এ তুমি কেমন তুমি
এ তুমি কেমন তুমি
সপ্তদশ অধ্যায়
' মিঃ পাল ! মিঃ নকসত্র পাল ! আপ জরা বাহার আইয়েগা ?
হঠাৎ কিংস্টন সাহেবের কন্ঠস্বর শুনে পালবাবু তড়িঘড়ি নিজেকে লুকানোর জায়গা খুঁজতে লাগলেন । মেথিলাল দোকানে চলে গিয়েছে। কালীচরণ এবং ছুটকি লাহিড়ী মশাইয়ের বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করছে ।
পাল বাবু পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পথে নেমে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করলেন । একছুটে দেশবন্ধু মিষ্টান্ন ভান্ডারে পৌঁছে দেখেন সাহেব আর মেথিলালের মধ্যে কথা কাটাকাটি হচ্ছে ।
এবার ব্যাপারটা তাঁর কাছে পরিষ্কার হল ।
সাহেব বলছেন - শুনো মেথিলাল । তুমহারা জব ম্যায়নে ওয়াপস কিয়া - ম্যায়নে ! নেহি তো মিঃ লাহিরি তুমহে তো চুটকি মে হঠা দিয়া থা । অব ম্যায় জো বলুঙ্গা তুমকো শুননা তো পড়েগাহি ; বল্কি উসি মুতাবেক কাম ভি তামাম করনা পড়েগা ।
মেথিলাল ঢোক গিলছে আর বলছে - রহম করো সাব; স্যার জ্যায়সা ভলে আদমীকে সাথ ম্যায় কুছ বুরা নহি কর সকতা !
সাহেব পকেট থেকে একটা ছোট বোতল বের করে কিছুটা জল ছিটিয়ে দিলেন মেথিলালের গায়ে ও মাথায়। বললেন - ওহি জো আইনা দেখ রহা হো না; অব উসকো সামনে যাও ঔর বতাও কেয়া কেয়া দেখ রহে হো ।
মন্ত্রমুগ্ধের মত মেথিলাল আয়নার সামনে গেল । যা দেখল তাতে আশ্চর্য্য হওয়ার চেয়েও যদি বেশী কিছু থাকে তাই হল ।
কালীচরণ ছুটকিকে নিয়ে পাল বাবু আর সে লাহিড়ী মশাইয়ের গৃহে ঢুকল । মেথিলাল লাহিড়ীকে বললেন - কাম হো গিয়া স্যার । তারপর ওদের বৈঠকখানায় রেখে দোকানে এল ।
একি ! পাল বাবুও তো দৌড়ে দোকানে এসে তাদের দেখছেন ।
সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন - বুলাও উনকো।
মেথিলাল পাল বাবুকে ডাকলেন । ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে পাল বাবু এলেন ।
সাহেব বললেন - তুম দোনোমে সে পহলে কৌন উপর জানা চাহতে হো ?
পাল বাবু এগিয়ে এসে বললেন - দো নেহি সাব; তিন। বোলিয়ে হম তিনমে সে কৌন পহলে যায়েগা?
সাহেব নক্ষত্র পালের এমন পরিবর্তনে অবাক না হয়ে পারেন না । এই গতকাল সন্ধ্যেতেও লোকটা তাঁর পা চেটেছে। এখন আবার কার প্ররোচনায় প্রভাবিত হয়ে তাঁর মুখের উপর কথা বলে !
বললেন - লাহিড়ী মোশাই কত টাকা দিয়েছেন আপনাকে ? যদি বাঁচতে চান সচ বতাইয়ে নেহি তো দেবল কা মাফিক উপর ভেজ দুঙ্গা । লাহিড়ী মোশাইয়ের সঙ্গে কি রফা হয়েছে বলুন !
পাল বাবু বললেন - আপনি কি নরপিশাচ? নাকি মানুষের বেশে কোন কঙ্কাল ?
- দেখতে চান আমি আসলে কে ? তবে দেখুন।
সাহেবের গলা থেকে দু দুটো মুণ্ডু বেরিয়ে এল । একটা সাহেব নিজে ; অপরটা দেবলের । আর তৃতীয় মুণ্ডুটা মেথিলালের ।
সাহেব বললেন - কি চিনতে পারছেন এদের?
পাল বাবুর মুখে কথা নেই। গোটা শরীর ঠকঠক করে কাঁপছে। কিন্তু মেথিলাল ? সে এমন নির্বিকারে দেখছে কেন ?
মুহুর্তে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল মিঃ পালের । পারলে তিনি এক দৌড়ে লাহিড়ী মশাইকে গিয়ে সব বলে দেন । কিন্তু পা যে তাঁর নড়ছে না । আর পালাবার চেষ্টা করলে তো আরও বিপদ। মেথিলাল এতক্ষণ চুপ করে ছিল । সাহেবের এই রূপ দেখে আগেকার কথা সব মনে পড়ে গেল ।
ঝুমরিতিলাইয়ার সেই আদিবাসী গ্রাম । সেই মহুয়াতলে তিন ভাই মিলে পাখি শিকারের খেলা । অশ্বত্থ গাছে দুটো কাঠিতে শালগাছের আঠা জড়িয়ে বক ধরা । তিন ভাইয়ের গায়ের রং তিন রকম । একজন ধবধবে ফর্সা; ঠিক সদ্য বিদায় নেয়া ব্রিটিশদের গায়ের রং। মেথিলাল নিজে শ্যামলা । দেখে মনে হত আদিবাসী সমাজের নয়। আর দেবল ছিল মিশকালো। কুচকুচে।
মেথিলাল বলল - এতদিন কুথায় ছিলিস রে দাদা ?
- দাদা !
পালের ঘোর যেন কাটা তো দূর আরও বেড়ে যাচ্ছে। তার মানে এরা তিনজনই সহোদর ।
সাহেব বললেন - তুরা ভাইব্যেছিলি মইরে গেছি ? মরি লাই। দিল্লী পলাইছিলম । সিখানে এক পাঞ্জাবি বাবুর দুকানে নৌকরি করতি করতি কিছু কামাইলম। ভাল লাইগল না । আবার চইলে গেলম বঙ্গালে। পাদ্রীসাহেবের কাছে কেরেস্তান হইয়ে মাথায় এইল শয়তানী ভাব । তুই জমীন গুলান বেইচে হাজারিবাগ চইলে এল্যি । দেওলা পইড়ে রইল । উয়ার লজরটো ভাল লয় । আমার ছুটকিকে পটাইয়ে লিল । আমি মনের দুখে প্রতিশোধ লিবার লেগে এই কাজটা লিলম ।
আর কিছু না বলে স্বমূর্তি ধারণ করলেন মিঃ কিংস্টন।
কালা যাদু দিয়েই আসল কিংস্টন সাহেবকে জব্দ করে নিজেই সাহেব সেজে বসেছিলেন ।
মিঃ পাল মনে সাহস এনে সাহেবকে বললেন - এ সবে আমার কি ! নিজেদের ঝগড়া নিজেরা মিটিয়ে নিলেই হয় !
যাক গে যাক । আমি- আমি এবার চললাম। গুড বাই।
সাহেব তাঁকে বাধা দিলেন না । বরং বললেন - হাঁ যান । আর লাহিড়ীকে বলবেন কালীচরণ আর ছুটকিকে যদি পারেন তো সামলে রাখুন । এখন আমি আর একা নই। দু'জন আছি ।
( ক্রমশ )
