এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
দশম অধ্যায়
কোণা নদীর পাড় বরাবর জঙ্গল । শাল, সেগুন, মহুয়া আর পলাশ - প্রধানত এই চার রকমের গাছে পরিপূর্ণ। এখানে জঙ্গলের ঘনত্ব এত বেশী যে বুনো শুয়োর তো আছেই হয়তো হায়েনারাও ওৎ পেতে থাকে ।
মেথিলাল যে দিকটায় দৌড়চ্ছিল সেখানে নদীর চর ঘিরে শ্মশান । অঘোরী সাধুদের উপাসনা স্থল । শোনা যায় এই সব সাধু গ্রামে গঞ্জে সিভিল ড্রেসে গিয়ে আদিবাসী শিশুদের চুরি করে আনে এবং শ্মশানে তাদের বলি দিয়ে মাতৃসাধনা করে ।
সতীশ কুমার, তিরলোচন , শ্যামল, আর অরুণ - এরা প্রাণপণ চেষ্টা করে মেথিলালের দিক পরিবর্তন করাতে ; যাতে শ্মশানের দিকে না গিয়ে যেন জঙ্গলের দিকে যায় ।
কিন্তু বিফল হয়ে থমকে দাঁড়ায়। আর যাই হোক শ্মশানে যেতে তারা নারাজ। কিংস্টন সাহেব ছুটকিকে ধরে থামিয়ে দিতে চেষ্টা করেন । ছুটকি হাত ফস্কে পালায় । তার প্রেমিক দেবল যে মুক্তি চাইছে !
কালীচরণ মেয়েকে বাধা দিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে - বেটি ! উদিকে যাইস না । আগুরী সাধুরা পেইলে তোকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে।
ছুটকি ধরা পড়ে হাত পা ছুঁড়তে থাকে । যাবেই সে । তার দেবল যে মেথিলালকে ঘিরে রয়েছে ! মেথিলাল যদি পড়ে মরে যায় ! তখন ?
কিংস্টন সাহেব এগিয়ে এসে বলেন - কোন ভয় নেই চুটকি। মেথিলালের কিছুই হবে না । তবে মুশকিল কি জানো; দেবলের একটা জীবন্ত আশ্রয় চাই, তা সে মানুষ হোক বা কোন জীবজন্তু অধবা কোন বড় ঝোপওয়ালা গাছ । পাথরে তো ঢুকতে পারবে না !
ছুটকি কেঁদে কেঁদে বলে - দেবল আমার ছিল, আছে থাইকবেক। তুরা আমাকে ছেইড়ে দে । আমি লিব নিজের শরীরে দেবলের আত্মা ।
চমকে ওঠে কালীচরণ । - আর তুর লাচ ? লাচের কি হবেক? সায়েব তুকে কত কইরে বুজাইচে ।
ছুটকি বলল - আমার কিছু চাই না । শুধু দেবলের কথা মনে কইরে পড়্যে থাইকব।
কিংস্টন সাহেব বললেন - চুটকি! লাভ, আই মিন ভালবাসা একতরফা হয় না। আমি মেনে নিচ্ছি তুই দেবলকে ভালবাসতে ;; কিন্তু দেবল - নো , নেভার ও তোমাকে ভালবাসে । তা হলে তো তোর জীবনটা অন্য দিকে গড়িয়ে যেত !
কালীচরণ ফুট কেটে বলে - হোটেলের চাকর ! তাই ত' অমন কইরত !
কথাগুলো শুনতে পায় মেথিলালকে আশ্রয় করে থাকা দেবল । শ্মশানের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাগে গোঙাতে থাকে ও । মেথিলাল নিমেষে এক হিংস্র জানোয়ারের মত হয়ে ওঠে । সবেগে কালীচরণের দিকে ধেয়ে আসে ।
দেখতে পেয়ে কিংস্টন সাহেব কালীচরণের পাছায় সজোরে এক লাথ মেরে পাঁচ হাত দূরে ছুঁড়ে দেন । মেথিলাল কালীচরণকে পাশ কাটিয়ে জঙ্গলের দিকে রওনা দেয় ।
সতীশরা এতক্ষণে একটা স্বস্তি পায় । শ্মশানের চেয়ে অনেক নিরাপদ জঙ্গল । থাক না জানোয়ার ; মানুষ বা ভুত তো নেই !
হারেরেরে করে ওরা মেথিলালকে তাড়িয়ে নিয়ে যায় । কিন্তু দূরত্ব রেখে । একসময় মেথি ধনিয়ার মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যায় । পিছুপিছু সাহেবরা কয়েকজন। মিঃ পালও যেন এবার মজা পেয়েছেন । দেবলের অন্ত আর স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
জঙ্গলের ঘনত্ব যত বাড়ে মেথিলাল তত গাছে ঠোক্কর খেতে থাকে । এতে তার মনে জেদ বেড়ে যায়। আরও জোরে, আরও জোরে এঁকেবেঁকে দৌড়তে গিয়ে একটা ঝাড়ওয়ালা শ্যাওড়া গাছে বিশাল ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায় ।
গোরা সাহেবের দলবল খুঁজতে খুঁজতে তাকে নীচে পড়ে থাকতে দেখে । গোরা সাহেব গলায় ঝোলানো ক্রুশ মেথিলালকে ছুঁইয়ে দিতেই সে জ্ঞান ফিরে পায় । বুঝতে পারে সে কোন জঙ্গলে এসে পড়েছে । সাহেবদের দেখে ভাবে ডাকাত । পায়ে পড়ে কাঁদতে থাকে ।
- মুঝে মত মারো । হামার পাশ কুছ ভী নেহি হ্যায় সির্ফ য়ে বোতল ছোড়কে ।
বলে বোতলের খোঁজ করে । সাহেব তাকে অভয় দিলে উঠে দাঁড়ায়।
তারপর সেখানে কি করে এল , জিজ্ঞেস করে।
সাহেব বলেন - যতজন এখানে এসেছ; সবাই আমাকে ছুঁয়ে থাকো। নইলে দেবল আরও কারো কাঁধে চেপে বসবে । আমার কাছে ক্রুশ আছে, পবিত্র জল আছে। আমাকে ধরে থাকলে সে আর কাউকে কিছু করতে পারবে না।
নির্দেশ মত সকলে সাহেবকে ধরে কোনমতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল ।
সাহেব বললেন - আমরা পরিচিত পথে এসে গেছি। এবার যে যার মত হাঁটতে পারো। তবে দলছুট হয়ো না।
( ক্রমশ )
