বছর সুখে কাটাতাম, যদি না অপদার্থ তোরা আমাকে টেনে বের করে দিতিস। আমার সমস্ত বয়স এসে হুড়মুড়িয়ে চেপে বসলো আমার মাথায়, ওই জগতে আমার মাথাটুকু দিয়ে প্রবেশ করেছিলাম যে! ধিক্কার তোদের, এই পৃথিবী এক মস্ত ভ্রম। তোরাও ভ্রম, আমিও ভ্রম, ওই আলমারিও ভ্রম'
কথা বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে চিরতরে জ্ঞান হারালো রায়ান। হঠাৎ থেমে যাওয়া বাঁশির আওয়াজ আবারও বেজে উঠলো, নতুন অতিথিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে।।