এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
দ্বাবিংশ অধ্যায় **
লাহিড়ী মশাইয়ের বাড়িতে এখন পোষ্যের অভাব নেই । পাল বাবু, কালীচরণ , ছুটকি এবং সর্বোপরি গুণীন ; যিনি কিংস্টন সাহেবের বুজরুকি তথা মায়াময় ক্ষমতা খণ্ডন করতে এসেছেন লাহিড়ী মশাইয়ের অনুরোধে ।
যদিও এই অনুরোধ তিনি প্রত্যক্ষভাবে করেননি ; পৈতুণ্ডীর মাধ্যমে জোগাড় করেছেন । অতএব পৈতুণ্ডী মশাইও এখন তাঁর একজন পোষ্য হিসাবে প্রায়শই এসে থাকেন ।
গুণীনের যাতে কোন অসুবিধা না হয় ; সেদিকে বিশেষ নজর দিতে ছুটকিকে এবং মিঃ পালকে নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন। গুণীনের এক বদ নেশা আছে । শীতকালে খেজুরের রস ( স্থানীয় ভাষায় যার নাম ' তাড়ি ' ) পান করতে তিনি ভীষণ পছন্দ করেন । সেই রস জোগাড় করতে তিনি কালীচরণকে বলে রেখেছেন ।
কালীচরণ প্রতিদিন ভোরবেলায় হাজির হয় মাঠে মাঠে আর খেজুরের রস নিয়ে আসে । নিজেও আকন্ঠ পান করে । রসের মধ্যে পড়ে থাকা বোলতা ভীমরুলের মৃতদেহ একটা একটা করে বেছে তবে বাড়ি আনে এবং শুধু তাই নয় ; পরিষ্কার কাপড়ের টুকরো দিয়ে তা ছেঁকে নিয়ে এক কি দু' গেলাস তাড়ি গুণীনকে দেয় ।
গুণীন খুশি হন । আর চকখড়ির শ্রাদ্ধ করে নানা রকমের গল্প ফাঁদেন । এতে লাহিড়ী মশাইয়ের বিশ্বাস অর্জন করার মত রসদ পেয়ে যান । এখানে তিনি সুখেই আছেন । তথাপি তাঁর মনে শান্তি নেই ।
তার একমাত্র কারণ ছুটকি। সায়া ব্লাউজহীন একটা শাড়ি কোনমতে গায়ে জড়িয়ে কাজে ( পড়ুন গুণীনের রান্নার কাজে ) লেগে যায় । তাদেরও আর অন্নচিন্তা বা থাকার জায়গার অভাব নেই । ছুটকির যত অস্বস্তি গুণীনকে নিয়ে । সব ভালো তার; শুধু চাউনীটা যেন কেমন ।
যখন পাশ দিয়ে পেরিয়ে যায় গুণীনের অস্বাভাবিক দু'টো চোখ তাকে ভয় ধরিয়ে দেয় । একমুখ গোঁফ দাড়ি; চুলগুলো উস্কোখুস্কো; দু'দশটা যার পাক ধরেছে - সে যখন তার শাড়ির ভিতর দিয়ে নজর পাঠায় মনে হয় যেন কিছু বলতে চাইছে ।
একবার বলেই দিয়েছিল - তুই অমন ফেলফেলাইঁয়ে চাইস কেনে বল তো ? আমার বুঝি খারাপ লাইগে না ?
গুণীন চুপ করে থাকেন কিন্তু মিটিমিটি হেসে যান । দাঁত বের করা হাসি নয় ; এ যেন লালসার লাভা মাখানো বিষাক্ত হাসি । গুণীনের ভেতর কি চলছে ছুটকি জানে না। নিজেকে যথাসম্ভব চাদর মুড়ে এখন শীতকাল বলে শরীরটা আড়াল করে রাখে ।
কালীচরণের সেদিকে হুঁশ নেই। ভোরবেলায় তাড়ি আর রাতে হাড়িয়া ( দেশী মদ ) খেয়ে পড়ে থাকতেই তার বেশী ভালো লাগে ।
লাহিড়ী মশাই বলেন - মেয়েটার বিয়ে দিবি না কালী ?
কালীচরণ লাহিড়ীকে তত্ত্বকথা শোনায় - জনম মিত্যু বিয়া, তিন বিধাতা নিয়া । তুরাই তো বলিস বাবু । পাত্তর পাইছিলম : হাতে পেইয়েও গলা দাবায়ে মাইরে দিলম। সইছিল না গো উয়ার কাজগুলান । বিয়ার কথা পাড়লেই বইলত আগে লিজেকে বাগাই লি; ফূত্তিটুত্তি করি - তবে তো !
সহ্য হয়নি কালীর । একদিন অগোছালো দশায় ওদের দেখতে পেয়ে রাগে শরীর জ্বলে গেছল । আর তখনই -।
পুলিশ এসেছিল কিন্তু সাহেব --
কালীর মনে পড়ে গেল । লাহিড়ী মশাইকে বলল - অ বাবু !
এই মদ্দাটাও তো তাড়ি গিলে হে - ওই সাহেবটোর মতন !
লাহিড়ী মশাই পাত্তা দেন না । তাড়ি এ দেশে অনেকেই পছন্দ করে ।
- কি জানি বাবু ! কুথা থেক্যে যে কি হয় !
লাহিড়ী মশাই রেগে যান ।
- আর তুই নিজে কি ? তুইও তো তাড়ি মদ গিলিস !
- সিটো তো আমাদের ধম্ম বাবু। নীচ জাইত । কত কি খাত্যে হয় ।
গুণীনের এত কদর দেখে পাল বাবুরও গা জ্বালা করে যায় । চুপিচুপি কালীকে বলেন - বুঝেছ কালীচরণ ! ছুটকি বোধ হয় গুণীনের নজরে পড়েছে ।
- ক্যামনে বুইঝলে গ !
- দেখ না , ছুটকি যত বার আসা যাওয়া করে গুণীন ততবার আঁকিবুঁকি ছেড়ে ওকেই দেখে । গোরা সাহেবও এমনই ছিল ।
- সি তো দাঁত বেইর কইরে হাইসত গ । মাখামাখি ত দেখি লাই।
- আমি দেখেছি । কতবার, দিনের পর দিন ।
কালীচরণের গোঁসা হয় ।
- আমাকে বল নাই ত ?
- কি করে বলতাম বল ! সাহেব যে আমাকে বের করে দিত। ওই দেবলের ছায়া দেখেছি সাহেবের মধ্যে ।
লাহিড়ী মশাই এসে বসলেন ।
- কি হে গুণীন ! আর কত অন্ন ধ্বংস করবে ? কাজের কাজ তো কিছু হচ্ছে না !
গুণীন বললেন - আজ রাতো রাত কুছ করুঙ্গা । শোচিয়ে মত বাবুজী ।
লাহিড়ী মশাই বললেন - দেখি ! না হলে কালই কিন্তু তোমায় বিদেয় করে দেব - বলে রাখলাম ।
গুণীনের মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে এল । কিন্তু সমঝদার লোক কখনও ভুল করে বসে না । সেজন্য অন্তরের সমস্ত রোষ অন্তরেই রেখে দিলেন । প্রকাশ করলেন না ।
( ক্রমশ )
