দেবতা
দেবতা


সেদিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই মুষলধারে বৃষ্টি নামলো।
সুনন্দা বারান্দার গ্রিলটা ধরে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছে।
-মা ও মা
সুনন্দার মা চিনু দেবী ঘর থেকে বেড়িয়ে এলেন,
-কি হয়েছে।
-মা দেখো কি জোড়ে বৃষ্টি পড়ছে। কি করি বলোতো।
-হ্যাঁ তাইতো দেখছি। আসলে গত দুদিন খুব রোদ ছিলো না তাই আজ বৃষ্টি।
-কিন্তু আমি এখন দেবব্রত স্যারের বাড়ির যাব কি করে। সামনের সপ্তাহেই আমার HS Test শুরু হবে, উনি সাজেশন দিতে চেয়েছেন। বারবার করে বলেছেন যেতে। কিন্তু এখন তো........ ধুর! ভাল লাগেনা
-আরে অন্য কারো কাছ থেকে সাজেশন নিয়ে নিতে পারবি না।
-ওহ মা, এই একই কথা যদি সবার মা-ই বলে তাহলে তো কেউই যাবেনা পড়তে। আর তাছাড়া দেবব্রত স্যার শুধু সাজেশন দেবেন না সবার প্রবলেম গুলোও সলভ করে দেবেন।
-তাহলে আর কি করবি। তোর সাথে আমি কথাতেও পারবো না আর তুই আমার কথাও শুনবি না। আমার ছাতা টা নিয়ে যা স্লিপার টা পড়িস বুঝলি আর কোয়ার্টার প্যান্ট টা পড়ে পড়তে যা। সাইকেল নিস না হেটেই যা।
-হুম আচ্ছা
মনে রাখিস তোর কিন্তু ঠান্ডার সমস্যা আছে। বৃ ষ্টির জলে বেশীক্ষণ ভিজলেই নিমেষের মধ্যে এমন জ্বর আসে যে অজ্ঞান হয়ে পড়িস। ভুলিস না আবার। আমার খুব ভয় করছে কিন্তু। থাক না যেতে হবে না আজ পড়তে।
-ওহ মা চুপ করোতো। আমি আর বাচ্চাটি নেই
সুনন্দা বরাবরই মেধাবী ছাত্রী, ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড কখনো হয়নি। তাই পড়াশোনার ব্যপারে খুব সিরিয়াস স্কুল,টিউশন কখনও সে কামাই করেনা।
সুনন্দা বাড়ি থেকে বেড় হয়ে দেবব্রত স্যারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
রাস্তায় খুব একটা লোকজন নেই। কোনমতে একটা রিক্সা নিয়ে সুনন্দা স্যারের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। ভাড়া মিটিয়ে কলিং বেল টিপলো।
ছাতা নিলেও সুনন্দার পায়ের দিকটা সম্পূর্ণ ভিজে গেছে আর এতো জোড়ে বৃ ষ্টি হচ্ছিলো যে মুখে জলের ঝাপটা লেগে প্রায় কাক স্নান হয়ে গিয়েছিলো।
শরীরটাও কেমন যেন দুর্বল লাগছিলো সুনন্দার।
ভেতর
থেকে দেবব্রত স্যার বেড়িয়ে এলেন,
-আরে সুনন্দা, আয় আয় ভেতরে আয়। পুরো ভিজে গেছিস তো।
-স্যার কেউ আসেনি পড়তে? বাইরেতো কারোর জুতো দেখলাম না।
- আরে বৃষ্টি শুরু হোলো দেখে আমি সবার বাড়িতে ফোন করে জানিয়ে দিলাম যে আজ আসতে হবে না। তোমার মায়ের নম্বরেও অনেকবার ফোন করেছি রিং হচ্ছিলো কিন্তু কেউ ধরছিলোই না।
সারা বাড়ি ফাঁকা, স্যার এখানে ভাড়া নিয়ে একাই থাকেন স্কুলটা কাছে হবার জন্য।
সুনন্দার কেমন যেন একটা অস্বস্তিবোধ হচ্ছিলো। একেই তার শরীর খারাপ লাগছে তার ওপর ফাঁকা বাড়ি। দেবব্রত স্যারের ব্যবহারও কেমন যেন ঠেকছে, একবার টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছিয়ে দিলো একবার ব্যাগ টা কাঁধ থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। স্যার এমন করছেন কেন?
-সুনন্দা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ? তুমি পাশের ঘরে গিয়ে বোসো। আমি তোমার জন্য গরম দুধ নিয়ে আসছি।
সুনন্দার পা যেন আর চলছিলো না কোনরকমে পাশের ঘরের চেয়ারে গিয়ে বসলো। সারা গায়ে যেন ভূমিকম্প হচ্ছে।
দেবব্রত বাবু এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে এলো সুনন্দার হাতে দিয়ে বললো নাও এটা খাও শরীরটা ভালো লাগবে।
তিনি সুনন্দার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন,
-ইসসস একদম ভিজে গেছো তো তুমি।
কি যে করি এখন?
সুনন্দা দুধটা সম্পূর্ন শেষ করতে পারেনা, চেয়ার থেকে নীচে পড়ে যায়। শরীর টা আর তুলতে পারেনা।
স্যার কি কিছু মিশিয়েছে নাকি দুধে? আমি এভাবে পড়ে গেলাম যে, মাথা তুলতে পারছিনা কেনো? চোখটাও ঝাপসা লাগছে যে।
স্যার কি করছেন,মোবাইল টা বেড় করছেন মনে হচ্ছে, উনি কাকে বার বার ফোন করছেন? আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না কেনো। সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আছে।
একি উনি আমায় ভিডিও করছেন কেনো। স্যার আপনি এতো বাজে আমাকে একা ডেকে এনে আমার সাথে কি করতে চাইছেন আপনি। ভগবান ভাবতাম আমি আপনাকে আর আপনি।
একি চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেলো কেনো। লোডশেডিং হোলো নাকি স্যার ইচ্ছে করে আলো নিভিয়ে দিলেন। ছিঃ ছিঃ স্যার কি করছেন আপনি আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে।
সুনন্দার চোখ বন্ধ হয়ে আসে, সে শুধু অনুভব টুকু বুঝতে পারে, কেউ যেন তার পোশাক পালটে দিচ্ছে, গা মুছিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু চোখ খুলে দেখার ক্ষমতা টুকুও নেই।
শুধু মনে মনে স্যারের প্রতি তার ঘৃ ণা বেড়ে যাচ্ছিলো। কে জানতো যাকে সে দেবতা মনে করে সেই আসলে এক নরপিশাচ।
-একি স্যার ছেড়ে দিন আমায়। ছেড়ে দিন বলছি। ভালো হচ্ছে না কিন্তু.. একটা শীতল চুম্বন সুনন্দার কপাল স্পর্শ করে সুনন্দা চমকে চিৎকার করে ওঠে I hate you, i hate you
-কি হয়েছে মা। অমন চিৎকার করে উঠলি যে, খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস নাকি।
সুনন্দা দেখে সামনে তার মা চিনু দেবী বসে আছেন।
-মা তুমি কখন এলে।
-সে তো ঘন্টাখানেক হোলো এসেছি।
-তোর স্যার ফোন করলেন। তুই তো তোর মোবাইল টা তোর ঘরে ড্রয়ারে রেখেছিলি, স্যার অনেকবার ফোন করেছিলেন আজ পড়তে না আসার জন্য কিন্তু আমি তো রিংটোন শুনতেই পাইনি। তুই চলে আসার পর চিন্তা হচ্ছিলো তোকে নিয়ে, তাই স্যারকে ফোন করবো বলে তোর ঘরে ফোন খুজছিলাম, পাচ্ছিলাম না, প্রায় আধঘন্টা পর যখন স্যার ফোন করলেন তখন মোবাইলটা খুজে পেলাম। দেখি উনি ভিডিও কল করেছেন তোর ওমন অবস্থা দেখে উনি ঘাবরে গেছিলেন তাই আমাকে যেতে বললেন।
আমি এসে দেখি তিনি ততক্ষনে পাশের বাড়ির কল্যান বাবুর মেয়ে দিশানী কে নিয়ে এসেছেন সেই তোর জামা কাপড় ছাড়িয়ে ওর একটা কামিজ পড়িয়ে দিয়েছে।
সুনন্দা এতক্ষণ নির্বাক হয়ে সব শুনছিলো। কারণ তার কাছে বলার মতো কোন কথা ছিলোনা।এবারে সে মুখ খুললো।
-তুমি কি করে জানলে যে দিশানীই আমার জামা কাপড় ছাড়িয়েছে।
-আরে দিশানী তো কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি গেলো আর তাছাড়া যতক্ষণ আমি আসিনি ততক্ষণ উনি আমাকে ভিডিও কলিঙে রেখেছিলেন।
-মা স্যার কোথায়।
-উনি তো ঘরেই একটা ট্যাবলেট ছিলো সেটা দিয়ে বাইরের ঘরে গেলেন, উনি খুব চিন্তা করছেন তোকে নিয়ে। তাই ডাক্তারকে ফোন করছেন।
বারবার বলছেন ওনার জন্যই তোর এই অবস্থা।
সেই ওষুধ খেয়েই তোর গায়ের জ্বরটা একটু নেমেছে। ভালো লাগছে? তোর এখন?
-হুম, শরীর তো ঠিক আছে মা কিন্তু মনটা যে বড্ড ভাড়ি লাগছে (সুনন্দা মনে মনে বললো)।
-স্যার!
-আরে সুনন্দা বিছানা ছেড়ে উঠে এলে কেনো? শরীর ঠিক আছে তো?
-আমি ঠিক আছি স্যার। আমি এখন অনেকটাই সুস্থ।
সুনন্দার পাশে চিনুদেবী এসে দাড়ালেন।
-মা বাড়ি চলো।
-পাগলি মেয়ে একটা। পড়াশোনার জন্য কি নিজের শরীরের খেয়াল রাখবে না নাকি হুম, স্যার বললেন।
যাও বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম নাও। এরপর আর তোমাকে আসতে হবে না আমি যাব তোমার বাড়িতে লাস্ট সাজেশন দিয়ে আসবো ঠিক আছে।
সুনন্দা মাথা নাড়ে, কিছু বলে না।
ততক্ষণে সুনন্দা মনে মনে নিজেকে কয়েকশো ঘা নিজের গালে থাপ্পড় মেরেছে। কারন সমাজে যে সবাই অসুর রাবণ নয় ভগবান সত্যিই আছেন অন্তত এই দেবব্রত স্যারের মধ্যে তো আছেনই আর এমন মানুষ কে সে কিনা.....
নিজের জীবনে করা চরম ভুল টা সে আজ এই স্যারের সামনেই মনে মনে অবনতমস্তকে সংশোধন করে নিল।