এরই নাম প্ৰেম
এরই নাম প্ৰেম
মানুষের জীবন অনেকটা নদীর মত, প্রথমে স্রোতস্বিনী নিজের অপ্রতিরোধ্য গতি, এরপর ধীরে ধীরে জীবনের পলিতে কিছুটা ভাটার টানে চলে যাওয়া - সবশেষে সমুদ্রে মেশার আগে পর্যন্ত এক শান্ত স্থিতিশীল চলমান গতি। ঠিক যেমন আমাদের জীবনের চক্র। প্রথমে একটা আবেগ নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার জীবন, মধ্যভাগে হতাশা ও নানা সাংসারিক চাপে কিছুটা শ্লথ গতি - পরিশেষে এক নিজস্ব তালে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।
পম্পার সাথে আমার পরিচয় প্রায় ৯ বছরের আর তার মধ্যে ২ বছর ছিল একে অন্যকে জানার - যাকে আজকালকার ভাষায় কোর্টশিপ বলে।
পম্পার সাথে এক ছাদের নিচে থাকার আজ সাত বছর পূর্ণ হলো অর্থাৎ আমাদের বৈবাহিক জীবনের বয়স। যদিও আজকের দিন নিয়ে আড়াই বছর হলো আমি তার সাথে থাকিনা। সে একা থাকে। সাত তলা বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় একটা এপার্টমেন্টে তার নিত্যদিনের কাজ কারবার। একলা হাসে, একলা কাঁদে - সঙ্গী অবশ্য আছে কিন্তু আমি নেই এ যেন তার বিশাল শূন্যতা। কিন্তু এ বিরহের আগে সে এসব নিয়ে কেয়ারই করত না। আমি কি করছি, কোথায় যাই, কি চাই এসবের বালাইয়ে সে নেই। তার পথ চলা অন্যজনকে নিয়ে। সেই একজন কে নিয়েই তার চাওয়া পাওয়া। মাঝে মাঝে খুব হিংসে হতো আবার ভালোও লাগত। ভাবতাম সবই তো আমার ছায়াতল বা বটবৃক্ষ , আরশিনগর।
বিয়ের দুবছর আগে পম্পার সাথে পরিচয়। সেও একটা মজার ঘটনা দিয়ে। আমি আর সে আলাদা আলাদা ভাবে শপিং শেষে ক্যাশ কাউন্টারে টাকা দিয়ে যার যার শপিংব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে আসি। এসে দেখি হায়! মেয়েদের কাপড় চোপড় দিয়ে ব্যাগ ভর্তি। কিন্তু আমার ব্যাগে তো একটা প্যান্ট, একটা শার্ট, দুইটা টিশার্ট ছিল কিন্তু এসব দেখে তো আমার মাথায় হাত কপালে ঘাম জমা শুরু।
এসব কিভাবে হলো? মনে করতে লাগলাম কি হতে কী হয়েছে। একই সেলসম্যানের কাছ থেকে আমি আর একটা মেয়ে ব্যাগ দুটি নিয়েছিলাম।মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে ব্যাগটা নিয়েছে। গড়বড় নামক এই বিপদটি মনেহয় সেখানেই হয়েছে! কি করব কি করব করে ভাবছি আর মাথা চুলকাচ্ছি,আবার কখনও চরম রাগে আবোল তাবোল বকবক করছি। প্রায় একঘন্টা সময় লস করে এই কাপড় গুলো পছন্দ করেছি এখন যদি সব হারাতে হয়। মনে হলো ফেরত না দেওয়াটা চতুরতা হবে - নাহ! প্রায় সমমূল্যের জিনিসই আছে ব্যাগে। জিনিসপত্র দেখে মনে হলো মেয়েটির পছন্দ আছে, বলতেই হয়। মাথা চুলকাতে চুলকাতে সিদ্ধান্ত নিলাম যেখানে ঘটনাটা ঘটেছে সেখানেই যাই.... অন্তত যদি মেয়েটা এসে ফেরত দেয় তবে দুজনেই দুজনেরটা ফেরত পাবো... যেই ভাবা সেই কাজ।
বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা নিলাম। যদিওবা আজকাল সন্ধ্যার কিছুপর তাড়াতাড়ি রিকশা পাওয়াটা ভাগ্য বলা যায়। রিকশায় বসে মেয়েটার চেহারা মনে করতে লাগলাম- ফর্সা, স্কার্ফ দিয়ে সুন্দর করে গলা ঢাকা, ঠোঁট গুলো একটু মোটা তাতে খয়েরি কালারের লিপষ্টিক, খদ্দর কাপড়ের তৈরি ফুলহাতা সালোয়ার কামিজ,হ্যান্ড এমব্রয়ডারি কাজ করা সালোয়ার কামিজের রং সাদা। লম্বা অনুমানিক ৫' ৪" হবে। মনে রাখার কারন শপিং করার সময়কালে আমার সামনে দু-চারবার চক্কর দিয়েছে মেয়েটি। দেখে মনে হয়েছে চঞ্চল আর অস্থির টাইপের মেয়ে.........।হলোও তাই। রিকশায় করে যাচ্ছি, অতশত ভাবনায় হারিয়ে গেছি...... বাস্তবে ফিরলাম দুজন রিকশা চালক তাদের কুশল বিনিময় করার প্রাক্কালে।আমি যে রিকশায় বসে আছি সেই রিকশা সামনের একটা রিকশাকে ওভারটেক করছে সে সময় তারা উভয় পরিচিত হওয়ায় তাদের এই আলাপন। অপর রিক্সার যাত্রীর দিকেই তাকাতেই আমি তো অবাক - যার খোঁজে যাওয়া তাকেই পিছনে ফেলে যাচ্ছি। চোখাচোখি হল । তখনই দুই চলমান রিকশার যাত্রীদ্বয়ের একসাথে সম্বোধন -- "এই যে................... "।
পাশে একটা সিসিডি - ক্যাফেতে বসলাম দুজনে ।নাম পম্পা, আমি সমীর রায় । পাশাপাশি দু-বিল্ডিংয়ে থাকি আমরা তবে পম্পার আগমন প্রায় ১ মাস ছুঁইছুঁই করছে, আমি চার বছরের ঠিক কাছাকাছি। দেখা হয়নি এতদিন,আজই প্রথম।পম্পাই বলল, - ব্যাগটা অদলবদল হয়েছে মনে হয়
- হ্যাঁ,তাই যাচ্ছিলাম।
-হুম, আমার মনে হয় তাড়াহুড়োতেই ভুলটা হয়েছে।
- হয়ত,আমারও তাই মনে হয়।
ব্যাগটা অদলবদল হলো,চুক্তিপত্র হস্তান্তরের মতোই। পম্পাকে যত টা চঞ্চল আর মনে হয়েছিল ততোটা নয়। পুরোই গম্ভীর। ব্যাগটা নেয়ার সময় ওর হাতটা কাঁপছিল, অবাক হচ্ছিলাম আমি।মনে হলো হয়তো চলনে বলনে ভারসাম্য রাখে মেয়েটি।
-দেখুন তো সব ঠিক আছে কিনা (আমি বললাম)
-কী, আপনি এসব দেখেছেন!
- বারে, না দেখলে বুঝতাম কিভাবে এটা আমার ব্যাগ নয়।
- সরি, তাই তো।
পম্পা যেন লজ্জায় লাল হলো, রুপালি আলোয় সোডিয়াম বাতির মিশ্র প্রভায় পম্পাকে আরো মোহময়ী করে তুলছে......
-এবার তাহলে উঠা যাক। পম্পা বলল
- হ্যাঁ, হ্যাঁ চলুন...........
আবার রিকশার জন্য অপেক্ষা..... পম্পা রিকশায় উঠে বসল আমি তখন অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম অন্য রিক্সার জন্য.....
আমাকে অবাক করে দিয়ে পম্পা ডাক দিলো, এই যে কী হলো? যাবেন না….
হাত দিয়ে ইসারায় বসতে বলল।
অপ্রস্তুতের মতো আড়ষ্ট হয়ে বসলাম তার পাশে...। এরপর চলার পথে
সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে একটু আগের লজ্জাবতী পম্পা চঞ্চলতায় ফিরল.........। কখন যে আমি 'আপনি' থেকে 'তুমি ' - তে এসে গেলাম সেটা বুঝতেই পারিনি।
জন্ম নেয়া থেকে আজ পর্যন্ত - সারাংশ আলোচনা করতে করতে বাসার ঠিক সামনে চলে আসলাম.....
নেমে বললাম,- আজ এইটুকু থাক
- হায়! হায়! আমি শুধু বকবক করলাম, আপনি তো কিছুই বললেন না...
বললাম, - আজকের শুরুটা কেন আজই শেষ করতে চাইছো, সুর্য উদয়ের সাথে নতুন দিনের সূচনা....ডাকলেই পাবে.....
-হুম, ডাকলে আসবেন তো, পম্পা বলল
- বললাম - " একবার ডাক দিয়ে দেখো আমি কতটা কাঙাল, কত অভাব অনটন আজন্ম ভেতরে আমার "।
- পম্পা হাসল, হাত নেড়ে বিদায় জানালাম।
সেই থেকেই যোগাযোগ আর একপথে চলার রসায়ন শুরু।
মেয়েটা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসতো। সব কাজে নাছোড়বান্দা - কি এক মায়াময়তায় জড়িয়ে রাখতো আমাকে সেই ভালো বলতে পারবে। লেখাপড়া শেষ করে যখন আর আগের মতো বের হতে পারতোনা তখন বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতো আর নিত্য নতুন প্ল্যাকার্ড নিয়ে আমাকে শুভেচ্ছা জানাতো। একদিন দেখতে না পেলে কি যে কান্নাকাটি করতো বলাই মুশকিল। একদিন কোনও জায়গা থেকে ভোর রাতে এসেছি, তখনই সে আমাকে দেখবে। কি আর করা বাধ্য ছেলের মতো দেখা দিয়ে আসলাম। না গেলে হয়তো মারাই যেতো। বলতো - তোমার ভালোবাসাহীন পম্পা বদ্ধ উন্মাদ।
সবাইকে নিয়েই পম্পাকে ঘরে তুললাম। পম্পা আর আমি আমাদের কাঙ্খিত সোপানে। বদলে যাওয়া পম্পাকে আবার দেখলাম। প্রথম রাতে ম্রিয়মাণ, চুপচাপ ছিল সে। একটি কথা ও বলেনি... আমার হাতে একটি কাগজের টুকরোয় লিখে দিয়েছিল "ভুলের পাহাড়ে থাকি যদি, ভুলে যেও না- চলে যেও না "। হাসলাম আমি,
পম্পার পাগলামো বেড়েই চলল, সে আমায় ছাড়া থাকতে পারেনা, অফিস কামাই করতে বলে - সে চায় আমি থাকি তার চারিপাশ, জড়িয়ে ধরি, চুমু এঁকে দিই ঠোঁটে, গলায়, কপালে। রাতে ঘুমালে ওকে আমার হাত ধরতে হয়, শরীরে শরীর লাগিয়ে ওর দিকে মুখ করে ঘুমাতে হয়। অফিসে যাবার সময় সে কি কান্না - যদিও সন্ধ্যার আগেই আমি বাসায় চলে আসি তবু ও তার কান্নায় মনে হবে আমি যেন দূর বনবাসে যাত্রা করছি। প্রতিদিন এ আয়োজন দেখতে ভালোই লাগতো আমার। ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করবে, ছবি শেয়ার করবে, সারাটা দিন আমার জামাকাপড় গায়ে দিয়ে ঘুরেবেড়াবে এতে নাকি আমিহীন আমিই তাকে জড়িয়ে থাকি। এসবে পাগল বলতাম তাকে - বলত, আমি কে আমি নিজেই জানিনা, তুমিহীন এই পম্পা বদ্ধ উন্মাদ।
শ্বেতার জন্ম হলো, মায়ের মতোই হয়েছে। চারদিনেই বাবাকে ছাড়া সে আর কিছুই বুঝেনা। পম্পার বদলে যাওয়া আরেক রূপ আমাকে দেখতে প্রস্তুত হতে হলো - সেই পম্পার আমাকে নিয়ে আর কোন ভাবনা নেই, যেন আমি এখন পরগাছা। মেয়েকে নিয়ে তার সকল আয়োজন, উৎসব। অফিসে যাওয়া আসায় আগের সেই দৃশ্যমান পম্পার অস্তিত্ব যেন বড়ই বেমানান। বহিঃপ্রকাশ ছিল আরো কঠোর। তাকে আর আগের মতো পাওয়া যায়না। মেয়েই যেন সব, আমায় নিয়ে তার কোন উদ্ধেগ, উৎকণ্ঠা, চাওয়া পাওয়ার কোন মূল্য নেই বললেই চলে। মেয়ে আমার এত আদর সোহাগে বাবাকে ভোলেনি, বাবা আসলেই তার চাই চাই। এসব দেখে পম্পা মাঝে মাঝে বলত শ্বেতাকে তুমি কখনও আমার কাছ থেকে আলাদা করতে যেও না। শ্বেতা ছাড়া এই পম্পা বদ্ধ উন্মাদ।
ব্যাগ গুলো গুছিয়ে নিয়েছি, অফিসের কাজে বিদেশ সফর আজ শেষ হবে। একটু পরেই আমি চলে যাবো আমার জন্য প্রতিদিন অপেক্ষায় প্রহর গোনা, কাঁদতে থাকা, পাগলামি করতে থাকা আমার পম্পার কাছে। যে বলতো যার আমাকে ছাড়া একটি ক্ষণও বেঁচে থাকা অসম্ভব। সাথে আমার মেয়ে, আমার সব স্বপ্ন, আমার স্বর্গ.....
যে বলে বাবুই, তুমি আমাকে আর আদর করোনা, পচা।
শ্বেতা ফোন করেছিল জানতে চায় কখন আসছি, মা বলেছে বাবুই আসবে... জানো বাবা , মা একটানা আমার সাথে কথা বলছেনা - বলছে বাবুই আসলে নাকি কথা বলবে...
দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, পম্পা নয় আমি চাই শ্বেতাই দরজা খুলুক - পম্পাই দরজা খুলেছে।
দরজা খুলে বড় একটা প্ল্যাকার্ড ঠাঙ্গিয়ে রেখেছে - আমার বরাবর
"তুমি কাকে চাও, পম্পা না শ্বেতা "
আমি বললাম " পম্পা আর শ্বেতা ছাড়া এই আমি বদ্ধ উন্মাদ" ।

