দশমীর চাঁদ ও ফাঁকা মন্ডপ
দশমীর চাঁদ ও ফাঁকা মন্ডপ
[২০১৪ সালে লেখা: প্রথম গল্প]
রাত ৮ টা
অমিত রাস্তায় হাঁটছে। সামনেই দূর্গাপূজার প্যান্ডেল। অমিতের সাথে কেউ নেই। সবাই গেছে সুরমাঘাটে দূর্গা বিসর্জন দিতে।
বিসর্জন, কী সহজ শব্দ। লোকগুলো কত সহজেই বলে দেয় দূর্গা বিসর্জনে যাচ্ছি। মনে হয় দূর্গা কোনও ফেলনা বস্তু। কোনও মায়া নেই মায়ের প্রতি। ভাবতে ভাবতে অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
প্যান্ডেল ঘরের সামনে আসতেই অমিতের মন খারাপ হয়। মন্ডপ আজ জনশূণ্য। কেউ নেই। ভীতরে ঠাকুর নেই, ধুপ ধোনা আগরবাতির গন্ধ নেই, দূগ্গা ঠাকুর নেই, গনেশ-কার্তিক-লক্ষ্মী-সরস্বতী নেই। কোনো মানুষও নেই। সব শান্ত। যেনো হাজার বছরের পরিত্যক্ত কোনও রাজবাড়ি।
পূজোয় এবারের থিম ছিলো রাজবাড়ি। কোথাকার রাজবাড়ি, কোন রাজার বাড়ি তা অমিত জানে না। তবে মন্ডপটি বেশ সুন্দর। যেনো সত্যিকারের কোনও রাজবাড়ি। যে রাজবাড়িতে রাজা নেই, মন্ত্রী নেই, নেই কোনো রাজসভা। শূণ্য রাজবাড়ি পড়ে থাকে। খাঁ খাঁ করে রাজবাড়ির প্রতিটি দেয়াল। মানুষের পদধ্বনি পেলেই উড়ে যায় যাক বেঁধে বাদুরের দল।
অমিত মন্ডপ থেকে বেরিয়ে যায়। মন্ডপের সাথেই বড় মাঠ। মাঠের এক কোণায় ছোটো মন্ডপ। হ্যালোজেন বাতি থাক করে রয়েছে মন্ডপের দিকে। হ্যালোজেনের আলোয় খুব সুন্দর লাগছে মন্ডপটি।
পরিত্যাক্ত প্রায় একটি মাঠ। এক পাশে ক্রিকেট খেলার পিচ অন্যপাশে পরিত্যাক্ত ডুবা। মাঠের এক কোণে বরই গাছের নীচে একটি বসার জন্য বেঞ্চ আছে। বেঞ্চটি বেশ পুরনো, যখন এই পুকুর সুন্দর পরিপাটি পুকুর ছিলো তখনকার। অমিত সেখানে গিয়ে বসলো।
ছোট বরই গাছের ফাঁকে চাঁদ দেখা যায়। দশমীর চাঁদ। তবে বেশ ঝাপসা আর লালটে বর্ণের। আকাশে ভাসা ভাসা কালো মেঘ। চাঁদের আলোও কম। দেবী ফিরে গেছেন বলে চাঁদেরও হয়তো মন খারাপ।
অমিত চাঁদ দেখছে। ভীষন্ন চাঁদ। অমিতের মতই ভীষণ একলা চাঁদ। আচ্চা, চাঁদের ভীষন্নতার কারণ কী? চাঁদ কে তো আজ আলো দেখাতে হবে। দেবীরা আজ ঐরাবতে ওইপথেই তো যাবে হয়তো।
ভাবতে ভাবতে ঝিম ধরে যায় অমিতের। এমন সময় পাশে থেকে কেউ একজন অমিতের ঘাড়ে হাত দেয়। অমিত চমকে উঠে। আট নয় বছরের একটি মেয়ে। খুব সুন্দর দেখতে, চোখগুলো টানা টানা। অমিত একবার ভাবে ভূল দেখছে। চোখ মুছে আবার দেখে। নাহ, ভূল নয়। বাচ্চা মেয়েটি সত্যি সত্যিই এসেছে। সাদা রঙের জামায় খুব সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে। কিন্তু এত ছোট মেয়ে আসবে কোত্থেকে?
মেয়েটি বললো, "আমার দাদাকে দেখেছো?"
অমিত যেনো প্রশ্নটি শুনতে পেলো না। কী চমৎকার মেয়েটির গলা। যেনো স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো দেবী কন্যা। অমিত একটু কৌতুহলী হয়েই জিজ্ঞেস করলো,
- তুমি কে গো? কোত্থেকে এসেছো? এত রাতে এই অন্ধকার মাঠেই বা কি করছো?
- দাঁড়াও দাঁড়াও এতগুলো প্রশ্ন করলে উত্তর দেবো কোনটা?
- হুম, তাও ঠিক। আচ্ছা, আগে বলো তোমার নাম কী?
- সরস্বতী।
- বাহ, বেশ সুন্দর নাম। তা এতো রাতে এখানে এসেছো কেনো? থাকো কোথায়?
- আবারো দুইটা করে প্রশ্ন।
বেশ চালাক চতুর মেয়ে। কথাবার্তায় একটু আহ্লাদ মেশানো। এত সুন্দর মেয়
ে অমিত কখনই দেখে নি। ইশ, এই সরস্বতীর মত যদি একটা ছোট বোন থাকতো।
- আচ্ছা বলো, এত রাতে এখানে কী করছো?
- এসেছিলাম তো দাদাকে খোঁজতে, কিন্তু কোথাও পাচ্ছি না। ওদিকে আবার রথ এসে গেলো।
- তোমার দাদা তোমাকে একা ছেড়ে চলে গেছে। কেমন দাদা তোমার। চলো আমার সাথে, একসাথে খোঁজি...
- দাঁড়াও বাপু, একটু বসি এখানে। খোঁজতে খোঁজতে ক্লান্ত হয়ে গেছি দেখছো না। একটু ঝিরিয়ে নিই।
বলেই মেয়েটি বসে পড়লো। অমিত বোঝতে পারলো না এই মেয়েটি কী করে এখানে এলো। ওর বাড়িই বা কোথায়। বাড়ির কেউ যদি ওকে খোঁজতে এসে এখানে দেখে তবে? না না, মেয়েটিকে নিয়ে উঠতে হবে।
- এই মেয়ে, এসো তো, যায়গাটা ভালো না। দোকানের দিকটায় চলো। তোমার দাদা হয়তো ওদিকেই আছে।
- ওইদিকে দেখে এসেছি। উনি কোত্থাও নেই। তুমি চিনো না আমার দাদাকে, খুব পাজি। ও আমাদের সাথে লোকোচুরি খেলছে। নিজে থেকে ধরা না দিলে ওকে খোঁজে পাওয়া যায় না।
মেয়েটা কী বলছে তার সবটাই অস্পষ্ট।
- মানে?
- উফ, তুমি দেখছি কিছুই জানো না।
মেয়েটা এমন ভাবে কথা বলছে যেন অমিত কতদিনের চেনা। কত অদ্ভুদ হয় শিশুরা, সহজেই কাউকে আপন করে নেওয়ার অদ্ভুদ ক্ষমতা থাকে ওদের মধ্যে।
অমিত আবার বলে,
- তোমার দাদার নাম কী?
- সে কি তাও জানো না।
বলেই মাথায় হাত দেয় মেয়েটি।
- না
- গণেশ গো গণেশ। আমার দাদা গণেশ। আমার আরেকটা দাদা আছে, কার্তিক দাদা। ও খুব একটা দুষ্টু নয়। যত যন্ত্রণা গণেশ দাদাকে নিয়ে। দেখো না, কৈলাশে যাওয়ার রথ এসে গেলো, হুট করে দাদা গায়েব। সবাই মিলে খোঁজে মরছে এখন। ওদিকে আবার, দেরী হলে পিতা ভীষণ রাগ করবেন। সে খেয়াল আছে?
মেয়েটির কথা গুলো শুনে গায়ে শিহরণ দিয়ে উঠে অমিতের। একি শুনছে সে। ঠিক শুনছে তো। এ তো দেখছি দেবী সরস্বতী তার সামনে বসে আছে, বাচ্চা মেয়ের রূপে। না না কোথাও ভূল হচ্ছে নিশ্চই। হাতে চিমটি কাটে অমিত। নাহ, সব ঠিক আছে। সে সম্পূর্ণ সুস্থ। যা দেখছে সব সত্যি। চোখের সামনে দেবী সরস্বতী। ওর কল্পনাতে যেমন ছোট্ট সরস্বতী, এখানেও বসে আছে কল্পনার মত বাস্তব দেবী সরস্বতী।
- অনেক কথা হয়েছে। আমি এবার উঠি গো। আমাকে এবার যেতে হবে। মা নিশ্চই অপেক্ষা করছেন। আমি যাই তাহলে। আবার দেখা হবে।
বলেই সে উঠে পড়লো। অমিতের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিলো। মনোমুগ্ধকর হাসি। যে হাসি চাঁদের আলোর মতই উজ্জ্বল। যে মুখ চাঁদের থেকেও সুন্দর।
অমিত আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু হা করে তাকিয়ে থাকলো। মেয়েটা একটু দূর গিয়েই অন্ধকারে কোথায় যেনো অদৃশ্য হয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর ঢাক ঢোলের শব্দ শুনা গেলো। দূর্গা বিসর্জন দিয়ে পাড়ার ছেলেরা ফিরে এসেছে হয়তো। অমিত আকাশে তাকিয়ে চাঁদের আলোয় একটি রথের ছায়া দেখলো। চাঁদের আলো এখন বেশ উজ্জ্বল। অমিতের কিছুই ভালো লাগছে না। মনে মনে ভাবলো, দুর্গাপূজার আর তিনশো পয়ষট্টি দিন বাকি...।