Subrata Sarkar

Drama

2  

Subrata Sarkar

Drama

অঞ্জন’দার গল্প

অঞ্জন’দার গল্প

3 mins
4.2K


গল্পটা ঠিক অঞ্জন’দার নয়...অনেক পুরনো একটা সময় এর গল্প । অবিবেচক একটা সময়ে হঠাৎ কি করে আলাপ হয়েছিল অঞ্জন’দার সঙ্গে, সেই স্মৃতি রোমন্থন ।


কালীপূজো’র গায়ে গায়ে লেগে থাকা রাস উৎসবটা হয়ে গেলেই ঝপ করে তখন সন্ধে নামত নবদ্বীপে । কেমন একটা শান্ত সুর খেলত আমাদের গেঁয়ো শহরটায় । সারাদিন...কোন ব্যাস্ততা নেই কোথাও যেন । মন্দিরে মন্দিরে অষ্টপ্রহর কৃষ্ণনাম নেই ...পুরনো শ্যাওলা ধরা বাড়িগুলোর ছাদে আকাশপ্রদীপ নেই, ঘুড়ি ওড়া আকাশ নেই, তাসা-ব্যাঞ্জো’র আওয়াজ নেই..... শহরের মন যেন সেই মেয়েটার মনখারাপের মত ,যার স্বামী পূজোর ছুটির শেষে ফিরে গেছে দূর শহরের সওদাগরী অফিসে । সব কাজে সব অবসরে আলতো ভাবে ছুঁয়ে আছে ক’দিন আগের স্মৃতি । খেয়াঘাটের নৌকোয় , ব্যাস্ততাহীন রেলষ্টেশানে , স্কার্ফে কানঢাকা টিউশ্যান থেকে ফেরা কিশোরীর গলির মুখে হঠাৎঅদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পর , সাইকেল কিশোরের এবার কি করি’র দিশাহীন শূন্যতার মত বাঁশি বাজিয়ে শীত নামত আমাদের শহরে ।


সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে দাঁড়িয়েছিলাম কলেজ গেট আর হিন্দুস্কুলের মাঝের করাত কলটার সামনে । ১৯৮৫ এর শেষাশেষি একটা বিকেল । HS দেব…পড়াশুনার চাপ আছে কিন্তু তাড়া নেই । মনখারাপ…মনখারাপ ভাবটা কাটছেই না ক’দিন ধরে । হঠাৎ দেখা বিদ্যানগর স্কুলের এক ছাত্রের সঙ্গে, যে পরশুরাম স্যার এর বাড়িতে আমার সহপাঠী । কিছু করার নেই শুনে বলল …চল তবে আমার সঙ্গে…আমাদের স্কুলের মাঠে সার্কাসের তাঁবু ফেলেছে …দেখে আসবি ।


বলা মাত্র প্যাডেলে চাপ…রাস্তায় দেখা তমালের সঙ্গে…কথা বলার সময় নেই । ওলাদেবীতলা …রেললাইন পেরিয়ে …গাছের ছায়া ঘেরা শ্রীরামপুর এর মজা খাল আর পানাপুকুর এর পাশ দিয়ে বর্ধমান যাবার রাস্তায় পড়তেই অন্ধকার নামলো । আবছা আলো, ভারী হয়ে আসা কুয়াশা মেশা বাতাসে তখনো ফেলে আসা বাজি’র গন্ধ । হেমন্তের খা খা মাঠ আর সারি সারি খেজুর গাছের পাশ দিয়ে আমরা দুজন তখন ছুটছি মুক্তির বেগে । চাঁদপুর থেকে বা’দিকে বিদ্যুতগতিতে টার্ন নিয়ে একটু এগিয়েই বিদ্যানগর স্কুলের হস্টেলের গায়ে সাইকেলটা দাঁড় করানো…আর ঢুকে যাওয়া আলো ঝলমল তাঁবুর ভেতরে । সার্কাসের ব্যান্ডমাস্টার তখন সিন্থেসাইজার এ ঝড় তুলেছেন……এ ভাই, জরা দেখ্ কে চলো ………


দেখা হল সার্কাস । রাত দশটা বাজে তখন । বন্ধু বলল, 'এত রাতে আর কি করে ফিরবি এতটা রাস্তা, ঘুমিয়ে পর আমাদের সঙ্গেই…সকালে এক সাথে যাব স্যারের বাড়ি । 'বয়সোচিত প্রস্তাব আর সময়োচিত সম্মতি । থেকে গেলাম হস্টেলে ।


খাবার ঘরে দেখা অঞ্জন’দার সঙ্গে । আলাপ করিয়ে দিল বাকিরা । বিদ্যানগর স্কুলের মাস্টারমশাই । হোস্টেলের ইনচার্জ শুনে উনি ভাসা ভাসা চোখে বিস্ময় ফুটিয়ে তুলে বললেন…'থেকে যাবে ! ও আচ্ছা……রাত করোনা আর। ঘুমিয়ে পরো ।'


রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল অঞ্জন’দা ই । আমরা কেউই ঘুমোই নি তখনো । বিড়ি সিগারেটের ধোঁয়ায় অন্ধকার সেই ঘরে আমাদের সঙ্গে রাত জাগছে বাইরে অজগাঁয়ের বাশঁবাগান আর ভয় পাওয়া কুকুরের ডাক । সেই সময় হস্টেল জুড়ে শোরগোল…দোতলার ঘরে যন্ত্রণায় কাতড়াচ্ছেন অঞ্জন’দা । কিছু ছাত্র অসহায় হয়ে চেষ্টা করছেন প্রিয় স্যারের কষ্ট কমাতে……গ্রাম্য টোটকা চিকিৎসায় ।


কষ্টের মধ্যেই ভোর এল। শেষব্দি চাঁদপুর গ্রামীণ হেলথ সেন্টারে নিয়ে যেতে হয়েছিল অঞ্জন্দা’কে । আমি সেই শীতের কুয়াশা মাখা ভোরে একা ফিরেছিলাম নবদ্বীপে । বাড়ির সামনে তখন ভিড়ে ভিড়াক্কার । আমার কৌতূহল কেড়ে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল মা । বোমাবাজি খুন আর অস্থির রাজনীতির নবদ্বীপের সন্ধায়… এক রাতের জন্য হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পাবার আনন্দে।


পরদিন খবর পেলাম অঞ্জন’দা সুস্থ ।


তারপর অঞ্জন’দাকে দেখি দু’বছর পর ইউ সি সি ’র এক আলোচনা সভায় । প্রথমেই জানতে চেয়েছিল……বাড়িতে বলে এসছিলে সেদিন ? মা কে খুব কাঁদিয়েছ , না ?

অনুতাপে ভুগেছিলাম হস্টেল সুপারিন্টেনডেন্টের সহজ প্রশ্নে !------------- আজ অনেক অনেক দিন পরে, অঞ্জন’দা যখন ফেসবুকের দেওয়ালে কোন সহজ প্রশ্ন রেখে যায়, বিস্ময় জাগে সেই সহজ মানুষটার এত সহজ থেকে যাওয়া দেখে !


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama