এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
ঊনবিংশ অধ্যায়
মিঃ কিংস্টন কোডার্মায় ফিরে গেলেন । ওখানের এক জৈন মন্দিরে প্রবেশ করলেন । তীর্থঙ্করের মূর্তির পাদদেশে কিছুক্ষণ মৌন থেকে চোখ বুঁজে যেন ধ্যান করতে লাগলেন। এখানে তিনি ক্রীশ্চান নন একজন ভারতীয় হিন্দুর বেশে কিছুটা সময় কাটিয়ে বেরিয়ে এলেন ।
ঝলমল করছে রোদ । শীতের সকালে সাধারণত এই স্থানে মেঘলা মেঘলা রোদ থাকে ।
কোডার্মা স্টেশনে ট্রেন ধরে চললেন পারসনাথ । সেখানে নেমে একটা অটো নিয়ে হাজির হলেন লাহিড়ী মশাইয়ের ছোট মেয়ে বন্যার বাড়িতে।
পরিচয় দিলেন রামতনু লাহিড়ীর কর্মচারী হিসাবে । বন্যার সন্দেহ হবার কথা নয় । তার বাবা শ্রীযুক্ত রামতনু লাহিড়ী হাজারিবাগের বিশিষ্ট বাঙালি। কিংস্টন এখানে তাঁর নাম বললেন গৌরাঙ্গ মুখোপাধ্যায় । বাঙালি ব্রাহ্মণ । নিবাস পুরুলিয়া জেলার ঝালদার নিকটবর্তী কাঁটাপাহাড়ী গ্রামে।
জীবিকার খোঁজে নাকি তাঁর হাজারিবাগে গমন এবং প্রথম দর্শনেই লাহিড়ী বাবুর পছন্দের লোক হয়ে যাওয়ায় দায়িত্ব দিয়েছেন এখানে বন্যাদের রাধাগোবিন্দ জিউয়ের সেবাইত ভার দিয়ে ।
সঙ্গে একটা চিরকুটও দিয়েছেন প্রমাণপত্র হিসাবে । মিঃ কিংস্টন চিরকুটটা বন্যার হাতে তুলে দিলেন । স্বচ্ছ বাংলায় লেখা পত্র ।
কল্যাণীয়াসু মা,
পত্রবাহক অতি সদাশয় এবং মহৎ ব্রাহ্মণ সন্তান । কর্মসন্ধান হেতু আমার সকাশে আসিয়াছেন । কিন্তু আমার এই মুহুর্তে কোন কর্মচারী নিযুক্ত করিবার পদ খালি নাই । দরিদ্র ব্রাহ্মণ দেখিয়া অন্তরে পীড়াগ্রস্ত হইয়াছি । সেই হেতু তোমাদিগের কথা মনে পড়িয়া গেল । এই ব্রাহ্মণকে তোমাদিগের রাধা গোবিন্দ জিউয়ের মন্দিরে সেবাইত রূপে রাখিলে তাঁহার মঙ্গল হয়; তোমাদিগেরও । তোমরা একজন ন্যায়নিষ্ঠ সেবাইতের সন্ধান করিতেছিলে । বাবা খগেন্দ্রনাথের সম্মতি লইয়া তোমরা এই পত্রবাহককে নিযুক্ত করিতে পার । আহ্লাদিত হইব । মঙ্গল হউক।
ইতি
আশীর্বাদক
শ্রীযুক্ত রামতনু লাহিড়ী, হাজারিবাগ ।
পত্র পেয়ে বন্যার মনে আনন্দ আর ধরে না । স্বামী খগেনন্দনাথ বাড়িতেই ছিলেন । তিনিও চিঠিখানা পড়লেন এবং তখন থেকেই কিংস্টন সাহেবকে মন্দিরের দায়িত্ব দিয়ে দিলেন ।
এখনকার মত সেই ষাট-বাষট্টি সালে বাড়ি বাড়ি ফোন ছিল না । চিঠি বা তার ছিল দূর-দূরান্তের সংবাদ নেবার সাধারণ মাধ্যম । খগেন্দ্রনাথ চিঠি দিয়ে শ্বশুর মশাইকে জানিয়ে দিলেন তাঁর পাঠানো ব্রাহ্মণকে তিনি মন্দিরের সেবাইত নিয়োগ করেছেন ।
কাকতালীয় ভাবে কিংস্টনের হাতের লেখা যাচাই হল না। বিষয়বস্তু যা আছে তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ কারোরই ছিল না । সাহেব কাম আদিবাসী সমাজের এক প্রজন্ম ঈশ্বরের ইচ্ছায় রাধা গোবিন্দের সেবার ভার নিলেন।
কিংস্টন সাহেব অতি ধূর্ত । তিনি জানেন তাঁর এই ছদ্মবেশ সাময়িক। কারণ বিশিষ্ট জনের অনেক চর অনুচর থাকে। এঁদের বা লাহিড়ী মশাইও তার ব্যতিক্রমী নন। অতএব যা করবার দু একদিনের মধ্যেই করে নিতে হবে । আয়েশে কাল কাটালে চলবে না ।
তিনি রাতের মধ্যেই সোনার মূ্র্তিসহ ঠাকুরের যাবতীয় গহনা, তৈজসপত্রাদি চুরি করে ভোরবেলাকার ট্রেন ধরে রওনা দিলেন আবার কোডার্মায় । লাহিড়ী মশাইয়ের কপাল ভালো যে তিনি প্রাণহানি বা সে রকম কোন আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেননি ।
পরদিন যখন রাধা গোবিন্দের ভোগ দিতে যাবে বন্যা ; দেখে মন্দিরের দরজা খোলা । সেবাইত নেই, বিগ্রহ নেই, মন্দির শুন্য করে সেবাইত পালিয়েছে - তখন বিশাল হৈচৈ পড়ে গেল পারসনাথে। থানা পুলিশ হল । কিন্তু ওই পর্য্যন্তই। খগেন বাবু বন্যাকে নিয়ে হাজির হলেন লাহিড়ী মশাইয়ের কাছে।
সব শুনলেন লাহিড়ী মশাই। এ যে ওই গোরা সাহেবের কীর্তি তা' জানতে বাকি রইল না । তিনি এবার মরীয়া হয়ে পড়লেন ।
ছুটকি, কালীচরণ এবং নক্ষত্র পালকে ডেকে বললেন - তোমরা তো খুব বড় বড় কথা বলেছিলে হে ! মিশন না কি যেন ! কিছু অগ্রগতি হয়েছে ? এদিকে তো গোরা সাহেব তো আমার আত্মীয় স্বজনদেরও ধরপাকড় করতে লেগেছ!
ছুটকি আহত হল । বলল - শুন বাবু ! আমরা হল্যাম গে ছোটলোক। মাথা গুলানও ছোট । তুরা তো পারিস বেবস্তা কইরতে ?
মিঃ পাল বললেন - স্যার, পুলিশের কাজ পুলিশ করুক। আমাদের অনুমতি দিন আমরা আমাদের মত করে বদমাশটাকে শায়েস্তা করি ।
লাহিড়ী মশাই বললেন - প্রতিটি পদক্ষেপে তো অনুমতির প্রয়োজন থাকে না । আর যদি অর্থের কথা বল ; এই নাও ব্ল্যাঙ্ক চেক। যত লাগে ভরে নিও।
বলে চেকে সাইন করে পালের হাতে তুলে দিলেন।
পাল বাবু চেক নিতে রাজী হলেন না । কিংস্টন যদি জানতে পারে ব্ল্যাঙ্ক চেক পেয়ে গেছি তো সবার প্রাণও যেতে পারে ।
কালীচরণ বলল - আমি আর ছুটকি ঝুমরিতিলাইয়া চললম। লুচ্চাটোকে ধরতি হব্যে । পলাই না যায় ।
লাহিড়ী মশাই তাদের ছেড়ে দিলেন । বললেন - তোদের থাকার জায়গাটাও তো পুড়িয়ে দিয়েছে । থাকবি কোথায় ?
- সি টো আমরাই ভেব্যে লিব। তুকে মাথা ঘামাত্যে হবেক লাই।
ছুটকি বলে উঠল ।
মিঃ পাল বললেন - মাথা ঠাণ্ডা রাখ কালী। একদম হঠকারিতা দেখানো যাবে না ।
তারপর লাহিড়ী মশাইকে বললেন - স্যার , আমরা আপনার বাড়ি ছেড়ে কোডার্মায় কোন ভাড়া বাড়িতে গিয়ে থাকি । সাহেব কিন্তু কোডার্মা থেকেই পারসনাথ গিয়েছে। আমার ধারণা ; অন্তত যতটুকু সাহেবকে আমি স্টাডি করেছি তাতে মনে হচ্ছে উনিও কোডার্মায় থাকবেন।
কারণ আপনাকে রাগিয়ে তাঁর পক্ষে হাজারিবাগে থাকা সম্ভব নয় । ঝুমরিতিলাইয়াতে ওঁকে অনেকেই চেনে জানে। আর তিনি রাঁচি যেতেই পারেন কিন্তু তিনি তা করবেন না।
লাহিড়ী মশাই বললেন - কেন করবে না ? ও তো ওখানের অফিস থেকেই এসেছে ।
- একদমই না স্যার । ওখানকার দায়িত্ব নিয়ে আসা অফিসারটিকে সরিয়ে তিনি নিজে ওই পদে আসীন হয়েছেন। বুঝতেই পারছেন তাঁর কালা যাদুর কলাকৌশল।
সুতরাং রাঁচি পুলিশও তাঁর সন্ধানে ওৎ পেতে আছে।
লাহিড়ী মশাই বললেন - বুদ্ধির ঘরে ধোঁয়া ঢুকেছে তা হলে ? ঠিক আছে, খরচাপাতির জন্য ভেবো না।
ওরা তিনজন বেরিয়ে পড়ল কোডার্মার পথে ভাড়া গাড়ি করে ।
( ক্রমশ )
