দোলে দোদুল
দোলে দোদুল


কয়েক বছর পর আবার দু'জনে একসঙ্গে ! হাজার হাজার স্মৃতি এসে জড়িয়ে ধরল...কথা হারিয়েছে আবেগের উত্তাল ঢেউয়ে। মনে মনে চলছে লাখো কথার নীরব কথোপকথন। অভিযোগ-অনুযোগ নেই সেখানে। আছে একরাশ অভিমান শুধু, দু-জনেরই হয়তো। অতীতকে ঠেলে সরিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে দোলন সব আবেগ, দুর্বলতাকে জয় করে দাঁড়িয়ে, যেন কত স্বাভাবিক সবকিছু।
দোলনের খুব ইচ্ছে করছে তবুও আজ একবার ঝাঁপিয়ে পড়তে বিবস্বানের বুকে। কিন্তু তা আর পারছে কই? পাহাড় প্রমাণ জড়তা ঘিরে ধরেছে দু'জনকেই। নীরবতা ভেঙে বিবস্বান,
"তাহলে কোল্ড কফিই বলি?"
দোলন এবার অতীতে ডুব দিলো.... সেই কলেজবেলা, সেই গরমভর কোল্ড কফি!
সিসিডির কাঁচের দেওয়ালের বাইরে চলমান পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দোলন জিজ্ঞেস করলো বিবস্বানকে,
"একাই এসেছো?"
ঘাড় দুলিয়ে বিবস্বান বললো,
"হ্যাঁ।" অতি সংক্ষিপ্ত উত্তরে। দোলন খুব ভালো করে লক্ষ্য করছে বিবস্বানকে.... কপালঘেঁষা চুলের ঘনত্ব পাতলা হয়েছে, ধূসর চুলের সংখ্যাও যথেষ্ট, চামড়া আরো তামাটে, চিবুক ও চোখের তলার ভাঁজও স্পষ্ট। শরীর বেশ খানিকটা ভারী হয়েছে আর তার সাথে সঙ্গতি রেখে গাম্ভীর্য আরো বেড়েছে।
বিবস্বান জানতে চাইলো,
"ক'দিন আছো? একাই?"
দোলন মৃদু স্বরে বললো, "পরশুর টিকিট, রাজধানী এক্সপ্রেসে.....একাই।" সামান্য বিরতি নিয়ে দোলন বললো, "বৌকে আনতে পারতে, পরিচয় হোতো বেশ।" খানিকক্ষণ উদাসী চেয়ে থেকে বিবস্বান বললো, "কবি ও কবিতা সম্মেলনে আমি একাই যাই, আসলে একা যেতেই পছন্দ করি।" একটু যেন বেসুরো ঠেকলো বিবস্বানের গলা, দোলনের কানে। আলাদা ওরা হয়েছে যতদিন, একসঙ্গে থেকেছে তার থেকে অনেক অনেক বেশী দিন। জন্ম থেকেই একপাড়ায়, তারপর সেই নার্সারী থেকে মাস্টার্সের শেষে পিএইচডি থিসিস সাবমিশন পর্যন্ত একসাথে, শুধু ইউনিভার্সিটিই আলাদা হয়েছিলো পিএইচডির সময়। কিন্তু পাল্টা কিছু বলার মতো অনুভূতিহীন মেয়ে দোলন নয়, যে নিজের অপূর্ণতার সুযোগে অতীতের পূর্ব পরিচয়ের সম্পর্কের রেশ টেনে ধরে বিবস্বানকে বিব্রত করবে।
সুনামির মতো স্মৃতিরা ধেয়ে আসছে, আছড়ে পড়তে চাইছে। দোলনের মনে পড়লো, বিবস্বানদের বাড়ী থেকে বিয়েতে আপত্তির কথা। বিবস্বানের সাথে আলাদা একা দেখা করতে চেয়েছিলো দোলন। বিবস্বান রাজী হয় নি। যে বন্ধুকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলো দোলন, তাকে দিয়েই বলে পাঠিয়েছিলো বিবস্বান, যেন দোলন ভুল না বোঝে! দোলন নতুন করে জীবন শুরু করুক, বিবস্বান বাড়ীর বিরুদ্ধে যেতে চায় না। দোলনের পৃথিবীটা ওলটপালট হয়ে গিয়েছিলো, একদিনেই। বিবস্বানের কাপুরুষের মতো আচরণে দোলন নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞা করেছিলো আর কখনো ও বিবস্বানের মুখোমুখি হবে না। কথা রেখেছিলো দোলন.... স্বনামধন্য কবি দোলনচাঁপা বসু। মাঝে ষোলোটা বছর পার হয়ে গেছে। কলেজ আর কবিতা এই নিয়েই বাঁচার নতুন পথ তৈরী করে নিয়েছে দোলন, এতগুলো বছর ধরে, তিলতিল করে। আজ একটিমাত্র ডাকে, ঐ গলার স্বরের আবেশে হারিয়ে যেতে পারে না দোলন। কফি শেষ হয়েছে, দোলন উঠে দাঁড়ালো, ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বললো, "দ্বিতীয় সেশনে বিকেলে আমার পাঠ আছে, আর তারপর আমার কবিতা নিয়েই একটা আলোচনা সভা। এবার ফিরতে হবে।"
বিবস্বানও নীরবেই দোলনকে অনুসরণ করলো। কয়েক পা হেঁটে রাস্তা পেরোলেই সম্মেলন প্রাঙ্গণ, নতুন দিল্লীর চিত্তরঞ্জন পার্কের বঙ্গ সম্মেলনের অঙ্গ হিসেবেই কবি-সাহিত্যিক সম্মেলন। ধীরপায়ে হেঁটে দোলন মঞ্চের দিকে এগোলো, আয়োজকদের ঘেরাটোপে। বিবস্বান এতক্ষণে হয়তো দর্শকাসনে।
দোলন আর পিছন ফিরে তাকালো না। তরুণ এক আয়োজক কৌতূহলী স্বরে জানতে চাইলো, "ম্যাম, বিবস্বানদা....মানে প্রফেসর বিবস্বান ব্যানার্জি...."
ছেলেটিকে প্রশ্ন শেষ করতে না দিয়েই দোলন উত্তর দিলো, "প্রেসিডেন্সিতে একই ব্যাচ..... সহপাঠী।"
দোলনের নাম ঘোষণা হোলো, দোলন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে আনুষ্ঠানিক সম্বোধন শেষে শুরু করলো স্বরচিত গদ্যকবিতা পাঠ, দোলে দোদুল্যমান স্মৃতির পাতা থেকে একটি কবিতা---"গচ্ছিত".......
"তোমার জিনিসগুলি আমার কাছে গচ্ছিত আছে,
গোপন যত্নের লালনে তারা দিব্যই ঠিকঠাক আছে।
আসবে নাকি নিতে? আজ,কাল অথবা পরশু,
যেদিনই তোমার সময় হবে কিম্বা সময় তুমি পাবে।
যা কিছু আছে গচ্ছিত, সবই ভারী যত্নেই আছে,
হয় নি অতীত, আছে অমলিন, পড়ে নি ধুলোর পরত তাতে,
জমে নি এতটুকুও আভাসে কোথাও কোনো মরচে।
হ্যাঁ গো, সত্যিই, সে সবই ভারী যত্নেই আছে।
সেই যে সেবার ভিক্টোরিয়ার সামনে,
কাকভেজা তোমার শার্টের আলগা কাঁচা নীলরঙটা
আমার গোলাপী শাড়ি ছুপিয়ে দিলো,
ছাতা ফেলে দুজনে হাত ধরাধরি করে ভিজতে গিয়ে,
ঠিক তেমনি আছে, তোমার সেই নীল রঙও গচ্ছিত আমার কাছে।
তোমার মনে আছে? একবার যখন বাস থেকে নামার সময়.....
উঠে থাকা টিনের কোণায় তোমার চওড়া পাঞ্জা ফালা হয়ে কাটলো,
ভয়ে সিঁটিয়ে আমি সে রক্ত বন্ধ করতে চেপে ধরলাম আমার সাদা অরগ্যান্ডির আঁচল,
তাতে লেগে থাকা লাল একটু হয়েছে শুধু ফিকে, তবে আছে, অতীত যায় নি মুছে।
তোমার গচ্ছিত যা কিছু আমার কাছে,
তারা আজও ভারী যত্নেই রাখা আছে।
পারবে তো আসতে? নিতে ফেরত সেসব?
সব বন্ধন, সব আনুষ্ঠানিকতা, সব জড়তা পিছনে ফেলে?"
প্রবল হাততালির শব্দে অভিনন্দিত কবি দোলনচাঁপা বসু, চোখের কোণে দেখলো দোলন, বিবস্বানও হাততালি দিচ্ছে, যেন বড় ক্লান্ত হতাশ ধীর লয়ে।
(সমাপ্ত)