Subrata Sarkar

Drama

2  

Subrata Sarkar

Drama

পশ্চিমের জানালা

পশ্চিমের জানালা

3 mins
9.9K


লিখতেই হবে তোকে নইলে এই যে দেখছিস... চেয়ারের একটা ভাঙা পায়া কে পাশ থেকে তুলে টেবিলের ওপর রাখল তমাল । টেবিলের ওপারে আমি তেতো মুখ নিয়ে বসে মগজে জোর ডালছি প্রাণপণে । বাইরে ঝমঝম করে তাসা-ব্যাঞ্জো শুরু হয়ে গেছে ।

১৯৮৫ এর নভেম্বরের কোন’ এক বিকেলের কথা । নবদ্বীপে রাস-এর আগের দিন ছিল সেটা।

বকুলতলা সায়েন্সের টুয়েল্ভথ্ এর ব্যাচ-এর আমরা । সেদিন ছিল টেস্ট এগজামের শেষদিন। পরীক্ষা দেব কি , সকালে স্কুলে এসেই ক্লাসমেট তমাল হুমকি দিয়ে রেখেছিল সন্ধের মধ্যে ওর অর্ডারি ক’বতে না পেলে বাবার নাম খগেন করে দেবে । ওর কে এক পাড়াতুতো বা বন্ধুতুতো দিদির বে হয়ে যাচ্ছে । তাতে ওর হৃদয় অতিশয় ভারাক্রান্ত এবং দিদির বিহনে ওর বেঁচে থাকা প্রায় মাথাহীন ছাতার মতই অকিঞ্চিৎকর । এই কথাগুলো ক’বতের ভাবে প্রকাশ করতে হবে , যেটা ও ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিদির করকমলে তুলে দেবে বিয়ের দিন ।

কিছুদিন আগেই অসীমের সীমা নেই, অরুণের দীপ্তি / সুব্রত খুঁজে ফেরে কোথা তার তৃপ্তি ... টাইপের এক বিধ্বংসী নজরুল ঘরানার পদ্য লিখে বন্ধুমহলে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছি । স্কুল গেটে শঙ্করদার ঘুঘনি , বাবাজির আচার ভেট পাচ্ছি প্রায়ই , অনেকের হৃদয় তোলপাড় করা বোবা আবেগকে ভাষা দিতে । স্কুলের জানলা দিয়ে দৃশ্যমান দু’হাত দূরে তারাসুন্দরী গার্লসের কটাক্ষে রোজ কারো না কারো ইয়েতে ধ্বস নামছে ।

ঠিক সময়ে ঠিক লাইনটা চুজ ক’রে আমিও দু-চারানার ব্যাবসা করছি মন্দ না। কিন্তু তমালের আব্দারের ধরণটায় আমাদের সম্পর্ক সেই যে একটা দুশমনিতে মোড় নিল , অনেকদিন পর্যন্ত থেকে গেছিল সেটা ।

যাকগে , যা বলছিলাম । কোনরকমে তমালের বেদনার আখ্যান লিপিবদ্ধ করে কোনে একটা গুলাব কা ফুল আঁকতে যাচ্ছি... ও ছিনিয়ে নিল সেটা। ব্যস ব্যস ব্যস... তোর রাইটিং এ হবেনা, প্রফেশনাল আর্টিসকে দিয়ে লিখিয়ে তারপর বাঁধাবোখন ।

হইহই করে নেমে এলাম আমরা তিনতলার ঘর থেকে । আমি গোপাল তমাল সৈকত শান্তনু চিন্ময় অধীর অন্যরা। অফিসিয়ালি আজকেই হয়ে গেল বকুলতলার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি । মাঝে একদিন আসতে হবে অ্যাডমিট কার্ড নিতে । মরুকগে । আজ রাস...নো মোর সেন্টি... তমালের প্যাঁচালপারা ক’বতে অনেক আশু বইয়ে দিনটাকে গাধার গাঁলে পাঠিয়েছে .........আর না !

বাঁদুড়তলার গলির শেষমাথায় পৌঁছতেই দিগ্বিদিক কাঁপিয়ে বেজে উঠলো মাইকের গান। নবদ্বীপের রাস , রাসের গান। সৈকত হঠাৎ রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নেচে উঠলো । তারপর ডানদিকে টার্ন নিয়েই সুবোধ বালক হয়ে সুড়সুড়িয়ে বাড়িতে ঢুকে গেল । গেটে বাবা , মানে কলেজের রাশভারি ইকনমিক্স স্যার এম.এস. দাঁড়িয়ে ।

তমাল বাঁয়ে মুড়ে চলে গেল পাকাটোলের দিকে। সেই যে বামাবর্তী হল তারপর থেকে মারকুটে সিপিএম হয়েই রয়ে গেল। শান্তনুও বাড়ি ঢুকে গেল নারকোল গাছের ফাঁক গলে। থেকে গেলাম আমি গোপাল চিনু’রা । কে কত বড় জিতেন্দ্র ফ্যান , জয়াপ্রদা কি একটু ফ্রিজিড্ টাইপ এসব নিয়ে গুলতানি চলছে । কে সাদা জুতো কিনেছে... গ্ল্যামার নাকি জুপিটার ( টেলার্স ) কে সাদা প্যান্ট ভালো বানায় এসব নিয়ে চিল-চিৎকারের মধ্যেই আমি ইমেজ মেইনটেইন করছি ।

বাঁদিকে রমেন পালের স্টুডিও , ডাইনে শ্রীগুরু কুঞ্জ আশ্রম পেরোলেই যে সেই পশ্চিমের জানালা । মনে আছে , সেটা পেরোতেই আমিও নেচে নিয়েছিলাম একপাক ।

রস থেকে রাস , হাজার গোপিনী , পুনম-কি-রাত , শাক্ত-বৈষ্ণব দ্বন্দ্ব , কৃষ্ণচন্দ্র রাজা কিছুই জানতাম না তখন । শুধু দেখতাম হাজার হাজার মানুষ নাচছে একটা এঁদো শহর জুড়ে । তাদের সেই একক বা বৃন্দনাচে মিলে আছে নিজস্ব লোকাচার , ফসল তোলা শেষে ঘরে ফেরা মানুষের ক্লান্তিভোলা আমোদ, মাটির দাওয়াতে চালের গুড়ো জলে গুলে আঁকা নবান্নের লৌকিক আল্পনা ।

আজ খুব মনে পড়ে সেই দিনগুলো। সেই গান, গন্ধ ,বন্ধুদের হইচই । পশ্চিমের জানলাটাকেও ।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama