দায়িত্ব
দায়িত্ব
প্রিয়,
পত্রলেখা,
কেমন আছো? আশা করি ভালোই আছো। দীর্ঘ দুমাস তোমার সাথে কথা হয়নি। কাজের চাপে ব্যস্ত ছিলাম। মাঝে মাঝে অবশ্য বাবার সাথে কথা হয়েছিলো। অনেক চাপের মাঝেই তোমাকে চিঠি লিখছি, চিঠি লেখার অবশ্য কারণও আছে। আসলে ব্যস্ততা ঠিক নয়, তোমার সাথে কথা বলার মতো পর্যাপ্ত সাহস জোগাতে পারিনি। তাই অনেক দেরীতে হলেও নিরুপায় হয়েই কলমের আশ্রয় নিতে হোলো। বলতে পারো চিঠির মাধ্যমে এক স্বীকারোক্তি। প্রায়ই বাবা জিজ্ঞেস করেন, কবে বাড়ি ফিরবো, আর আমি প্রতিবারই উত্তর দিয়েছি খুব শীঘ্রই ফিরবো। কিন্তু সত্যিটা তোমায় বলছি, বাবার বয়স হয়েছে তাই মিথ্যে তাকে বলতে পারবো না। সত্যি বলতে আমার আর বাড়ি ফেরার ইচ্ছে নেই। দুবছর হোলো জাপানে এসেছি, তুমি তো জানোই আমার বড় ব্যবসায়ী হওয়াটা কত্ত বড় স্বপ্ন ছিলো, তুমি জানলে খুশি হবে যে এই দু বছরে আমি এখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছি। এখানে আমাকে ব্যবসার ক্ষেত্রে মিস্টার মাইতোসি খুব সহোযোগিতা করেছেন। হ্যাঁ আমি জানি মা বাবা আমায় জন্ম দিয়েছেন, আমায় পড়াশোনা শিখিয়ে শিক্ষিত করেছেন, অনেক কষ্ট করেছেন তারা আমার জন্য, কিন্তু আমারও তো আলাদা জীবন আছে,স্বপ্ন আছে, আমি মধ্যবিত্ত হয়ে সারাটা জীবন কাটাতে পারবো না। আমার ওই ছোট্ট ঘরে দম বন্ধ হয়ে আসতো, তাই আমার আর ও বাড়িতে ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছে নেই। তবে হ্যাঁ যদি টাকার প্রয়োজন পড়ে ফোন কোরো আমি ব্যাঙ্কে টাকা পাঠিয়ে দেবো। আর তুমি তো আছোই বাবা মায়ের খেয়াল তুমি একাই রাখতে পারবে। ওহ সুপ্রীতি নিশ্চই এই দুবছরে অনেকটাই বড় হয়েছে। যখন এসেছিলাম তখন তো ও পুতুল নিয়ে খেলতো। যাই হোক আর বেশী কিছু লিখবো না। তোমাকে চিঠি লেখার আর একটা কারণ আছে, সেটা হোলো, মিস্টার মাইতোসি মানে যিনি আমায় ব্যবসার ক্ষেত্রে সহোযোগিতা করেছেন তার একমাত্র মেয়ে শার্লিন তার সাথে আমার আগামী সপ্তাহে এনগেইজমেন্ট, হ্যাঁ তার কয়েকদিন পর আমি তাকে বিয়ে করছি। না, পত্রলেখা আমি তাকে বলতে পারিনি আমি বিবাহিত, আমি বলতে পারিনি আমার আট বছরের একটি মেয়ে আছে। আমি শুধু তাকে এইটুকুই বলেছি, আমি ধনী হতে চাই, বড় প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হতে চাই, তিনি আমায় আমার স্বপ্ন পূরণ হতে সাহায্য করেছেন, তাই আমিও তার শর্ত মতো তার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হই। তুমি হয়তো এই চিঠি পড়ে একটু কষ্ট পাবে, কিন্তু এর জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি স্বীকার করছি যে তোমার সাথে অন্যায় করছি, কিন্তু বিশ্বাস করো ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। চাইলে তোমায় মেইল বা ম্যাসেজ করতে পারতাম কিন্তু শার্লিন সব সময় আমার মোবাইল চেক করে তাই চিঠি লিখলাম।মা বাবা কে আমার প্রণাম জানিও। আজকের মতো এখানেই শেষ করছি, পরে আবার চিঠি লিখবো কি না জানি না। আর মা বাবা কে আমার না ফেরার কারণ কি বলবে সেটা তুমি নিজেই ভেবে নিও।
ইতি
পুষ্পরাগ
চিঠি খানা পড়া শেষ করেই পত্রলেখা চিঠি টিকে একটি ডেলা পাকিয়ে দূরে ছুড়ে ফেলে দিলো। আর দু হা
ত দিয়ে মুখ ঢেকে উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে সোফাটা ঘেষে নীচে বসে পড়ে। দু নয়ন দিয়ে অশ্রুধারা বয়ে যেতে থাকে।
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে কান্না থামায়, পেছন ফিরতেই পত্রলেখা দেখতে পায় শ্বশুর মশাই দাঁড়িয়ে, পেছনে শাশুড়ি মাও দাঁড়িয়ে।
-স্কুল থেকে কখন এলে বৌমা?
-এইতো বাবা কিছুক্ষণ আগেই এলাম।
আর এসেই টেবিলের ওপর আমার নামের চিঠিটা দেখতে পেলাম আর......
-কিছু মনে কোরো না বৌমা, বাবুর চিঠি দেখে আর কৌতূহল ধরে রাখতে পারিনি। তাই তোমার অনুমতি ছাড়াই চিঠি খানা পড়ে ফেলেছি।
আৎকে ওঠে পত্রলেখা।
-কি বলছেন বাবা, আপনি.....
-হ্যাঁ মা আমি সবটাই জেনে গেছি, সত্যব্রত বাবুর চোখটা ছল ছল করে ওঠে।
-আসলে আমি তোমার বাবাকে বললাম চিঠিটা পড়তে, কিন্তু আগে যদি জানতাম.....
ডুকরে কেঁদে ওঠেন শ্রীময়ী দেবী।
একি মা, বাবা আপনারা কাঁদছেন কেনো? আপনারা এভাবে কাঁদলে আমি কোথায় যাই বলুন তো?
বসুন এখানে, আসুন আসুন বলছি।
পত্রলেখা জোড় করে দুজনকে সোফায় নিয়ে গিয়ে বসায়।
শ্রীময়ী দেবী কান্না জড়ানো গলায় বলেন,
এ কি আমার ছেলে? একে কি সত্যিই আমি গর্ভে ধরেছিলাম? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
- ঠিকই বলেছো শ্রী, এই বয়সে, মা বাবা যাকে লাঠি করে চলবে, বাবা মায়ের দায়িত্ব নেবে, আর সে কিনা....
একটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে, নিজেরও একটা সন্তান আছে, কি করে এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন হতে পারলো আমাদের সন্তান।
-আমি আমার চিন্তা করিনা বাবা, এই যে ছোট মেয়েটা যাকে জন্ম দিয়েছি সে যখন বাবার কথা জানতে চাইবে, কি জবাব দেবো তাকে? কি বলবো আমি।
-ওর হৃদয় এতোটা নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে। ওর শরীরেও তো আমাদেরই রক্ত আছে নাকি, নয়তো এতোটা অমানুষের পরিচয় কি করে দিতে পারে সে।
পত্রলেখা নীচে বসে তাদের হাত ধরে বলে, আমি তো আছি, তোমরা কোন চিন্তা কোরনা।
-চিন্তা তো আমাদের তোমাকে নিয়ে বৌমা।
তুমি কি নিয়ে থাকবে।
-কেনো মা, আপনি আছেন বাবা আছেন, সুপ্রীতি আছে, সবাই কে নিয়ে থাকবো।
- কিন্তু তবুও জীবনে তো একজনকে......
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মুছে পত্রলেখা বলে ওঠে,
- না মা, আমরা নারী, আমরাও সব পারি।
আজ থেকে আমি নেবো আপনাদের দায়িত্ব, মানুষের মতো মানুষ করে তুলবো আমার সন্তান কে। সংসারের সমস্ত খরচ টানবো আমি।
আপনারা শুধু আমায় দু হাত তুলে আশীর্বাদ করুন।
চোখের জল মুছে শ্রীময়ী ও সত্যব্রত বাবু পত্রলেখা কে আশীর্বাদ করে বলেন, আজ থেকে তুমিই আমার ছেলে তুমিই আমার মেয়ে, তোমাকে নিয়েই আমাদের পৃথিবী।
ভগবান যেমন পুষ্পরাগের মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন ছেলেকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন ঠিক তেমনি তোমাদের মতন মেয়ে কেও পাঠিয়েছেন। আর তোমাদের মতো কিছু সন্তান আছে বলেই সব বাবা মায়ের ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম হয় না।
পত্রলেখার ঠোঁটে স্মিত হাসি থাকলেও চোখ দুটি ছল ছল করে ওঠে।।