Sucharita Das

Classics

2  

Sucharita Das

Classics

এ কেমন ভালোবাসা

এ কেমন ভালোবাসা

4 mins
722


"ধূর ধূর এটা একটা জীবন নাকি? আজ যে বিবাহবার্ষিকী সেটাই উনি ভুলে গেছেন। সারাটা জীবন শুধু অফিস আর ঘর করেই কাটিয়ে দিলেন উনি। না কোনো রোমান্টিক কথাবার্তা, না কোনো রোমান্টিক গিফ্ট। জীবনের মাধুর্য টাই উপভোগ করতে পারলাম না।" নিজের মনে গজগজ করতে থাকে পরমা। আজ ওদের বিয়ের কুড়ি বছর পূর্ণ হলো। অথচ দেখো মিস্টার সরকারের সে ব্যাপারে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। উনি যথারীতি সকালে অফিসে গেলেন। পরমা কতো আশা করেছিল , অফিসে বেরোবার আগে অন্তত একবার বলবে কিছু এই দিনটা নিয়ে। বেশি কিছু আশা করেনা পরমা অবশ্য। শুধু এটুকু বলতো যে এই দিনটা ওর মনে আছে। তাহলেই পরমা খুশি হয়ে যেত।


ওর বান্ধবী রা যখন ওকে উইশ করে জিজ্ঞেস করলো ওর আজকের প্লান কি। কোথায় যাবে ওরা ডিনার করতে? কি গিফ্ট দিলো ওকে? বেচারি পরমা কিছুই বলতে পারলো না। আর সত্যি কথা বলতে কি মিথ্যে বলাটা ঠিক ওর আসেনা। তাই কাজ আছে বলে ও ফোন রেখে দিল। ফোনটা রেখে মনে মনে ভাবলো, ধূর এই নীরস, অভিব্যক্তি হীন মানুষটার পাল্লায় পড়ে ওর পুরো জীবনটাই বৃথা হয়ে গেল।সবসময় গম্ভীর গম্ভীর মুখ। পরমা যদি কোনো সময় হেসে কথা ও বলতে যায়। বা কখনও রোমান্টিক মুডে কথাও বলতে চায়, মিস্টার সরকারের ভাবলেশহীন মুখের অভিব্যক্তি দেখে, সঙ্গে সঙ্গে পরমার মনের সব ইচ্ছা উবে যায় কর্পূরের মতো। ধূর এই ভাবে রসকষহীন জীবন কাটে?


এই তো পুজোর সময়ের কথা। না উনি যাবেন মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখতে। না কোনো ফোটো তুলবেন।অথচ পরমার ও তো ইচ্ছা করতে পারে কখনো যে, নিজের কর্তা র সঙ্গে ফটো তোলে

 আর সকলের মতো। কিন্তু কার সঙ্গে তুলবে পরমা ফটো টা। তিনি তো ভিড় থেকে নিজেকে বাঁচাতে ঘরের ভেতর সেঁধিয়ে বসে আছেন। হাজার বললেও তেনাকে বের করা যাবে না। অগত্যা বেচারি পরমা ,পাশের বাড়ির রিকির মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে গেল।ওর কর্তা কি ভালো। সমস্ত মন্ডপে মন্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখছে।ভালো ভালো জায়গায় ফটো তুলছে নিজের গিন্নি কে নিয়ে

কখনও কখনও পরমা কেও ডাকছে অবশ্য। কিন্তু পরমার নিজেরই তো ওখানে ওদের মাঝে নিজেকে কাবাব মে হাড্ডি বলে মনে হচ্ছে। ঠিক এই সময়টাতেই রাগে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত জ্বলে ওঠে নিজের কর্তা র উপর। আরে বাবা, সারা বছর তো আরাম ই করছো গোমড়া মুখে। পুজোর চারদিন বউ কে নিয়ে একটু হাসি মুখে ঘুরলে, কি মহাভারত অশুদ্ধ হবে শুনি।



সত্যি এভাবে অফিস আর ঘর করে যে কিভাবে কোনো মানুষ থাকে , সেটাই বুঝতে পারে না পরমা। দায়িত্ব, কাজ এসব তো সকলের ই থাকে। একেবারে নীরস প্রকৃতির একটা মানুষ। পরমার সারা জীবন এই নীরস প্রকৃতির মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে শেষ হয়ে গেল। তাও ওই যে কথায় আছে না, আশাতেই জীবন চলে।আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী। সন্ধ্যে বেলা মিস্টার সরকার ফিরবেন অফিস থেকে। পরমা আজ একটু সাজগোজ করেছে। কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে মিস্টার সরকারের দিকে। কিন্তু না, কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই ওনার। যথারীতি ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি। গোমড়া মুখে ঘরে ঢুকে গেলেন। পরমার মনটা খারাপ হয়ে গেল একটু। ধূর যার জন্য আজ সে সাজগোজ করলো, সে তো ফিরেও তাকালো না ওর দিকে। অগত্যা মনমরা হয়ে কিচেনে গেল চা, জলখাবার আনতে। কিচেনে গিয়ে অবাক পরমা।প্রচুর খাবার রাখা আছে।তার মানে মিস্টার সরকারের মনে আছে যে,আজ ওদের বিবাহ বার্ষিকী। খুব খুব খুশি হলো ও। তার মানে যতটা আবেগহীন ও মনে করে মিস্টার সরকারকে, ততটাও না। ফলস্বরূপ আপাতত পরমা আবেগে গদগদ। তাড়াতাড়ি তখনকার মতো কিছু খাবার সাজিয়ে অল্প লজ্জা,অল্প হাসি হাসি মুখ নিয়ে গেল মিস্টার সরকারের সামনে। যদিও উনি সেদিকে তাকিয়েও না তাকাবার ভঙ্গি করলেন। যদিও এই মুহূর্তে তাতে পরমার কিছু যায় আসে না। কারণ এই মুহূর্তে ও ভীষণ ফুরফুরে একটা মেজাজে আছে। শুধু শুধু কতো কি ভাবছিল মানুষটা সম্পর্কে।আসলে উনি এরকমই। ভেতরে যতই আবেগ থাক, বাইরে তার প্রকাশ করা, ওনার স্বভাব বিরুদ্ধ। রাত্রি বেলা ডিনার করলো দু'জনে মিলে। তারপর ঘরে গিয়ে পরমা দেখলো ওর ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটা ছোট্ট বাক্স রাখা আছে। বাক্স খুলে ও অবাক।আজ তো চমকের পর চমক ।ওর কতদিনের শখ ছিল একটা ডায়মন্ডের আংটির।এই তো সেদিন ও নিজের বৌদি কে ফোনে বলেও ছিল সেকথা। কিন্তু সেটা মিস্টার সরকার কি করে জানলো। তাহলে কি এক্ষেত্রে ও পরমা ভুল প্রমাণিত হলো আজ? যে মিস্টার সরকার ওকে কখনও রোমান্টিক কোনো উপহার দেয়নি। আজকের দিনে এই উপহার তো ওর জীবনের পরম প্রাপ্তি। এতদিনের সব না পাওয়ার দুঃখ পূরণ করে দেয়,এই উপহার।এর থেকে রোমান্টিক কোনো মুহূর্ত হতেই পারে না পরমার কাছে। পরমা আংটি টা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মিস্টার সরকার ঘরে ঢুকে বললেন, শুধু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে না থেকে,কেমন লাগছে আঙুলে আংটি টা পরবার পর, সেটা দেখালে বেশি ভালো লাগতো। পরমা আংটি র বাক্সটা নিয়ে এসে বললো, 'যে দিয়েছে, সে নিজের হাতেই পরিয়ে দিক এটা'।



পরমা মনেতে খুশির আমেজ নিয়ে ভাবছে,আসলে দাম্পত্য এরকমই। যতই একঘেয়ে মনে হোক না কেন, একটা বৈচিত্র্য থাকেই। আসলে রোজ রোজ থাকতে থাকতে আমাদের মনে হয় , ধূর মানুষটা আমার জীবনটাই ছাড়খার করে দিলো। কাকে নিয়ে যে ঘর করছি। কিন্তু আসল সত্যিটা তো হলো এটাই যে ,ওই আবেগহীন মানুষ টি কে ছাড়া পরমা এক মুহুর্ত ও ভালো ও থাকতে পারবে না কোথাও। যতই ভাবে পরমা সংসার ছেড়ে দু'দিন বাইরে থেকে আসবে কোথাও। কিন্তু থাকতে গেলেও মন তো সেই ,ওই মানুষ টার কাছেই পড়ে থাকে। কি করছে,কি খাচ্ছে, ঘরের কি অবস্থা করেছে। কিচেনে তো লন্ডভন্ড অবস্থা করে রেখেছে। সারকথা হলো, মন ওই একজনকে কেন্দ্র করেই ঘোরাফেরা করছে। 


দাম্পত্যে এই আমাকে ছাড়া তোমার চলবে না, বা তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না ,এই টকমিষ্টি ঝগড়া তো চলতেই থাকবে আজীবন। নইলে একঘেয়ে জীবনে মাধুর্য আসবে কি করে। প্রতিদিনকার জীবনে বৈচিত্র্য আসবে কি করে। দাম্পত্যের ভাবলেশহীন ভালোবাসা ও যে কখনও কখনও মহা মূল্যবান মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকে, তার প্রমাণ তো মিস্টার সরকার দিলেন। বেঁচে থাকুক দাম্পত্য, বেঁচে থাকুক ভালোবাসা।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics