এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
ঊনত্রিংশতি অধ্যায়
ছুটকির অদর্শণ জ্বালা সইতে না পেরে দেবলের ভীষণ কষ্ট হয় । অথচ এখন হাজারিবাগ যাওয়া তার পক্ষে একদম নিরাপদ নয় । এতদিনে নিশ্চয় পুলিশ লাহিড়ীর ঘরবাড়ি দোকান সব কড়া নজরে রেখেছে।
অথচ বারবার মন চাইছে ছুটকিকে পেতে । কি করছে ওরা লাহিড়ী মশাইয়ের বাড়িতে ? ওর বাবাটাই বা ঝুমরিতিলাইয়া ছেড়ে দিল কেন ? কিচ্ছু মনে পড়ছে না তার । সেই বা কেন কোডার্মা ছেড়ে এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে ।
নাহ্ এমনি করে তো থাকা যায় না । কোনা নদীর পাড়ের জঙ্গল ছেড়ে এগিয়ে এল শ্মশানঘাটের দিকে । শাল পলাশবন পিছনে রেখে এগিয়ে চলল জলের দিকে; যার আর এক নাম জীবন । নিঝুম বন ছেড়ে এগোতেও ভয়; পিছিয়ে যেতেও ভয় ।
ভয়ই যখন তার একমাত্র সঙ্গী ; একবার অঘোরী সাধুদের সঙ্গে মোলাকাত করলে হয় । কি এমন হবে ? বড় জোর ওরা বলি দেবে ।
কিংস্টন রূপী দেবল জোরে জোরে পা চালাতে থাকে এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই শ্মশানে এসে পড়ে । কিন্তু আজ কেউ শ্মশানে নেই ; সাধুরা সকলে চলে গেছে মকর সংক্রান্তির মেলায় গঙ্গাসাগরে । বাধ্য হয়ে শহরের অভিমুখে চলতে থাকে দেবল ।
এদিকে কালীচরণ রাত হয়ে গেলেও বাড়ি ফেরেনি দেখে ছুটকি কাউকে কিছু না বলে বাপকে খুঁজতে বেরোয় । শহরের উপকণ্ঠে দেখা হয়ে যায় কিংস্টন সাহেবের সঙ্গে ।
ছুটকি অবাক হয়; কিন্তু হতবাক নয় ।
- কিষাণ ভাইয়া না ?
ছুটকি আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ে। কিন্তু তা লাগে গিয়ে সোজা দেবলরূপী কিষাণের মাথায় ।
- কে কিষাণ ? না না নাৎ। আমি কিষাণ নই, মেথিলালও নই , আমি দেওলাল। আমার ছুটকির দেওলা ।
ছুটকি এসে দেওলাকে জড়িয়ে ধরে ।
- তুই যদি সত্যিই আমার দেওলা ; তবে তোর মুখটা কিষাণ ভাইয়ার মত কেনে ? তোর গায়ের রং সায়েবের মত কেনে ?
- আমি কিষাণ ভাইয়া নই, মেথিলাল ভাইয়াও না, আর সায়েব ? কোন সায়েবের কথা বলছিস - কে তুই ?
- আমি তুর ছুটকি রে দেওলা ! চিনতে পারিস লাই।
- ছুটকি ! আমার ছুটকি ।
বলে দেবলও জড়িয়ে ধরে তাকে । ছুটকি ওকে লাহিড়ী মশাইয়ের ঘরে নিয়ে যেতে চায় । কিন্তু দেবল রাজী হয় না। ছুটকি তখন বাড়িতে যা যা ঘটেছে বলতে থাকে । দেবলের মনে পড়ছে না কিছুই ।
ছুটকি বলে - লে চল ! উদিকে আবার বাপটো লাপাতা আছে।
দেবল কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। অথচ ছুটকিকে ছেড়েও দিতে পারছে না ।
ছুটকি একরকম টানতে টানতে ওকে নিয়ে যাচ্ছে । হঠাৎ দেবলের পরিবর্তন দেখা গেল । কিষাণ লালের রক্তচক্ষু বেয়ে নেমে এল রক্তের ধারা ।
ছুটকি দেখছে। দেখছে আর অবাক হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু সাহস হারায়নি । সে জানে এই লোকটা কিংস্টন নয়, কিষাণও নয় । সে তার দেওলা ।
কিষাণ লাহিড়ী বাড়ীর চৌকাঠ পেরোতেই স্বমূর্তি ধারণ করে । গর্জন করে হুমকি দিতে থাকে ।
সেই হুমকিকে ছুটকি ভয় পায় না । সে টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে যায় বাড়ির অন্দরমহলে । পুলিশ এসে ঘিরে ধরে। অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে এসে ছুটকি দেখে যাকে ধরে এনেছে সে তার বাপ ।
লাহিড়ী মশাই ছুটকিকে বলেন - ওকে এমন করে টেনে আনছিস কেন ? আজ আবার আকন্ঠ গিলেছে নাকি?
ছুটকি কিষাণের হাত না ছেড়েই বলে - অ পুলিশ ভাইয়া , আগে ইটোকে হাতকড়া পা-কড়া পরা । তারপর দেঠাচ্ছি মজা । শ্লা নাজেহাল কইরে মেইরেথে ।
লাহিড়ী মশাই , পাল বাবুরা চেঁচিয়ে উঠেন ।
- ভুল করছিস ছুটকি । চেয়ে দেখ ও তোর বাপ - কালী।
ছুটকি বলে - ইটোই কালী, ইটোই ধূলা, ইটোই ময়লা । এতক্ষণ দেওল ছিল, বিষাণ হল আর এখন আমার বাপের রূপ ধরে সবাইকে ধোঁকা দিছে।
পুলিশ ওকে গ্রেপ্তার করে একটা ফাঁকা ঘরে বন্দী করে রাখল ।
এবার আসরে নামল কালীচরণ ।
লাহিড়ী মশাইকৈ উদ্দেশ্য করে বলল - আগেই বইলেছিলম।
লাহিড়ী মশাই, পালবাবু এবং পৈতুণ্ডী মশাই আবার ভুত দেখলেন । তাড়াতাড়ি সেই ঘরের দিকে দৌড়লেন । পুলিশকে দিয়ে তালা খুলিয়ে দেখলেন সেখানেও কালী।
এবার দুজনকে মুখোমুখি করতেই আসল কালীচরণ ভয়ে সিঁটিয়ে গেল । আর কালীচরণরূপী কিষাণ হো হো করে হেসে উঠল ।
ছুটকি বলল - দুটাকেই বন্দী কইরে রাখ। সকালে যে বেঁইচে থাইকবে সেই আমার দেওলা পিচাশ।
( ক্রমশ )
