শঙ্খনীল শিপন

Abstract Classics Inspirational

3  

শঙ্খনীল শিপন

Abstract Classics Inspirational

একটি গল্প শুনাই?

একটি গল্প শুনাই?

9 mins
256



কৃতেষ মাঝি উঠোনের এমন যায়গায় বসে দাঁড়ি কামাচ্ছেন যেনো দক্ষিণ দিকে বসা কমোদিনীর আয়না দিয়ে তার মুখ দেখা যায়। কমোদিনীর চুল লম্বা, ঘন আর কোঁকড়ানো। কমোদিনী দিদির চুল স্পর্শ করার জন্য কাঁকন মাঝে মাঝেই বায়না ধরে, কোলে নেওয়ার জন্য৷ কমোদিনী কোলে নিলে কাঁকন ধীরে ধীরে চুলে হাত বোলায়, গালে আদর দেয়। কাঁকনের ছোট ছোট আলতো হাতের পরশ কমোদিনী মুগ্ধ হয়ে অনুভব করে।


কৃতেষ মাঝির দাঁড়ি কামাতে এক ঘন্টা লাগে। কমোদিনী যতক্ষণ আয়নায় নিজেকে গুছিয়ে নিবে কৃতেষ মাঝির দাঁড়িও ততো সময় নিয়ে কাঁটা হবে। কমোদিনীর মুখটা বড়ই মায়াবী। মায়াবী মুখের মেয়েরা আয়নায় অনেক্ষণ চোখ গুজে রাখেন। কমোদিনীও তার ব্যতিক্রম নয়। মেয়েরা শাড়ি পড়লে খুব সাবধানে চলাফেরা করেন। কমোদিনী এত সাবধান নয়। থাকলে এতক্ষণে বোঝতে পারতেন, তার আঁচল অনেক্ষণ থেকেই মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এক নজরে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের চুল সজ্জায় ব্যস্ত। চুল আঁচরানোর পর কমোদিনী লাল রঙের একটা টিপ পড়লেন। লাল রঙের বড় আঁকারের টিপে কমোদিনীকে এত্ত সুন্দর লাগে! টিপ পড়ে আবীর দিয়ে সিঁথিতে একটু সিঁদুর পড়লেন যেন। এরপর শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা দিলেন। দেখতে যে কী সুন্দর লাগছে, ঠিক যেনো নতুন বউ! এই দৃশ্য দেখতে দেখতে কৃতেষ মাঝি থুতনির এক অংশ রেজার দিয়ে কেঁটে ফেললেন। কাঁকন বেঞ্চিতে বসে মনে মনে হাসলো। কারণ রেডিও'তে গান শুনার সময় সে জোরে জোরে হাসতে চায় না। তার উপর এখন রেডিওতে তার প্রিয় গান চলছে, "কৃষ্ণ আইলা রাধার কুঞ্জে, ফুলে পাইলা ভ্রমরা৷ ময়ূর বেশেতে সাজন রাধিকা।"


কাঁকনদের গ্রামটি আসলে হাঁটি গ্রাম। এক উঠোন, দু'পাশে ঘর, এমন লম্বাকৃতির গ্রাম। নাম রঘুনাথপুর। তবে সবাই পাটুনি গ্রাম নামেই চিনে। বেশিরভাগ লোকই জেলে সম্প্রদায়ের। তবে শুষ্ক মৌসুমে সবাই ধান চাষ করে থাকেন। কাঁকন গ্রামে ডাক্তারের ছেলে। গ্রামে প্রবেশ করলে দ্বিতীয় ঘরটি তাদের। উঠোনের ওপাশে একটা দেরী ঘর (এক্সট্রা রোম), তারপর খোলা যায়গা, নদীর পাড়। নদীর নাম ঘানুরা। উত্তরে সুরমা নদীর একটি শাখা নদী। সাপের মত প্যাঁচানো নদী, তাই কাঁকন এর নাম দিয়েছে সর্পিল নদী৷ গ্রামের নাম বউহাঁটি। বউহাঁটি কারণ, গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষই এখন শহরে চলে গেছেন। কাঁকন কল্পনাপ্রবণ, ভাবুক স্বভাবের। সকালের কাজ, রেডিওতে গান শুনা। তারপর বন্ধুরা চলে এলে খলায়(ধান শুকাতে দেওয়ার মাঠ) খেলতে যাওয়া। আজকেও যথারীতি তার বন্ধুরা চলে এলে, খলায় যায়। খলায় যাওয়ার আগে, ঘর থেকে দৌঁড়ে ব্রাশ আর পেষ্ট নিয়ে আসে, নদীতে মুখ ধোঁয়া যাবে।


শীতের সকাল, আঁটটা বেজে গেছে। নদীর ওপাশে সূর্য্য বেশ খানিকটা উপরে উঠেছে। নদীর জলে এখনো কুয়াশা বাষ্প আকারে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার উপর জলে হালকা স্নিগ্ধ সূর্য্যের রশ্মি এসে পড়েছে। কমল কখন থেকে যেনো, বাঁশপাতা(অপ্রস্ফুটিত, বিড়ির মতো লাগে) মুখে নিয়ে বিড়ি খাওয়ার ভান করছে। কুয়াশা স্পষ্ট থাকার কারণে মুখ দিয়ে ধুয়া বেড়োচ্ছে। পঙ্কজ তাকে তার সাথে সমানে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, কে কত বেশি ধুয়া বের করতে পারে। কাঁকন, নদীর পাড়ে নৌকায় উঠে, মুখ হাত ধোয়ে নিচ্ছে। অপর নৌকায়, নেপাল (বয়স সতেরো) বর্শি নিয়ে মাছ ধরছে। 


- দেখি কেমন মাছ ধরেছো।... ও মা, এতো শুধু পুটি, আজ ট্যাংরা মিলে নি?

- টেংরার আশায় ই তো বসে আছি। সহজে ধরা দেবে বলে মনে হয় না।

- নেপাল দা, কাঁকড়া পেলে আমায় দিয়ো। অনেকদিন কাঁকড়া খাই না।

- এই শীতে কাঁকড়া পাবো কই? তাছাড়া আজ তো সরস্বতী পূজা। উপোস না তুই?

- হ্যাঁ, তাই তো। কিন্তু তুমি যে মাছ ধরছো? তুমি উপোস না?

- আমি উপোস থেকে কী করবো? আমি কি আর ইস্কুলে পড়ি বোকা?

- তাই বলে পূজো করবে না? দিদি ঠাম্মারাও যে উপোস করে।

- সে করুক গে, আমি ও'সবে নেই।

- আচ্ছা, যাই করো, আজ কাঁকড়া পেলে আমার জন্য রেখে দিও, কাল খাবো।

- আচ্ছা, দেবো নে (হে হে)


মুখ ধোঁয়ে উঠার পর, এদের আড্ডায় আরেকজন এলো৷ ওপাড়ার রহিমুদ্দিন। হাতে মনাক্কা(ছোট ছোট চারকোণ আকৃতির নিমকির মতো)।


- কিরে কাঁকন, অনুষ্টান কবে শুরু হবে?

- এইতো, মনে হচ্ছে, এবারও সময় গড়িয়ে বিকেল হবে।

- নাচ গান হবে তো?

- হবে, হবে, সোম বাজার থেকে মাইক এনেছে। বাচ্চারা গান গাইবে। গানের দলও এসেছে। রাতে যাত্রা হতে পারে শুনেছি।

- সে কি! এ তো বিরাট আয়োজন! আমরা আসবো?

- আসবি না কেনো, অবশ্যই আসবি। বিকালে আসিস।

- আচ্ছা, আচ্ছা। এই নে মনাক্কা।


মনাক্কা দিতেই কাঁকন ধুম করে দুটো খেয়ে নিলো।


- সে কি! আজ তো পূজো। তুই না উপাস? (কমল বললো)

- আরেহ, অহ, ভুলে গেছিলাম! (জিহবায় কাঁমড় কেঁটে বললো কাঁকন)

- তোর তো বিদ্যা গেলো! সরস্বতী মায়ের পায়ের তলায়। তার উপর মুসলমানের হাতে খেয়েছিস। তুই কি রে? (শিবুদা বললো)

- শুন, আমার বিদ্যা গেলে গেছে! তোদের তো যায় নি। হিন্দু-মুসলাম আবার কী? কি রে শিবু দা, গতবার তো খুব সংযম মেনেই পূজোটা করেছিস। বলি, পাশ করেছিস? আর শংকর দা কে দেখ, তিন বছর থেকে বেহায়ার মতো ক্লাস ফাইবে পড়ে আছে। এত তো পূজা মানিস, কাজ হয়?


শিবুর মাথা নত। কাঁকন মারাত্মক রেগে গেছে। কেউ তার সামনে হিন্দু-মুসলমান পার্থক্য দেখালে তার খুব লাগে। সবাই মিলে কাঁকনকে শান্ত করলো। এমনিতে সবাই কাঁকনকে লিডার মানে। সবকিছু তার কথাতেই হয়। কিন্তু, লিডার হয়েও মানুষের মন থেকে বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ কাঁকন। এই কথা মনে হলেই, তার চোখ লাল হয়ে যায়।


এদিকে শিমুল দৌঁড়ে এসে সবাইকে জানালো, মাষ্টারদা সবাইকে খোঁজছে। সবাই গেলো। মাষ্টারদা সবাইকে বসিয়ে ভাষণ দিবে মনে হচ্ছে, এমন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাষ্টারদা শহরে থাকে। মাঝে মধ্যে পূজো-অনুষ্ঠানে আসে। গ্রামের বাচ্চারা তাকে যেমন ভয় পায় তেমনই মানে। একটু গম্ভীর ও অতিজ্ঞানী ভাব নিয়ে বসে থাকলেও, মনে মনে অতটা সমৃদ্ধ নয়। কথা বলেন বড্ড বেশি।


"শুনো বাচ্চারা, আজ গ্রামে একটা শুভ দিন। বিদ্যা মায়ের পূজোর তিথি। এমন দিনে বিদ্যা দেবীকে সন্তুষ্ট করতে হবে। কেননা বিদ্যা মাকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই, জীবনে বিদ্যা অর্জন সম্ভব। তাহলে বিদ্যা মাকে কীভাবে সন্তুষ্ট করতে হবে? বলো?


- বিদ্যা মার পূজা করে। (একজন বলে উঠলো)

- ঠিক বলেছো, বৎস। এখন বিদ্যা মার পূজা কী এমনি এমনি হয়ে যায়? তার জন্য তো অনেক উপাচার লাগে। আমাদের কাছে কী আছে সেই সব উপাচার?... কত কাজ করতে হবে বলতো?... তোমাদের সময় থাকতে আমরা কত্ত শখ করে সব কাজ করেছি জানো? আর তোমরা? তোমরা বসে বসে আড্ডা দিচ্ছো?


- আমরা কী করবো মাষ্টারদা?


- এইতো ভালো ছেলেদের মত কথা। শুনো, আমাদের পাড়ায় পুরোহিত আসতে সময় লাগবে। এর আগে আগে আমরা সবাই নিজেদের কাজ, পূজার যোগার যন্ত্র করে রাখবো। বোঝেছো? আশাকরি তোমরা সবাই উপবাস রেখেছো?


- মাষ্টারদা, কাঁকন মনাক্কা খাইসে। (কেউ)

- তাও আবার মুসলমানের হাতে। (অন্যকেউ)


- কী? কাঁকন? এরা সত্যি বলছে? (কাঁকন মাথা নাঁড়িয়ে বললো, হ্যাঁ) ঠিকাছে। তুমি আজ পূজা মন্ডপে আসবে না। আর কোনো রকম কাজে হাত লাগাবে না। বোঝেছো?


- কিন্তু...

- কোনো কিন্তু না। ঠাকুরদা এলেই, এর বিহীত হবে। তুমি কী পূজা করার যোগ্য রয়েছো, তাও জানতে হবে। এর আগ অবধি তুমি অনুষ্টানের আশেপাশেও আসবে না।


কাঁকন মন খারাপ করে চলে যায়। মাষ্টার দা শিমুলকে পাঠায়, এই বলে যে, সে যদি স্নান করে নেয়, তবে পূজা অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে পারবে, কিন্তু অঞ্জলি দিতে পারবে না, আর মন্ডপের ভীতরেও যেতে পারবে না। কিন্তু কাঁকন সাফ জানিয়ে দেয় সে আবার স্নান করবে না। ঘুম থেকে উঠেই একবার স্নান সেরে নিয়েছে। আর সে অঞ্জলিও নিবে।


মন খারাপ হলে কাঁকন কমোদিনী দিদির কাছে যায়। কমোদিনী তারে আদর করে দেয়। তার মন ভালো হয়। কিন্তু আজ কমোদিনী দিদির আদরেও তার মন ভালো হয় না। গ্রামের পিছনে রাস্তার ধারে বসে থাকে, দূরের হাওড় দেখে। অতিথি পাখিদের দেখে। সাদা বক তার খুব ভালো লাগে।


তার বন্ধুরা সবাই ইস্কুলের মাঠে নৌকা নিয়ে গেছে। এই সময়, ইস্কুলের মাঠে, জলাশয়ে অনেক শাপলা ফুঁটে। পূজার জন্য অনেক শাপলা লাগবে। কাঁকন শাপলার ভেট (ফল) খেতে পছন্দ করে। আর শাপলা দিয়ে ফুল বানাতে ভালোবাসে। তার বন্ধুরা সবাই শাপলা ফুলের মালা পড়ে, নৌকা ভর্তি শাপলা নিয়ে পূজা মন্ডপে এসে আনন্দ করবে। এই ভেবে তার মন আরও খারাপ হয়ে গেলো।


দূরের গ্রামটি আবছা নীল রঙের যেনো। তার উপর এক ঝাক সাদা বক পাখি উড়ে যায়। মনে হয়, একটা মেঘের টুকরো দ্রুত গতিতে উড়ে যাচ্ছে। দূরের গ্রামটি মাঠের পরেই। মাঠের শেষ দেখা যায় না। যেনো নীল আকাশ, দূরের গ্রাম, মেঘ, মাঠ সব একাকার হয়ে গেছে। ভোরের দিকে এই দৃশ্য আরও সুন্দর!


-কী রে কাঁকন? এখানে একলা বসে আছিস যে..?


এই পথ দিয়েই কৃতেষ মাঝি বাজারে যাচ্ছিলো। কাঁকনকে বিষন্ন আর একলা দেখে কথাটি বললেন। কাঁকন কোনো জবাব দিলো না। এক দৃষ্টিতে দূরের দিকে তাকিয়ে আছে। কৃতেষ মাঝি ছন্দের মত বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছন্দ মিললো না,


- কাঁকন বাবু? মন খারাপ? মন্ডপে যাবে না? না কি রাগ করেছে কারো উপর?


- কৃতেষ দা, কই যাইবায় ছিলায় যাও। ত্যক্ত কইরো না তো।


- যো হুকুম মহারাজা, এই গেলাম।... টা টা কাঁকন বুড়া। হা হা।


কৃতেষ মাঝি হাসিখুশি স্বভাবের। তবে মাথায় বুদ্ধি একটু কম। বুদ্ধি থাকলে এমন এক কথায় চলে যেতেন না। এমনিতে কাঁকনকে খুব ভালোবাসেন। কিন্তু মানুষের মন বোঝার ক্ষমতা হয়তো ঈশ্বর এনাকে দেয় নি। যাওয়ার সময় কাঁকন আটবাবে ভেবেছিলো। কিন্তু আটকায় নি। কৃতেষ মাঝি এখন কোথায় যাবে, কাঁকন তা জানে। কমোদিনীর জন্য কিছু উপহার কিনতে হাঁটে যাবে। বিশেষ বিশেষ দিনে কৃতেষ মাঝি কমোদিনীকে উপহার দিয়ে থাকেন। চুড়ি, টিপ, মুখে মাখার ক্রীম এসবই। সাধ্য থাকলে সোনার হার দিতেন অথবা কোমড়ের বিছা। কৃতেষ বেজায় গরীব মানুষ, এত সাধ্য নাই। খেয়াঘাটের মাঝি, অল্প টাকা রোজগার হয়, এতে কোনো রকম চলে যায়।


কৃতেষ চলে গেলে কিছুক্ষণ পর রহীমুদ্দিন আসে।

- আমি কী খুব অন্যায় করে ফেলেছি কাঁকন?


কাঁকন মুখ তুলে তাকায়।


- অহ, তুই। বস।


- সরি কাঁকন, আমার তোকে মনাক্কা দেওয়া ঠিক হয় নি। আমি জানতাম না, তুই উপোস করেছিস। জানলে দিতাম না।... খুব মন খারাপ লাগছে? কাঁকন?


- না। মন খারাপ তো আমার তাদের জন্য। মায়ের পূজা করে বিদ্যা পাওয়ার জন্য, অথচ, বিদ্যার মাহাত্ম্যই বোঝে না। মুর্খ মানুষ!


- তুই কী বলিস? আমি কিছুই বোঝি না।


- বোঝতে হবে না। চল,


- কোথায়?


- পূজো করবো।


- কিন্তু তোকে তো নিষিদ্ধ করা হয়েছে।


- কে করেছে? বিদ্যা দেবী? মুর্খ মানুষ করেছে। আমি ওদের ধার ধারি না।


কাঁকনের চোখ লাল। মন্ডপে সে ফিরে যাবে না। চাইলে সে মাষ্টারদার সাথে তর্ক করতে পারতো। কিন্তু ওদেরকে বোঝানোর থেকেও সহজ উপায় কাঁকন জানে। রহিমুদ্দীনকে নিয়ে সে গেলো গ্রামের পশ্চিম দিকের জঙ্গলে, একটা পরিত্যক্ত বিষ্ণু মন্দিরে। নদী থেকে এঁটেল মাটি এনে তারা দুজনেই মুর্তি গড়া শুরু করে দিলো। কোনো রকম দেবীর আকৃতি দিয়ে, নিজে নিজে মন্ত্রোচ্চারণ করে দেবীর পূজো করতে লাগলো। শুধুমাত্র সরস্বতী দেবীর প্রণাম মন্ত্র জপ করে দেবীর পূজো করতে থাকলো। রহিমুদ্দিনও হাত জোর করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। রহিমুদ্দিন খেয়াল করলো, বিষ্ণুমন্দিরের জ্বানালা দিয়ে অদ্ভুদ আলোকরশ্মি প্রবেশ করে দেবীর মুর্তির মুখে পড়েছে। দেবীর মুখ আরও মায়াবী হয়ে উঠেছে। একটু পরেই, দেবীর গলা থেকে একটি গাঁধা ফুল মাটিতে পড়ে গেলো। কাঁকন এখনো চোখ বন্ধ করে মন্ত্র জপ করছে। তার মুখে উজ্জ্বল স্নিগ্ধ হাসি। এত সুন্দর মুখখানি! রহিমুদ্দিন মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে আছে!


পূজা পাঠ শেষে কাঁকন চোখ খোলে। দেবীর পায়ের নিচে পড়ে থাকা ফুল হাতে নেয়। ফুল ছিঁড়ে এক টুকরো রহিমুদ্দিনকে দেয়।


- এই নে। মায়ের আশির্বাদ। বইয়ের পাতায় দিয়ে রাখিস। বিদ্যা হবে।

- এই ফুল বইয়ে রাখলেই বিদ্যা হয় বোঝি?

- দূর বোকা! তাই আবার হয় না কি?

- তাহলে?

- বিদ্যা দেবীর পূজা নয়। অধ্যবসায়ই হলো আসল বিদ্যা পূজা। বই না পড়লে কেউ বিদ্যান হয় না। বোঝলি?

- বোঝলাম না। তাহলে তোমরা এত ঘটা করে মুর্তি পূজা করো কেন?

- এ তো শুধু শ্রদ্ধা নিবেদন। আর কিছু না। সুষেন দা বলেন, বই পড়লেই সরস্বতী মা খুশি হয়। ফুল দিয়ে পূজা তো নাম মাত্র।

- তুই কি বলিস, আমি কিছুই বোঝি না কাঁকন। বড় কঠিন কঠিন কথা কস!

- অতো বোঝতে হবে না। শুন, কাল স্কুল শেষে আমরা একটা যায়গায় যাবো, যাবি তো তুই?

- কোথায়?

- একটা সুন্দর যায়গা। কাল দেখাবো নে।

- আচ্ছা যাবো। এখন এই মুর্তির কী করবো?

- হ্যাঁ এখানে থাক। আমি কমল, পঙ্কজদের ডেকে আনছি। পূজা শেষে মুর্তি ঘরে নিয়ে যাবো। টেবিলের পাশে রেখে দিবো।

- ঠিকাছে।


দু'জনে নদীর পাড়ে ঘুরতে গেলো। নদীর পাড়ে জিওলবনের ফুল ফুটে। জিওলবনের হালকা গোলাপি রঙ কাঁকনের খুব পছন্দ। কমোদিনী দিদিরও খুব পছন্দ। কয়েকটি ফুল নিয়ে কমোদিনীকে দেওয়া যাবে। তারপর জিওলবনের ডাল ভেঙে দু'জনে গাড়ি চালিয়ে দৌঁড়তে শুরু করলো। যেনো তারা দৌঁড়চ্ছে না, আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে। কী সুন্দর সেই দৃশ্য। রহিমুদ্দিনের ঘর থেকে একটু দূরে, ধান কাঁটার ঘর আছে। সেখানে পুরোনো সাইকেল থাকে। রহিমুদ্দিন সাইকেল বের করে, দু'জনে সাইকেল নিয়ে পিছনের রাস্তার দিকে যেতে লাগলো। রহিমুদ্দিন সাইকেল নিয়ে, কাঁকন জিওলবনের ডাল নিয়ে গাড়ি চালাতে চালাতে দূরে চলে যাচ্ছে।


দুপুর বারোটা বাজে।

গ্রামে সবাই শাড়ি, নতুন জামা পড়ে পূজা মন্ডপে উপস্তিত হয়েছে। বাচ্চারা মাইকে ধর্মীয় গান গাইছে। কেউ কেউ, শাপলার মালা গলায় দিয়ে চারিদিকে দৌঁড়াদৌড়ি করছে। উৎসব মুখর পরিবেশ। রহিমুদ্দিন আর কাঁকন দু'জনে দূরে অজানা গ্রামের দিকে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে সবাই কাঁকনকে খোঁজছে। তাতে কাঁকনের কিছু যায় আসে না। গ্রাম থেকে বেড়িয়ে দূরে অজানা গ্রামে চলে যাবে। যদি পারে, আজ আর ফিরবে না। কোনো চিন্তা নেই, পিছুটান নেই, দু'জনে মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে হাওড়ের মাঝ রাস্তা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract