STORYMIRROR

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Tragedy Classics

4  

Shyamasree (শ্যামশ্রী)

Tragedy Classics

একটি মেয়ে.. (পর্ব-নয়)

একটি মেয়ে.. (পর্ব-নয়)

6 mins
244

একটি মেয়ে...

চঞ্চলের মুখের দিকে তাকিয়ে সুবলা দেবী মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে পারলেন না, জিজ্ঞেস করলেন "কি হয়েছে? শরীর খারাপ লাগছে বুঝি?"

চঞ্চল মাথা দুলিয়ে না বললো।

" তবে?"

চঞ্চল ধরা গলায় বললো " মাসিমা খেয়া দেবী কি আমাকে এখনো ক্ষমা করেন নি?"

" কে বললো তোমাকে? ও ওমন মেয়ে না যে রাগ মনে রাখবে..,তাছাড়া "

" কি তাছাড়া? "

" কিছু না, তা তোমার এ কথা মনে হলো কেন?"

" আমি কত করে খেয়া দেবীকে ডাকলাম, উনি না শুনে চলে গেলেন।"

" নিশ্চয়ই শুনতে পারেনি.."

" হতেই পারে না,আমি এতো কাছে থেকে ডাকলাম।"

এমন সময় হরকিশোরবাবু ঘর থেকে বাইরে আসছিলেন, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন " আমার খেয়া মা চাইলেও যে শুনতে পারবে না।"

সুবলা দেবী আর্তনাদ করে "দাদা।" বলে মুখে আঁচল গুজলেন।

চঞ্চল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো।

হরকিশোর বাবু আবারও বললেন "তুমি বুঝি বুঝতে পারোনি না? খেয়া মা কথা বলতেও পারেনা, শুনতেও পারেনা জন্ম থেকেই।"

" কি? কি বলছেন কাকাবাবু। "

" হ্যাঁ ঠিকই বলেছি, ওর একমাত্র সঙ্গী ছিলো ওর দিদি কেয়া। ওর দিদিকে হারিয়ে কেমন যেন হয়ে যায়।"

সুবলা দেবী বললেন " দাদা ওসব কথা থাক।"

" না রে আমায় বলতে দে।"

তারপর চঞ্চলের দিকে তাকিয়ে বললেন, "চল গিয়ে ঘরে বসে কথা বলি।"

চঞ্চল যন্ত্র চালিত পুতুলের মতো ঘরে এলো। এতোক্ষণ পরে সে বুঝতে পারছে কাকিমা যে কেয়া বলেছিল,সেটা কেয়াই, খেয়াকে ভুল করে,কেয়া বলেনি। কেয়া উনার বড় সন্তান।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তিনি বলতে শুরু করলেন। " আমার দুই কন্যা ছিল, বড়জন কেয়া, আর ছোটটি খেয়া। বড় মেয়ের প্রায় বছর ছয়েক পরে আমার খেয়া হয়, কেয়া ভাই বোনের জন্য খুব বায়না করত,কিন্তু তোমার কাকিমার শারীরিক অবস্থার জন্য সাহস পাচ্ছিলাম না, কেয়া মা হতে গিয়েই যা অবস্থা হয়েছিল ওর, ডাক্তার তো বলেই দিয়েছিল যে কোনো একজনকে বাঁচাতে পারবেন তিনি,তাই দ্বিতীয় সন্তানের কথা আমরা ভুল করেও ভাবতে পারিনি। কিন্তু কেয়া তার জন্মদিনে উপহার হিসেবে যখন একটা ভাই কিংবা বোনের আবদার করে,ওর মা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেনি।তখন আমার ঝারখন্ডের ওদিকে থাকতাম। ভালো পদে চাকুরির সুবাদে ভালোর চলছিল।এ যে সুবলাকে দেখছো, এ আমার মায়ের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ার মেয়ে, ছেলেবেলায় ওর হাতে ফোঁটা নিয়েছি মামা বাড়ি গেলে।আমরা যখন প্রথম বাবা-মা হবো, তখন আমার মা কেয়ার মাকে দেখভালের জন্য ওকে আমাদের সঙ্গে থাকতে পাঠায়, তার কিছু দিন আগে এ অভাগী ওর স্বামীকে হারিয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে ও এই বাড়ির অভেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠলো, ওকে ছাড়া আমার স্ত্রীর চলে না।তারপর কেয়া হলো, কেয়ার সবকিছুতেই পিসিকে চাই। আমারো খুব ভালো লাগতো কারণ আমরা নিজেরা পাঁচ ভাই, আমাদের নিজের কোনো বোন বা দিদি ছিলো না। তারপর যখন ওর মা কেয়াকে নতুন ভাই কিংবা বোনের ইচ্ছে পূর্ণ করবে বললো, তখন এই সুবলা আরও সংসারটাকে নিজের কাঁধে তুলে নিলো। কেয়ার মাকে রান্না ঘরে পর্যন্ত যেতে দিতোনা। যাইহোক হলো আমাদের খেয়া, সবাই খুশী, ওর জন্মের পরে মায়ের তিনমাস সম্পূর্ণ বিশ্রাম ছিল। প্রথমে সব ঠিক ছিল, কিছুদিন পরে সবাই বুঝতে পারি খেয়ার সমস্যাটা, কিন্তু আমার ওতোটুকু মেয়ে কেয়া কি বললো জানো 'বাবা কি হয়েছে তাতে? আমার বোন তো চলতে পারে সব কাজ নিজে করতে সমর্থ, খালি কথা বলতে পারেনা, সেটা কিন্তু ভুল। ওর সব কথা তো আমরা বুঝতে পারি। আদতে ও সবার চেয়ে সুস্থ,কারণ ওকে যে ভালোবাসবে, সেই কেবলমাত্র ওর কথা বুঝতে পারবে।' আমি কিছু বলতে পারিনি সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম ওতোটুকু মেয়ের কথা শুনে। তারপর খেয়া একটু বড় হতে কেয়া বায়না ধরলো কলকাতায় যাওয়ার, আমি ওদের মা আর পিসিকে সাথে করে কলকাতায় থাকবার ব্যবস্থা করে দিলাম।কেয়া তখন ফাইভ কি সিক্সে পড়তো। তখনও জানতাম না কেয়ার কলকাতায় জেদ করে আসার ও খোঁজ নিয়েছিল কোথা থেকে কে জানে, কলকাতার রাজাবাজারের কাছে খেয়াদের মতো শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুল রয়েছে, সেখানেই ভর্তি করা হলো খেয়াকে।ভর্তি করেছিল মা-মেয়ে মিলে। আমাকে ফোনে খবরটা জানায়, আমি কতটা খুশী হয়েছিলাম বিশ্বাস করবে না বাবা। কেয়া চেষ্টা করে করে বোনকে পড়াতো। খুব ভালো কাটছিলো আমাদের জীবনটা। কেয়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক শেষ করেছে,আর বছর খানেক পরে খেয়ার মাধ্যমিক, এদিকে আমার শেষ জীবনে এই শুকনায় পোস্টিং হলো। কেয়া মা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে মাস্টার্স শেষ করবে ভাবলো, কিন্তু বোনের পরীক্ষার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না।শেষে ঠিক হলো এখানে খেয়া আমি থাকবো, কাজের লোক যথেষ্ট রয়েছে। পরেরবার পরীক্ষা শেষে সবাই এখানে চলে আসবে। তাই হলো, কেয়া অবশ্য বারবার বোনের কাছে ছুটে চলে যেতো। ক্লাস টেনে তেমন ক্লাস হয়না,বিশেষত তিন চারমাস। সেসময় সবাই মিলে কোয়াটারে এসেছিলো। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়টা কেয়া বোনকে কাছ ছাড়া করেনি। তারপর উচ্চমাধ্যমিক এখানকার একটা স্কুলে বলে কয়ে ভর্তি করানো হয় খেয়াকে, কেয়া বোনের পড়াশোনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আগেই তুলে নিয়েছিল। এখন আরও বোনকে সময় দিতে শুরু করলো, কারণ আগে খেয়া ওর মতো শিক্ষার্থীদের সাথে লেখাপড়া করত। কিন্তু এখানে সবার সাথে বসে লেখাপড়া করা, সহজ ব্যপার না। তবুও খেয়া খুব ভালো ফল করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করলো, কেয়া তখন স্কুলের চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে,যাতে বোনকে নিজে পড়াতে পারে তাই ইতিহাস অনার্স নিয়ে ভর্তি করলো ওকে। খেয়ার গ্রাজুয়েশন পাশ করার আগেই সরকারি স্কুলে শিক্ষিকার চাকরি পেয়ে যায় আমার কেয়া। এই জায়গাটা সবার ভালোলেগে গিয়েছিল, তাই এখানে এই বাংলো ধরনের বাড়িটা বানিয়েছি ততদিনে। এমন করে বেশ কাটছিলো আমাদের। মাঝে মাঝে সবাই মিলে ঘুরতেও যেতাম।এমনই একদিন বাড়িতে কেয়ার একজন কলিগ এলো,কথায় কথায় জানালো ওর একজন পরিচিত এখানে একটা কাজ পেয়েছে। যদি একটা ঘর ওকে দেয়া হয়,বেশিদিনের ব্যপার না। মাত্র মাস তিনেকের বিষয়। সুবলা আর আমার স্ত্রী রাজি হলোনা, অকারণে কোনো পুরুষকে বাড়িতে রাখতে। শেষে কেয়াকে ওর সহকর্মীটা এমন করে ধরে বসলো,রাজি হতে বাধ্য হলাম। যে আসলো তাকে দেখে সুবলা বেঁকে বসলো আরও। কারণ ছেলেটার বয়স বছর পয়ত্রিশের মধ্যে হবে। আর আমরা সবাই তখন কেয়ার বিয়ে নিয়ে মনে মনে পরিকল্পনা নিচ্ছি।যাইহোক মাত্র তিনমাসের কথা ভেবে নিমরাজি হলো সবাই।"

এরপর একটু দম নিয়ে, একটু জল খেলেন। সুবলা দেবী এতোক্ষণ চুপ করেই বসেছিলেন। তিনি এবার বলতে শুরু করলেন, " দাদা যতই বলুক আমার মনটা কিছুতেই মানছিল না। কিন্তু কেয়া মায়ের কথা কোনো দিনও ফেলতে পারিনি। আমি দাদার নিজের বোন না হওয়া সত্ত্বেও দাদা-বৌদিদি আমাকে নিজের বলেই মেনেছেন সদা। আর কেয়া আর খেয়া আমার প্রাণ ভোমরা, ওদেরকে আমি যে জন্মের আগে থেকে চিনি। ওরাই আমার মতো বিধবাকে মাতৃত্বের সুখে ভরিয়ে দিয়েছে।যে ছেলেটা এখানে এসেছিল নাম বলেছিল সাহেব সরকার।কি একটা ব্যবসা করে, বেশ ভদ্রসভ্য। নিজের মতো কাজ করে,আর মাসিক টাকাটাও ঠিক সময়ে দিয়ে দেয়। মাঝে মাঝে সকালে দাদার সাথে চা খেয়ে যায়। আমার ভয়টা কেটে যেতে থাকে। চলে যাওয়ার কথা মাস তিনেক পরে,সেটা মাস ছয়েকে দাঁড়ায়। একদিন দেখি কেয়া মা খেতে খেতে উঠে চলে যায়, বমি করতে থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে অ্যাসিডিটি হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করে নিলেও বৌদিদি বিশ্বাস করতে পারেনা। সেদিন আর কেয়া স্কুলে যেতে পারে না,রাতে বেলা একই পরিস্থিতি দেখা দেয়। এবারে বৌদি কেয়া টানতে টানতে নিয়ে যায় নিজের ঘরে, মা-মেয়ের মাঝে কি কথা হয় আমরা জানিনা। মেয়ের হাত ধরে বাইরে বেড়িয়ে এসে জানায় কেয়া নাকি গর্ভবতী। আমরা সবাই আকাশ থেকে পড়ি, মাটিটা দুলে ওঠে যেন। আমার মনে এমন একটা সন্দেহ হয়েছিল বটে, দাদা নিজেকে সংযত রাখতে পারে না, কেয়া মায়ের গালে সপাটে চড় কষায়। এই প্রথম মেয়ের গায়ে হাত তুলেছিলেন তিনি। অনেক কষ্ট করেও যখন জানা যায়না ওর সন্তানের পিতা কে? তখন খেয়াকে টেনে এনে ওর সামনে দাঁড় করিয়ে কেয়ার একটা হাত ওর মাথায় রাখতেই, কেয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে, বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে ' সাহেব আমাদের বাড়ির পেয়িং গেস্ট হলো আমার এই সন্তানের পিতা।' সে ঘরেই ছিল ওকে ডাকা হলো ঘরে। সে প্রথমে কিছুতেই মানবে না, শেষে বলে 'আমি রাজি বিয়ে করতে, তবে বাড়ি যাচ্ছি। এসে যা করার করবো।' চলে গেল বাড়ি। কিছুতেই আসার নাম নেই, কেয়াকে স্কুলে যেতে দেওয়া হচ্ছেনা অসুস্থতার কথা বলে। যে সহকর্মী সাহেবকে এই বাড়িতে জোর করে রেখে গিয়েছিল, তাকে জিজ্ঞেস করে সদুত্তর পাওয়া গেল না, না পাওয়া গেল প্রকৃত। কেয়ার ভবিষ্যত নিয়ে আমরা তখন অথৈজলে।"

চলবে..


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy