এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
চতুর্দশ অধ্যায়
ছুটকি কালীচরণ এবং গোরা সাহেব তিনজন এসে লাহিড়ী মশাইয়ের বাড়িতে বাইরের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছেন । সাহেবের ভাড়া বাড়ি ছেড়ে দিতে বলেছেন বাড়ির মালিক। তিনি নাকি সোনা রূপোর দোকান দেবেন বলেছেন ।
বাধ্য হয়ে সাহেব এসেছেন লাহিড়ী মশাইয়ের কাছে । তাঁর তো বিশাল বাগান বাড়ি রয়েছে ; সে জায়গাটা যদি তাঁদের দেন বসবাসের জন্য । খবরটা নাকি মেথিলালই দিয়েছে তাঁকে ।
লাহিড়ী মশাই মন দিয়ে সাহেবের কথাগুলো শুনলেন । বললেন - সাতপুরুষের ভিটে ; ভাড়া দিলে আমাদের আভিজাত্য খর্ব হবে । লোকে মনে করবে টাকার আকাল হয়েছে আমার ।
সাহেব বললেন - সবই বুঝি স্যার । কিন্তু উপযুক্ত কোন বাসগৃহের সন্ধান না পেয়ে আপনার দ্বারস্থ হয়েছি । ভাড়া নিতে যদি আপত্তি থাকে তবে বিনা ভাড়াতেই দিন স্যার । আমার ইগোতে লাগবে না । ঈশ্বরের এহসান মনে করব ।
লাহিড়ী মশাই বললেন - ভাড়া না হয় নিলাম না ; তাতে তো লোকজনের কিছু আসে যায় না । ওদের মনে নানা প্রশ্ন জাগতে পারে । না না , সাহেব, সেটি হতে দেব না ।
সাহেব বললেন - তবে আর কি করি ! দেখি কোথাও সন্ধান পাই কি না ।
লাহিড়ী মশাই বললেন - তাই দেখুন । তবে আজকের রাতটা যদি থাকতে চান তো থেকে যেতে পারেন ।
সাহেব বললেন - তার দরকার নেই ; কাল বিকেলের আগে তো সে বাড়ি ছাড়ছি না ।
লাহিড়ী মশাই বললেন - কালী ও তার মেয়েকেও রেখেছেন দেখছি । পাঁচ কথা কানাকানি হবে । সেই ভালো আপনি অন্যত্র বন্দোবস্ত করে নিন । মেথিলালকে বলুন - ওর অনেক লোকের সাথে চেনাজানা আছে। ঠিক একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবে ।
সাহেব বিনীত ভাবে ধন্যবাদ জানিয়ে চলে গেলেন । পুনরায় ফিরে এসে বললেন - মিঃ নকসত্র পলকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলাম। দোভাষীর কাজ ছিল তো। এখন বেঙ্গলি, হিন্দি খুব ভালো বলতে পারি; বুঝতেও পারি; তাই--
লাহিড়ী মশাই বললেন - হুমম।
- একটা কথা জিজ্ঞেস করব স্যার ? সাহেব বললেন।
- একটা কেন , যতখুশি করুন ।
- মিঃ পালের সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে ?
বেমক্কা প্রশ্নে লাহিড়ী মশাইয়ের মত পোড় খাওয়া লোকও অবাক হলেন । কিন্তু একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে বললেন - সেদিনই তো জানলাম। আপনিই তো পরিচয় করিয়ে দিলেন।
- তার মানে আগে থেকে কোন পরিচয় ছিল না ?
লাহিড়ী মশাই উল্টে প্রশ্ন করলেন - এমন ভাবে বলছেন সাহেব যেন আমি আপনাকে কিছু গোপন করছি। তবে আজ সন্ধ্যায় পথে তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল । তিনিই বললেন যে তাঁর ছুটি হয়ে গেছে; রাতটা লজে কাটিয়ে সকালে দেশের বাড়ি ফিরে যাবেন আমি বললাম তবে আর কবে দেখা হবে না হবে ; আজ রাতটা আমার বাড়িতেই থেকে যান ।
সাহেব বললেন - হুঁ, অনুমান করেছি ।
- কি ভাবে ?
- আমি স্যার ঘ্রাণে বুঝে যাই । তাঁর গন্ধ নাকে আসছে।
লাহিড়ী মশাই ডাক দেন - পালবাবু ! একবারটি আসুন তো? সাহেব আপনাকে দেখতে চাইছেন।
ভয়ে ভয়ে পালবাবু সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্য্যন্ত জরীপ করে নিলেন মিঃ কিংস্টন সাহেব । বললেন - আপনাকে তো লজে ফিরতে বলেছিলাম; এখানে এলেন কেন ?
মিঃ পাল ভয় পেয়ে চুপ রইলেন। লাহিড়ী মশাই সিচুয়েশন চেঞ্জ করতে বললেন - আচ্ছা সাহেব, আপনি সন্ধ্যের সময় আমার দোকানে মেথিলালের সঙ্গে খুব গল্প,হাসাহাসি করছিলেন । মেথিলাল কি আপনার পূর্বপরিচিত ?
- আসলে স্যার রাতের খাবার নিতে আপনার দোকানে যাই তো ? পেমেন্ট তো মেথিলালই নেয় । সেই রেকে একটা চেনা জানা হয়ে গেছে । কিন্তু আপনি তো দোকানে যান না; তবে কি ভাবে বুঝলেন ?
লাহিড়ী মশাই হাসি হাসি মুখ করে বললেন - আপনি ঘ্রাণে বুঝে যান ; আমি দেখি দিব্যচোখে বুঝলেন সাহেব ?
মিঃ কিংস্টন বললেন - তাই তো দেখছি । তবু একটা খটকা লেগে যাচ্ছে । পালের যাতায়াতের পথ আপনার দোকানের পাশ দিয়েই; আবার হঠাৎ তাঁকে আপনার বাড়িতে দেখছি । হিসেবটা মিলে যাচ্ছে তো তাই ---
লাহিড়ী মশাই বললেন - সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে ওঁর সাথে দেখা হতেই নিয়ে এলাম বাড়িতে ।
- কিন্তু শিউপূজন তো অন্য কথা বলল ! আপনারা নাকি দোকানে গিয়েছিলেন ।
- আপনি ভুল করছেন সাহেব । এমন একজনের নাম বললেন যাকে আমি হাড়েহাড়ে জানি । বদমায়েশিতে তার জুড়ি নেই । এর কথা তাকে; তার কথা ওকে লাগিয়ে নিজে মজা উপভোগ করে; হয়তো বা দু'চার পয়সা কামিয়েও নেয় ।
সাহেব লাহিড়ী মশাইয়ের বুদ্ধিকে কুর্ণিশ না জানিয়ে পারলেন না ।
( ক্রমশ )
