দাসপুকুরের দাবা-উৎসব
দাসপুকুরের দাবা-উৎসব
- বাবা, দেখুন, এমনিতেই কেউ আর আসে না। কাল আর যাবেন না। গত বছর তো দেখলেন কেউ এলো না। শেষমেষ হরি কাকা এসে আপনার পাগলামি দেখে কোনোরকমে যা হোক করে একটা খেলে দিয়ে গিয়েছিল। প্লিস, আর যাবেন না এবছর।
- হরিকে তো গতবছর গো হারান হারিয়ে দিয়েছিলাম।
হো হো করে অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠলেন সদানন্দবাবু। বলে চললেন
- এবার আর দুশো নয় রে, দুহাজার টাকার বাজি রাখব। দেখি কোন শালার কত দম এই সদানন্দকে হারায়!
ঠোঁটের কোণে বক্র হাসিতে দম্ভ আর অহংকারের প্রতিফলন হচ্ছে। হাত জোড় করে ওনার ছেলে বললেন
- বাবা, প্লিস! আমি তোমাকে দুহাজার টাকা দিয়ে দিচ্ছি না হয়, কিন্তু দয়া করে আর জুয়া খেলো না। এবার বন্ধ করো।
মুখের বক্র হাসিটা ক্রমশ আরো ব্যাঙ্গাত্মক হল সদানন্দ বাবুর।
- কেন রে! এই দাসপুকুর চত্বরে এমন কোনো দাবাড়ু আর নেই বুঝি যে কিনা সদানন্দ দাসকে হারাতে পারে। কাল আবার একবার প্রমাণিত হবে দাসপুকুরের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু শ্রীযুক্ত সদানন্দ দাস। সুভাষ ঢাকিকে দলবল নিয়ে আসতে বলিস। কাল জেতার পর প্রতিবারের মত শোভাযাত্রায় বের হব। অবশ্য এখন তো আবার দেখি নতুন ট্রেন্ড, ব্যান্ড পার্টি। সেরকম ব্যান্ড পার্টি হলেও চলবে।
ভাঙা হাতলের চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন সদানন্দ বাবু। টেবিলের উপর কনুইয়ে ভর দিয়ে দু হাত গালে দিয়ে স্থির নয়নে সদানন্দবাবু যেখানে বসেছিলেন সেই ভাঙা হাতলের ইজি চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে রইলেন তার ছেলে। টেবিলের উপর একটা দাবা বোর্ড রাখা, আর তার উপর যত্রতত্ৰ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজা, মন্ত্রী, নৌকা আর বাদবাকি সব দাবার গুটি।
সদানন্দবাবুর পিতামহ ছিলেন শ্রী গৌরিকিশোর দাস, জমিদার বংশের সন্তান। এই অঞ্চলের নাম দাসপুকুর হয় ওনাদের পরিবারের নামানুসারেই। এই গৌরিকিশোর দাস মহাশয় দাবা উৎসবের সূচনা করেছিলেন ১৯০০ সাল নাগাদ। শ্রাবণ মাসের প্রথম দিনে এই উৎসব পালন হত। প্রচন্ড ভিড় জমতো জমিদার বাড়ি লাগোয়া বিশাল মাঠটায়। এলাকাবাসী অপেক্ষা করে থাকত দিনটার জন্য। সকাল থেকে রাত অবধি একের পর এক দাবা ম্যাচ চলত। জনমানসে লক্ষ্য করা যেত উত্তেজনা, চাঞ্চল্য। তিলধারণের জায়গা থাকত না মাঠে। গাছের মাথায় উঠেও লোকজন সাক্ষী হয়ে থাকতে চাইত দাবা উৎসবের। দূরদূরান্ত থেকে লোকজনের সমাগম ঘটত। বিজয়ী ঘোষণা হবার পর বিজয়ী বিশাল বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মধ্যে দিয়ে গোটা এলাকা পরিক্রম করতেন।
সেই থেকে সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে দাবা উৎসব চলতে লাগল। ক্রমশ সেই উৎসবের চাকচিক্য, জৌলুস প্রথম দিকে বাড়তে থাকলেও তারপর ধীরে ধীরে নিজের জৌলুস ক্রমশ হারাতে থাকল দাবা উৎসব। হারাবে নাই বা কেন! উৎসব তো শুধু আর উৎসব থাকল না। ক্রমশ হয়ে উঠল জুয়ার আখড়া। দাসপুকুরের গৌরবময় দাবা উৎসব কখন যে মহাভারতের শকুনি আর যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার মত কলংকিত হয়ে উঠল তা ঘুণাক্ষরেও টের পেলেন না জমিদার বংশের সন্তানরা।
আর সদানন্দবাবুদের সময়ে বাইরে থেকে তো কেউ খেলতেই আসেন না। ভাইদের সাথেই ভাইদের জুয়ার আসর বসে শুধু। আর পাড়ার দু তিন জন বৃদ্ধ মানুষ কখনো বা যোগ দেন খুব বেশী হলে। আর তাদের পরবর্তী প্রজন্ম! তারা তো আধুনিক পৃথিবীর বাসিন্দা, তারা এসব জুয়া খেলা একদমই পছন্দ করেন না। দাবার প্রতি উৎসাহ অবশ্য দাসপুকুর অঞ্চলের মানুষদের এখনো আছে, কিন্তু দাবা উৎসবকে আবার নতুন করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে এরকম লোকও নেই, উদ্দীপনাও নেই। গত বছরের আগের বছর সদানন্দবাবুর দাদার মৃত্যু হয়। তারপর এই আশি বছর বয়সেও সদানন্দবাবু চান উনি একাই ছড়ি ঘোরাবেন দাবা উৎসবে। কারোর কোনো কথাই শোনেন না, এতোটাই একগুঁয়েমি ওনার।
একপ্রকার জোর করেই বৃদ্ধ সুভাষ ঢাকিকে নিয়ে এবছর দাবা-উৎসবে আবার এসেছেন সদানন্দ বাবু। সামনে দাবার বোর্ড বিছানো একটা টেবিলের উপর। চেয়ারে বসে আছেন সদানন্দবাবু। খোলা বিশাল মাঠের ঠিক মাঝখানটায় একা বসে যেন দাবার বোর্ড সামলাচ্ছেন তিনি। আকাশে কতকগুলো চিল ঘুরপাক খাচ্ছে। বোর্ডে দাবার গুটি সাজিয়ে জমিদারের মতোই পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন সদানন্দবাবু।
ঘড়িতে দশটা বাজে, এগারোটা বাজে, বারোটা বাজে। কেউ খেলতে আসে না। সদানন্দবাবুর মন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরে ক্রমশ। কখনো খুব আনন্দ পাচ্ছেন এই তল্লাটে সদানন্দবাবুকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মত লোক একটাও নেই বলে। সুভাষ ঢাকিকে চেঁচিয়ে বলে উঠছেন “সুভাষ, ঢাক বাজা। গোটা দাসপুকুর শুনুক সেই আওয়াজ। আজ আর সদানন্দ দাসকে চ্যালেঞ্জ জানানোর লোক নেই কোনো!” পরমুহূর্তেই মুষড়ে পড়ছেন আবার। কেউ না খেললে তো জুয়া জেতাই হবে না। নিজের মনেই চেঁচিয়ে উঠছেন তখন “কিরে! কে খেলবি! আয়! বুকের পাটা নেই তোদের?”
দুপুর পেরিয়ে ক্রমশ বিকেল হচ্ছে। সদানন্দবাবুর মনের ভিতর তো এক অজানা বাতাসের ঝড় বইছে। না না, কাউকে আসতেই হবে। বিপক্ষকে হারানোর প্রবল ইচ্ছে তখন তাকে পেয়ে বসেছে। সে যেন এক ক্ষুধার্ত সিংহ তখন। এই ইচ্ছে দম্ভের প্রতিফলন। এই ইচ্ছে অহংকারের প্রতিফলন। “সুভাষ, আরো জোরে ঢাক বাজা! আরো জোরে”।
রক্তিম সূর্য ক্রমশ ঢুলে পরছে পশ্চিম আকাশে। ক্রমশ আরো উতলা হয়ে উঠছেন সদানন্দবাবু। দম্ভ আর অহংকারের আড়ালে লুকিয়ে থাকছে একাকিত্বের যন্ত্রণা, তা টেরও পাচ্ছেন না উনি।
একটা ছোট্ট বাচ্ছা ছেলে ছুটে ছুটে সদানন্দবাবুর দিকে আসছে।
- দাদু! দাদু! তুমি দাবার বোর্ড নিয়ে বসে আছ কেন! খেলার বন্ধু পাচ্ছো না বুঝি?
বাচ্ছাটার সরল মনের প্রশ্ন সদানন্দবাবুর মনের ভিতর যেন তীর হয়ে বিঁধল। অত্যন্ত বাজখাই গলায় তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন
- যা না ! বন্ধুদের সাথে খেলতে যা না! এখানে কি দরকার!
- দাদু, তুমি বন্ধু হবে আমার! তবে তোমার সাথে খেলব।
- আঃ! বিরক্ত করিস না।
- সত্যি বলছি দাদু। খেলতে পারি আমি। চলো বন্ধু হই আমরা। তারপর খেলি।
- খেলতে হলে দুহাজার টাকার বাজি আছে। টাকা কোথায় পাবি তুই?
- দাদু, বাজি তো কালীপূজোয় ফাটাবো। দেরি আছে তো!
- আঃ। যা না তুই। এসব বুঝবি না।
- আমি এই দাঁড়ালাম। তোমার বন্ধু হলাম। চলো, খেলি। চাল দাও। তোমার তো সাদা।
- এই। তুই চন্দন মাস্টারের ছেলে না! আমি জিতলে কিন্তু চন্দন মাস্টারের থেকে ঠিক দু হাজার টাকা আদায় করেই ছাড়ব। ভাবিস না বাচ্ছা বলে পার পেয়ে যাবি!
ছোট্ট শৈশব মন তার নতুন দাদুকে বন্ধু বানিয়ে নিয়ে খেলতে চাইছে তখন। অবশ্য দাদুর মন একটুও গলে নি তাতে। বরং দম্ভ আরো খানিক বেড়েছে। চন্দন মাস্টারের সাথে পুরোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আগে থেকেই ঝগড়াঝাটি ছিল। সুদে আসলে ঝগড়া মিটিয়ে নেবার এমন সুযোগ আর পাওয়া যায় নাকি! দাসপুকুরের দাবা উৎসবে বিজয়ীর মুকুট তার মাথাতেই থাকবে, দু হাজার টাকাও হাতানো যাবে চন্দন মাস্টারের থেকে, সেই সঙ্গে তাকে মোক্ষম জবাবও দেওয়া যাবে বৈকি। “ঢাক বাজা সুভাষ। খেলা শুরু হচ্ছে যে”। সুভাষ ঢাকিকে নির্দেশ দিলেন সদানন্দবাবু। খেলা শুরুর আগেই জয়ের আনন্দে চোখ চিকচিক করছে ওনার।
রাজার সামনের বোরেটা দু ঘর এগিয়ে নিজের পছন্দের ‘কিংস-পন-ওপেনিং’ এ খেলা শুরু করলেন সদানন্দবাবু। বাচ্ছা ছেলেটি সবে মাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু সমান তালে সদানন্দবাবুর সাথে পাল্লা দিয়ে লড়ে চলেছে। অনেক চেষ্টার পর প্রায় চল্লিশ মিনিট পর প্রতিপক্ষের একটা ছোট্ট ভুলের সুযোগ নিয়ে প্রতিপক্ষের একটা হাতি বেশি খেলেন সদানন্দবাবু। তবুও দমার পাত্র নয় ছোট্ট ছেলেটা। কিন্তু একি! সদানন্দবাবু একি করলেন! রাজাকে কিস্তি দিতে গিয়ে নিজের মন্ত্রীকে খোয়ালেন বিপক্ষের ঘোড়ার কাছে।
ফোকলা দাঁত নিয়ে হেসে সেই ছেলে তখন দাদুকে জিজ্ঞেস করছে “দাদু, তোমার মন্ত্রী কোথায়?” সদানন্দবাবুর কানে কথাটা যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে সেই ‘উলঙ্গ রাজা’ এর “রাজা তোর কাপড় কোথায়’ হয়ে।
আর বেশিক্ষন লড়তে পারলেন না সদানন্দবাবু, হার মানলেন বাচ্চা ছেলেটার কাছে। সুভাষ ঢাকি কিছু না বুঝে এখনো ঢাক বাজিয়েই চলেছে। “দাদু, তোমার মন্ত্রী কোথায়” কথাটা যেন সেই ঢাকের শব্দের তালে তালে বেজে উঠছে। মুখ নিচু করে বসে আছেন সদানন্দবাবু। একরাশ যন্ত্রণা, বেদনা, হতাশা সব কিছু মিলেমিশে গিয়ে তাকে কুড়েকুড়ে খাচ্ছে তখন। কোথাও মুখ দেখানোর জায়গা রইল না তো ওনার। কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন সদানন্দ বাবু। ক্লাস ফোরের বাচ্চা ছেলেটা তাকিয়ে আছে।
- দাদু, তুমি কাঁদছো? কষ্ট পেও না। খেলা তো এটা। হার জিত তো আছেই। তাছাড়া বন্ধুর কাছে হারলে কেউ এমন কষ্ট পায় বুঝি?
সদানন্দবাবু বুকে টেনে নিলেন বাচ্ছা ছেলেটিকে। ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল হঠাৎ। বৃষ্টির জলের সাথে সদানন্দবাবুর দম্ভ, অহংকারও ভেসে চলে গেল বোধহয়।
না, না দাসপুকুরের দাবা-উৎসব বন্ধ হয়নি, বরং নতুন উদ্যমে পরের বছর থেকে আবার নতুন রূপে শুরু হয়েছে। মাঠের একটা অংশে একটা নতুন চেস-একাডেমিও খুলেছেন সদানন্দবাবুর ছেলে। বাইরের এক প্রশিক্ষক তো শেখাতে আসেনই, সময় সুযোগ হলে সদানন্দবাবুও খুদে শিক্ষার্থীদের শেখান সেখানে। সাফল্যও মিলছে বৈকি।
