এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
সপ্তম অধ্যায়
মিঃ পাল অর্থাৎ যিনি দোভাষীর কাজ করেন ; তিনি তো গোরা সাহেবের আচরণে বিভ্রান্ত এবং ভীত হয়ে দৌড়ালেন রাস্তার অপর পার্শ্বে । সামনেই একটা চলন্ত বাসে উঠে পড়লেন । বাসে ভীড় ছিল না । জানালার দিকে সীট পেয়েও ছেড়ে দিলেন । পাশের সীটে এসে বসলেন।
একটা লম্বা শান্তির নি:শ্বাস নিয়ে জানালার ধারের ফাঁকা সীটটার দিকে চেয়ে রইলেন । নাকে সুন্দর এবং মিষ্টি একটা গন্ধ এসে লাগল । তাঁর মনে হল এই সেই আতর যা কিংস্টন সাহেব ব্যবহার করেন । তিনি ভাবলেন হতে পারে কেউ একই ব্র্যাণ্ডের আতর মেখে বাসে উঠেছেন ।
একটু পরেই তাঁর সে ভুল ভেঙে গেল । অন্য কোথাও থেকে নয় ; গন্ধ আসছে পাশের লোকটির গা থেকে । মুখ ফিরিয়ে দেখলেন - আরে ! এ তো কালীচরণ হাঁসদা । ছুটকির বাবা । পরিচয় দিতে যাবেন লোকটার কাছ থেকে গোঁ গোঁ আওয়াজ শুনতে পেলেন । যেমন কুকূরেরা প্রথম প্রথম করে; অবাঞ্ছিত কুকুরকে দেখলে ।
তিনি কথা বলার চেষ্টা করলেন । কালীচরণ পাগড়ি খুলে তাঁর দিকে চাইতেই মিঃ পালের আত্মারাম খাঁচা ছাড়ার মত হয়ে গেল । পাশে একটা মৃত মানুষের কায়া দেখে আতঙ্কে শিউরে উঠলেন । দেবল না ?
সীট ছেড়ে উঠে গিয়ে ড্রাইভারকে বললেন - ভাই! গাড়িটা একটু স্লো করে দেবেন ! এখানেই নেমে যাব তা"হলে !
ড্রাইভার বলল - দাদা ! এখন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলেছি। দেখছেন না , বাসের ভেতরটা অন্ধকার করে দেওয়া হয়েছে। চোর ডাকাতের পাল্লায় পড়লে কি হবে বলুন তো।
মিঃ পাল বললেন - নেক্সট স্টপেজ কত দূর ?
- বেশী দূর নয় । সেটাই তো টার্মিনাস মানে হাজারিবাগ।
কণ্ডাক্টরের সন্দেহ হল। কোন গুণ্ডা বদমাশ নয় তো ! বাস থামাবার অনুরোধ করল ! এবার যদি ড্রাইভারের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলে - বাস থামা !
মিঃ পালকে ধরে সীটে বসিয়ে দিল । বলল - এখানে বসুন স্যার । হাজারিবাগ এখনও আধ ঘন্টা দূরে । এবার যেখানে বসলেন তিনি সেখান থেকে দেবলকে দেখতে কোন অসুবিধা হয় না ।
মি: পাল চাইব কি চাইব না করেও যখন তার দিকে চেয়ে ফেললেন - দেখলেন দেবল নয় কালীচরণই ওখানে বসে আছে।
কালীচরণ হাত উঁচিয়ে ডাকল । অ বাবু ! ইখেনে আয়। দুটা কথা বলি । সেই রাঁচি থাক্যা মুখ বুইজে আছি। কথা বলার কেউ লাই - আয় আয় ।
যাদুর বশে মিঃ পাল তার পাশে গিয়ে বসল । না, এ তো কালীচরণই । আতরের গন্ধের বদলে এখন কেমন পাঁঠা ছাগলের মত বোঁটকা গন্ধ নাকে আসছে।
কালীচরণই প্রথম কথা বলল - অ বাবু, তুর সাথের গোরা সায়েবটি গেল কুথায় !
- সাহেব রাঁচি গেছেন । মিঃ পাল বলল।
- বইললেই হবেক । আমার ছুটকিকে না লিয়ে যাবেক কুথা?
- কেন ? ছুটকি কি ওনার বিয়ে করা বউ নাকি ?
- শ্লা ! আমার ছুটকির দিকে লজর দিলে চোখ গেইলে দিব না !
মিঃ পাল কাঁদবেন না কি হাসবেন বুঝে উঠতে পারলেন না । আবার আতরের গন্ধ পেতে লাগলেন । আবার কালীচরণের মুখের দিকে দেখলেন । নাহ্ এবার গন্ধ পেলেও পাশে বসা লোকটা কালীচরণই । জিজ্ঞেস করলেন - কি ব্যাপার কালী ? সেন্ট মেখে বেশ গন্ধ ছড়িয়েছ দেখছি । তা' ওটা কি সাহেব তোমার ছুটকিকে দিয়েছিল ।
আবার সেই গোঁ গোঁ শব্দ বের হতে থাকল কালীচরণের কাছ থেকে । মিঃ পাল কালীর মুখের উপর নিজের চোখ ফেলতেই দেখলেন - কালীচরণ নয়; দেবলই বসে আছে পাশে । উঠে পালাতে যাবেন দেবল ঝপ করে তাঁকে ধরে সীটে বসিয়ে দিল ।
বলল - শ্লা ! ভুড়ি ফাঁসিয়ে দেব না ! আমার ছুটকির নাম নিলে।
মিঃ পাল ' বাঁচাও বাঁচাও ' বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। ড্রাইভার ব্রেক কষে বাসের আলো জ্বালিয়ে দিলেন। হাজারিবাগ শহরে ঢুকছে বাস ।
মিঃ পাল দেখলেন কালীচরণ মুচকি মুচকি হাসছে।
- অ বাবুটো ! কুথায় গিছলি ?
মিঃ পাল কান্নিকাটি শুরু করে দিলেন। - হে রাম !
কালীচরণ অবাক। সায়েব সুবোরাও কাঁদে নাকি। বলল
- অ বাবু। তুর কুনো ভয় নাই । আমি আছি তুর সাথে। কেউ তুর ক্ষেতি করতি পারবেনি ।
মিঃ পালের এখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা । মনে মনে ভাবলেন তুই ছেড়ে গেলেই বাঁচি।
( ক্রমশ )
