Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!
Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!

Subrata Sarkar

Abstract Drama Tragedy

0.2  

Subrata Sarkar

Abstract Drama Tragedy

ঢাকি

ঢাকি

6 mins
18.4K


ভোর ভোর থাকতেই উঠে পড়েছিল মধুসুদন দাস । বাইরে নিকনো দাওয়া ঘেঁষা তুলসি গাছটায় হালকা ভেজা শিশিরের পরতটা দেখে আন্দাজ করে নিল ঠাণ্ডাটা । ঘরে ঢুকে অন্ধকারের মধ্যেই ময়লা চাদরটা খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে এল, কিন্তু গায়ে জড়ানো হলনা । উঠোন পেরিয়ে ঢুকল কোনের ঘরে । ঢাকটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখে নিল এপাশ ওপাশ । শান্তি লাগলো । নাহ্ , ঠাণ্ডায় কাবু হয়নি...আর তক্ষুনি শেফালি ফুলের গন্ধটা নাকে এসে লাগলো ।


একটা মনখারাপ লেগেছিল বাড়ির গাছটা বড় ছেলে জেদ ধরে কেটে ফেলার পর। শুঁয়োপোকা হয়না এমন সজনে গাছ শেফালি গাছ গা-গেরামে নেই । তাই বলে অবলা গাছটাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে ? কে শোনে কার কথা ! ষাট পেরনো মধু ঢাকির বাড়িতে সে নিজেই এখন ঢাকের বায়া । ছেলে পল্টন এখন বকলমে বাড়ির কত্তা । পল্টন হোলো গে তাসা মাস্টার । পাঁচ গাঁয়ের লোক চেনে, পুজো পাব্বনে সদরের ভোট জেতার মিছিলে ডাক আসে ...বাপের ওপর চোটপাট করতেও বিরক্তি তার । গাছ কাটার কৈফিয়ত দিতে , ওই কথাটা বলায় এমন তাচ্ছিল্য ছিল যে , মধুর নিজেকে শুঁয়োপোকা মনে হয়েছিল । ঢাকটা রোদে দিয়ে চুপ বসে ছিল কাটা গাছের গুঁড়িটার দিকে তাকিয়ে ।


তারপর থেকে আর ভাবতে চায়নি গাছটার কথা । আজ পঞ্চমীর সকালে নেতাই মণ্ডলের বাড়ির দিক থেকে ভেসে আসা গন্ধ আবার মনে পড়িয়ে দিল বাড়ির গাছ না থাকলেও শরত আসে, পুজো আসে । চাদ্দিকে সোনা সোনা আলো ঢেলে মা নিজেই জানিয়ে দেন ...'মধু রে , আর দেরি করিসনি বাপ, ঢাকের ছাউনিটা সেরে ফ্যাল দিকিন এই বেলা ।'


তা মধুকে বলতে হয়না এসব কথা । পল্টন গেছে যাক চুঁচড়োর প্যান্ডেলে, মধু ঢাকি এই গেরামেই থাকবে জেবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত । যদ্দিন শরীল দেবে মাজদিয়া বাজার কমিটির পুজোয় মধু ঢাকি বোল তুলবে নেচে নেচে ।


রথের সময়েই বায়না হয়ে গেছিল । মনে পড়ল বাজার কমিটির সেকেটারি , সারের দোকানের বিলাস দত্ত বাবুর আদেশ... মধু তালি ওই কতাই রইলো খন... বোধনের আগে পৌঁছে যেতি হবেনে, দেখিস যাতে বেত্যয় না হয় ।


হবার যো নেইকো । বড় মানুষের কথার দাম রাখা মধুর ধম্ম । তাই আগের দিন সকাল থেকেই মধু সাজো সাজো রব তুলল । বউমাকে ডেকে উঠোন নিকনোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে, কাঁসিটা নিয়ে চলল নদীর চরায় । সাদা বালিতে ঘষতে ঘষতে আর মুখে বোধনের বোল তুলতে তুলতে যখন হুঁশ ফিরল... সুয্যি তখন চড়ে গেছে বেশ খানিকটা ।


ভেজা গায়ে ফিরে এসে ঢাকটা রাখলো উঠোনের মদ্যিখানে । অঙ্গসজ্জার লাল কাপড়ে মুড়লো তাকে, ঝালর পরাতে গিয়ে মনটা উসখুস করলো । ইচ্ছে ছিল বক পাখির পাখনা লাগাবে, ছেলেকে বলতে খচ্চার বহর শুনে বুকের কাছটা চিনচিনিয়ে উঠেছিল । মুখের কথা মুখেই রেখে পুরনো টাকেই সাবান জলে ধুয়ে নিয়েছিল ।


#


বেলায় বেলায় বেরিয়ে পড়ল মধু আর তার নাতি । নদীর চর ধরে খানিক এগোতেই নাতি ছুটল কাশফুল ছিঁড়তে ।


মধু হা হা করে উঠলো... 'ছিঁড়িসনে দাদু, ছিঁড়িসনে ।'


--- বুনের জইন্যে লিয়ে যাই কেনে ?


--- কাশফুল উপড়ালি আর থাকেনা দাদুভাই । সব ফুল ডানা মেইলি হাওয়াতে ভেইসি যায় ।


পাঁচ বছরের নাতি বিমর্ষ মুখে দাদুর পেছনে হাঁটতে থাকে । মধুর মাথায় তাল ঘোরে । আনমনে হাতের কাঠি ছুঁয়ে যায় ঢাকের শরীর । ট্যাটাং ট্যাটাং আওয়াজে চমকে চমকে ওঠে গাঁড়াডোবার মাঠের বিকেল শালিকেরা । আর প্রশ্নহীন শিক্ষানবিস নাতি কাঁই নানা কাঁই নানা করে কাঁসি বাজিয়ে দ্যায় । আর তারপরেই একফোকলা মুখে দাদু হেসে ফেলে নাতির দিকে তাকিয়ে । নাতির দুধের দাঁতের হাসিতে তখন কাশফুলের শুভ্রতা ।


মাঝরাস্তায়ে পরে বগুলা ইষ্টিশন । রেল লাইনের ওপর দিয়ে হেঁটে যায় মধু ঢাকি আর তার নাতি । সন্ধে ঘনিয়ে আসা আলোয় ছায়া পড়েনা । ঝাপসা অন্ধকারে ভয় ভয় করে নাতির । দাদুর পায়ে পা মেলাতে ছুটতে হয় তাকে। হঠাত মাথার কাছে বিকট শব্দ শুনে ককিয়ে ওঠে সে...


---- কি হইল বাপ ?


---- ঝড়াম কইর‍্যি কি পইড়ল্যো দাদু


--- কুণ্ঠে


--- হুই যে ... দশহাত দূরে মাথার ওপর দিকে কচি হাতটা তুলে ধরে অন্য হাতে দাদুর ধুতি আঁকড়ে ধরে নাতি ।


সেখানে জ্বলজ্বল করছে সবুজ আলো । ফোকলা দাঁতে হো হো করে হেসে ফেলে মধু । আওয়াজ বেরোয় ফো ফো... নাতিকে ভরসা দিতে বলে...


----- বুইল্যিনে ! উটা সিংগেল


--- কি বুইল্যছো ?


--- আরেহ... টেরেন গাড়ি যাবার সিংগেল


অজ্ঞ নাতি বোঝে ভয় পাবার কিছু নেইকো । কিন্তু পেছন ফিরে তাকাতে ভয়...সামনের দিকেও। যদ্দুর চোখ যায় একটার পর একটা একচোখা দানো সবুজ চোখ মেলে তাকিয়ে আছে । দাদুর পায়ে চোখ রেখে দুই প্রজন্ম দ্রুতলয়ে এগিয়ে চলে পাথুরে পথ ধরে.....দুগগা মা আসছেন যে... কাল সকালেই মায়ের বোধন ।


#


সকাল থেকে অন্য এ এক অন্য মধু । মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতর টা ভিজে ওঠে তার। বাস্পরুদ্ধ গলায় বলে ফেলে ... 'তবে এলি মা...কষ্ট হয়নি তো ?'


বলেই লজ্জা পায়। এদিক ওদিক দেখে । কেউ শুনে ফেলল না তো ! মন দিয়ে দেখে মায়ের কাপড়...ছেলে মেয়ে গুলোর সাজ। কাত্তিক তা লবাবের ব্যাটা হইয়েচে দ্যাকো ! আর গনশাডা কি এট্টু রুগা হইলো ।


তবে হ্যাঁ, সব মিলিয়ে মেয়ে খেয়ে পরে ভালই আছে শশুর ঘরে । শান্তিতে মনটা নরম হয়ে ওঠে । ভাঁড়ের চা ঠাণ্ডা হয়ে আসে, মুড়ির ঠোঙাটা আধ খাওয়া পড়ে থাকে কোল ঘেঁষে । মধু মেয়ের মুখ দেখে আর পুরোহিত ঠাকুরের পায়ে পায়ে ঘোরে ।


হাতের আঙুলে ঢাকের আওয়াজে কথা বলে ওঠে মন । ড্যাডাং ড্যাডাং করে চেঁচিয়ে উঠে বলে ... দ্যাকো হে...সব্বাই এইসে দেইখি জাও, মা এইয়েচে বাপের ঘরে । পঞ্চব্যাঞ্জনে কাঁসার থালা পেইতি খেইতে দাও মেইয়িডারে ।


পুজো এগোয় । সারাদিন মণ্ডপের কোনে বসে থাকে দাদু আর নাতি । গাঁয়ের লোকজন ব্যাস্ত নিত্যকার সংসারের কাজে । দু চার জন বৌ ঝি আসে যায় । বাচ্চারা হুটোপাটি করে সারাবেলা । পথ চলতি মানুষ থমকে দাঁড়ায় । কপালে হাত জোড় করে । মধু ঢাকি একবার তাদের দ্যাখে, একবার ,মায়ের মুখ । হাতের কাঠি আপন নিয়মে বেজে ওঠে ঠাকুরমশাই এর ঘণ্টার সাড়া পেলে ।


সন্ধে হলে ঢাকটাকে কাঁধে তুলে নেয় মধু । ঠাকুর মশাই আরতির লগ্ন ঘোষণা করা মাত্র টান টান হয়ে ওঠে ষাট পেরনো ন্যুজ্ব শরীর । তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে মাতন লাগে । মা আসচেন , মা আসচেন এইবার । আগমনী বোলে যেন চুক না হয়...ছন্দ যেন না কাটে । মৃন্ময়ী মুখের দিকে তাকিয়ে শিহরিত হয় মধুর পা থেকে মাথা । অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় কাত্তিকের কুয়াশার বেশ ধরে মা সবার মাথার ওপর দিয়ে এসে মিশে যাচ্ছেন আলোর শরীরে । নাচতে নাচতে ঢাকের বুকে মুখ গুঁজে দ্যায় মধু ঢাকি । ধুনুচির ধোঁয়ায় চোখ জ্বলে যায় রে বাপ...আমি আর কান্না করতে পাইরবুনি এই বচ্ছরকার দিনে !


বিজয়ার লগ্ন চলে আসে । আজ আর মধুর গায়ে জোর নেইকো । পায়ে পায়ে তবু এগিয়ে যেতে হয় গড়াই নদীর ঘাটে । হাত চলে না , পা চলে না । অচেনা জ্বরে শরীলডা ব্যাদনাবিষ হইয়ে আচে । সবাই হাসে, নাচে, কোলাকুলি করে । মধু শুধু ঢাকের বোলের সঙ্গে সঙ্গে বিড়বিড় করতে থাকে......অপরাধ নিসনি মা । আমধ্যিরাতে খালি মণ্ডপের কোনায় পরনের ধুতিটাকে মুড়ে শুয়ে থাকে মধু ঢাকি আর তার পাঁচ বছরের নাতি । কাল সক্কাল হলেই ফিরে যাওয়া নিজের গাঁয়ে । ঘুম চারদিক শুন্য করে মা চলে গেছেন কৈলাসে । মহাদেবের খুব অসুবিদে হইলো গো ই-কদিন। উমা গিয়ে আবার হাল ধইরবেন সংসারের । এসব ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে আসে মধু ঢাকির। ঘুমের ঘোরে পাশ ফিরতে গিয়ে নাতির হাত পরে শব্দ করে ওঠে নিথর ঢাক ।......বাজাসনি...ওরে আর বাজাসনি দাদু আমার । মা চলে যাচ্চেন রে দাদুভাইমা আর মেয়ে একাকার করে হাউ হাউ করে কেঁদে ফ্যালেন বুড়ো বাপটা । মাজদিয়া বাজারের চৌহদ্দি পেরিয়ে ফাঁকা মাঠ আর কলাই ক্ষেতের ওপর দিয়ে মাঝরাতের কুয়াশায় ভেসে ভেসে দূরে চলে যায় সেই কান্না ।

এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ান উমা । সামনে পা বাড়ান ।

'এই আওয়াজ শুইনলি পরে , মায়ের আমার পায়ে বেড়ি পইরব্যে ! হুঁচোট খেইয়্যে পইরবে মা আমার ।' আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনা মধু । ঘুম আসেনা দাদুর, ঘুম আসেনা নাতির । টিমটিম করে একটা প্রদীপ জ্বলতে থাকে মায়ের খা খা থানে ।

বার আসিস...আবার আসিস মা রে .........ইবার লিজের হাতে শেফালি গাছ লাগাবোখন উঠোন জুড়ে ।


Rate this content
Log in