দাগ
দাগ
হলদে দোতলা বাড়িটা থেকে নামতেই একটা হালকা হাওয়া। উঃ! প্রাণটা জুড়োলো তিতিরের। তিনতলার উত্তর কোণে একটা তেইশ স্কয়ার ফিটের গুপচি ঘরে টানা আড়াই ঘণ্টা একটা ছেলের পিছনে বকমবকম, কী যে বিরক্তিকর! উহ্হু বাবা, দেখতেই দেড় ফুট, কিন্তু মাথায় সবসময় কথা কিলবিল... দড়াম তিতিরের কোলে বসে শুরু ...
- তুমি চা খাও কেন?
- আমি বড়ো বলে!
- চা খেতে হলে বড়ো হতে হয়?
- তা তো হতেই হয়!
- জানো(চুপিচুপি), আমার পাপাও চা খায়, স্মোকও করে ভূষভূষ! তুমি স্মোক করো? বোঝো এবার! ওই কিন্ডারগার্টেনকে কী করে দমায় তিতির?
একটু বেশি হোমওয়ার্ক দিলেই বাবুর পায়ে ব্যাথা; তখন আসলে ঘনঘন টয়লেট পায়, বারবার বাথরুম যেতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়, এদিকে বাবা মায়ের কড়া এনকাউন্টিং... ছেলেকে স্ট্যান্ড করাতেই হবে ম্যাডাম, এই বংশের ছেলে.. কত আশা নিয়ে সিবিএসসিতে দিয়েছি, লোকের কত তারিফ...!
তিতির বুঝে পায়না এরা তারিফটা কিসের চায়, ছেলের ভালো রেজাল্টের নাকি ছেলেকে ভালো স্কুলে ভর্তি করানোর এলেমের!
আগে জানলে কিছুতেই এই টিউশনিটা নিতো না তিতির। হ্যাঁ, মাস গেলে কড়কড়ে দুটি হাজার আসে ঠিকই, তবে সপ্তাহের পাঁচ দিন আড়াই ঘণ্টা ওই রক্তমাংসের ছুঁচোবাজিকে দমিয়ে রাখা, বাপস!
কব্জি ঘুরিয়ে সময় দেখে নেয় তিতির, পাঁচটা পাঁচ, এইচ.এসের ব্যাচ এসে পড়েছে নির্ঘাৎ! জোরে পা চালালো তিতির।
**************
গেটের বাইরে পাচঁজোড়া রকমারি চটি ছাড়াও, নতুন একটা বয়স্ক লেডিস চপ্পল, এটা তিতিরের কোনো স্টুডেন্টের হতে পারেনা, এমন সময় কে?
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে উঠতেই তিতিরের কানে এলো... এ যে আমাদেরই পাল্টি ঘর বৌমা, প্রথমে অচেনা ভেবেই তো ফোন করেছিলাম, পাত্রপাত্রী কলাম দেখে, কথাবার্তা চলতে চলতে জানলাম, আরে আমার অমুর সাথেই তো একসাথে ট্রেনিংয়ে ছিল, আমাদের বাড়ি এসেওছে কয়েকবার। আমি বলছি বৌমা, তুমি সনতের সাথে কথা বলো, একমাত্র ছেলে, মা নেই, বোনেদের বিয়ে হয়ে গেছে, বাবা দেশের বাড়িতে থাকে, আর ছেলে স্কুলের কাছেই একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকে, ফ্ল্যাটের জন্য অ্যাপ্লাই করবে, চেনা জানার মধ্যে এমন ছেলে....
বলতে বলতেই বক্তার চোখ আটকেছে সিঁড়ির দিকে," আরে তিতির, তোর কথাই হচ্ছিল, তোর তো মাস্টার্স কমপ্লিট হয়ে গেছে, একটা বায়োডাটা দিস তো, সঙ্গে সুন্দর একটা পোস্টকার্ড সাইজ ছবি, আছে তো?"
তিতির ওপরে এসে কথাবার্তা শুনছে অনেক্ষন। এরইমধ্যে মা তার জন্য সম্বন্ধ দেখা শুরু করে দিলো! কতবার বলবে তিতির, তারও একটু সময় চাই, নিজেকে গুছিয়ে নিতে, নিজেকে প্রমাণ করতে। মেয়েদের বয়স অঙ্কে যত না বাড়ে, বাবামা, প্রতিবেশীদের উদ্বেগে বোধয় তা দ্বিগুন হয়ে যায়!
**************
মার নির্দেশ মত ছিপছিপে গড়নে সবুজ লাল তসর জড়িয়ে, কান হাত গলায় হালকা সোনা ছুঁইয়ে, এলোমেলো চুলে পরিপাটি খোঁপা সাজিয়ে নতমস্তকে পাত্রপক্ষকে প্রতিনমস্কার জানালো তিতির।
সামনে দুজোড়া চোখ পায়ের ওপর পা তুলে জরিপ করছে এক স্নাতকোত্তর গৃহশিক্ষিকাকে।
তাঁদের মধ্যে একজন, পাত্র স্বয়ং দুই হাতের চারজোড়া সোনার আংটি নাচিয়ে প্রশ্ন করলেন,
- আপনার নাম?
মার শিখিয়ে দেওয়া ভঙ্গি অনুসরণ করে তিতিরের মাথা না তুলে মার্জিত উত্তর...
- তিলোত্তমা হালদার!
- মাস্টার্স কমপ্লিট? কোন সাবজেক্ট?
- ফাইনাল ইয়ার, ফিলোসফি।
- হবি?
- পড়তে ভালোলাগে, পড়াতেও।
- বেশ তো, বিয়ের পর প্যারা টিচিংয়ে আমাদের স্কুলে আপনাকে ঢুকিয়ে দেব।
এহেন মধুভাষণে, তিতিরের মা, বাবা, উপযাচিকা ঠাকুমা কৃতজ্ঞতায় ডগমগ। পাত্রও নিজের ক্যালিবার জাহির করে চেয়ারে হেলান দিয়ে আয়েশ করে ডান পায়ের উপর বাম পা তোলার উপক্রম করতেই তিতিরের সোজাসুজি প্রশ্ন, "কোন স্কুল আপনার? না, আমি যতদূর জানি, প্যারাটিচারের রিক্রুটমেন্ট তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে!"
পাত্র ঈষৎ অসহিষ্ণু, "তাতে কী, পার্ট টাইমিং তো রয়েইছে...!''
আরো কিছু বরাভয় ঝরার আগেই তিতির উন্নতশিরে দন্ডায়মান, "মাফ করবেন, আমি আগে শক্ত মাটিতে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই, কাউকে অবলম্বন করে নয়!"
**************
চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে মনীষা আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন।
সনৎ সবে অফিস থেকে ফিরেছেন, জামা পাল্টে না-পড়া কাগজ গিলছেন নিস্পলক। দেওয়ালে টিভিতে খবর চলছে একটানা।
রিমোট টিপে টিভি বন্ধ করে মনীষা স্বামীতে ফিরলেন, "ছোটকাকিমা বলছিলেন, সামনের অঘ্রানেই ডেটটা ফিক্সড করে ফেলতে, এমনিতেই সরকারী চাকরি করা পাত্র হাতে গোনা মেলে আজকাল, তারওপর তোমার মেয়ের ওরকম অকুতোভয় কথা শুনেও ওরা ওকে পছন্দ করলো, ফেলে রাখাটা আর ঠিক হবেনা বুঝলে!"
সনৎ কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, "সে তো বুঝলাম মণি, কিন্তু এক্ষুনি এক্ষুনি তিতিরের বিয়ে দেওয়াটা কি ঠিক হবে?"
কাপে চুমুক দিয়েই মনীষা সোজা, "চশমার পাওয়ারটা বাড়াও, মেয়ের বয়স করে গুনে বলো দেখি, ওর বয়সে আমি কোমরে আঁচল গুঁজে একডজন থালার ভাত রাঁধতাম, মনে নেই তোমার?"
সনৎ ঈষৎ ভাবলেশহীন, "নিজে সাফার করেছ বলে মেয়েটাকেও..."
স্বামীর কথা ছিনিয়ে নিলেন মনীষা, "তা নয় গো, ভুলে গেলে, কলেজে পা দিতে না দিতেই কী কান্ড করেছিল মেয়েটা!"
মুহূর্তে মনীষার দুচোখ জ্বলে উঠলো, মায়ের মনে ভয়ার্ত উদ্বেগ, "তখন বয়স কম ছিল, ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে মেয়েটাকে ফিরিয়ে এনেছি, এখন বয়স বেড়েছে, যদি আবার সেরকমই কিছু একটা... না না, তুমি আর দেরি করোনা!"
*************
কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন, ভর্তির রিসিট নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাশে বসা ইউনিয়নের ছেলেটা এগিয়ে দিচ্ছে আরো একটা বিল, ইউনিয়ন চাঁদা, কলেজে এসে যাবতীয় সমস্যা, সে ইভটিজিং হোক, কিংবা কোনো প্রফেসরের ব্যক্তিগত আক্রোশে অ্যাটেন্ডেন্স কম দেওয়াই হোক, আজকাল তো আবার প্রফেসররা টিউশনির নামে দালালি শুরু করেছেন, ব্যাচে এসো, তবেই প্রজেক্টে ফুল মার্কস, ফ্যালো কড়ি মাখো তেলের মতো আরকি! যাই হোক, সব সমস্যা সমাধানের জন্য ইউনিয়নকে আগেভাগেই পকেটে ভরে রাখা।
তিতির অ্যাডমিশন স্লিপটা কালেক্ট করতেই পাশে দুশো টাকার রশিদটা এগিয়ে দিল ছেলেটা। উল্টে পাল্টে দেখছে তিতির, ইউনিয়নের ছেলেটার নজর এড়ালোনা, "পিছনে অনেক লাইন মামনি, মানে মানে টাকাটা ফেলে কেটে পড়ো।"
তিতিরের পাল্টা উত্তর, "কিন্তু টাকাটা দেব কেন?"
- সবাই দিচ্ছে তাই?
- সেটাই তো আমার প্রশ্ন, সবাই দিচ্ছে কেন?
- ইউনিয়নের সুনজরে থাকতে, ওইযে তিনটি বছর কলেজে আসবে, ঠ্যাং নাচিয়ে ক্যান্টিনের বেঞ্চ বাজাবে, ক্লাস বাংক করে বয়ফ্রেন্ড নিয়ে পুকুরপাড়ে ছাতা আড়াল করবে, আবার সেভেন্টি পার্সেন্ট অ্যাটেন্ডেন্সের জন্য আমাদের কাছেই ছুটবে, সবকিছুর জন্য আমাদেরকেও তো খুশি রাখতে হবে...
- আর যদি এগুলোর কিছুই না করি, ইউনিয়নের পাও না চাটি, তাহলে তো আর তোমাদের ঘুষ দিতে হবে না...
পিছন থেকে ক্লাসমেট তিতিরের কাঁধ খামচে ধরে, "কেন তাতাচ্ছো ওদের? দিয়ে দাও..."
প্রথম কলেজে পা রাখা প্রতিটা ছেলেমেয়ের মধ্যেই একটা চোরা ভয় থাকে, এমতাবস্থায় তিতিরের মত একটা পাঁচফুটিয়া ইউনিয়নের ছেলের সঙ্গে চাঁদা নিয়ে সমানে তর্ক করে যাচ্ছে, এটা বিরল দৃশ্য বৈকি! কাউন্টারের লোকটা পর্যন্ত টাকা গোনা থামিয়ে একদৃষ্টে গিলছে চলচ্ছবি।
এরইমধ্যে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলো আরও এক ইউনিয়ন, স্ল্যাবে বসা ইউনিয়নের কলার চেপে ধরলো, "কলেজ বুঝি আজকাল লুজারদেরও অ্যাডমিট করছে, কাওয়ার্ডএর মত ভিক্ষে না চেয়ে বিদ্যেটাকে কাজে লাগা, মা স্বরস্বতী খুশি হবেন! যার যার থেকে এক্সট্রা নিয়েছিস, ফিরিয়ে দিবি, এক্ষুনি..."
কাউন্টারে হুকুম ছোড়ে, "এই চলো চলো, কেউ অ্যাডমিশন ফিজ ছাড়া এক্সট্রা একটা টাকাও দেবে না!"
সেই প্রথম অর্ণব দাসকে দেখা, প্রথম দর্শনেই তিতির কুপোকাত, এরকম নির্ভীক আদর্শবাদী ছেলে... কলেজের গেটে ঢুকেই বাঁ পাশের ইউনিয়ন রুমে রোজ চোখ বলাতো তিতির, যদি একবার দেখা পায়...
ফ্রেশার্সএর দিন একটা সুযোগ, নতুনদের স্মারক দিয়ে বরণ করছে সেবছরের প্রাক্তনরা। সাদা গোলাপ হাতে তিতির এগিয়ে যায় অর্ণবের দিকে, অর্ণবের অবাক প্রশ্ন, "এটা কিসের জন্য?"
তিতিরের সলজ্জ উত্তর, "অন্য বন্ধুত্বের শুভারম্ভের, অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে!"
অর্ণব নিচু হয়ে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, "কটা মাথা আমার এরূপ প্রতিবাদিনীর প্রস্তাবে আপত্তি করার!"
শান্ত নদীতে পালতোলা নৌকোর মত কয়েকটা মাস এগিয়ে চললো প্রেম, নৈকট্য। অনাবিল ছন্দে তিতির কথা বলতো অবিরাম, অর্ণব মুগ্ধ শ্রোতারূপে নিস্পলক তাকিয়ে থেকে আচমকাই তর্জনী ছোঁয়াতো তিতিরের ঠোঁটে, "দোহাই তোর, একটুকু চুপ কর/ ভালোবাসিবারে দে মোরে অবসর!"
হঠাৎ বদলে গেল দৃশ্য, টানা তিনদিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখে গোটা কলেজ সমক্ষে অর্ণব আঙ্গুল তুললো তিতিরকে, "এবার ফোট! তোর প্রয়োজন শেষ!"
গুঁড়িয়ে গিয়েছিল তিতির। সে নিছকই একটা প্রয়োজন! আর পাঁচজন ছেলে যেমন মেয়েদের 'মাল' ভাবে, অর্ণবও তাদের ব্যতিক্রম নয়!
লজ্জায় ঘেন্নায় কলেজ যাওয়া বন্ধ করেছিল, জুটিয়ে নিয়েছিল একটা চাকরি, কল সেন্টারের, ব্যস্ততা যদি স্মৃতি মুছিয়ে দেয়!
এর মধ্যেই মায়ের সেলিব্রাল, অতিরিক্ত টেনশন, তিতিরের জন্য?
অসুস্থ শয্যায় মা তিতিরের হাত জাপটে ধরে, "কয়েক মাসের প্রেমের জন্য আঠেরো বছরের রক্তের টান ভুলে গেলি তিতির? একটা ছোটলোক লম্পটের জন্য নিজের কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিচ্ছিস? ফিরে আয় মা, সেই ছোটবেলার মত আমার কোলে ফিরে আয়!"
আজও তিতিরের মনে স্পষ্ট সেই দিনগুলো। বইয়ের পাতা ওল্টালেই অর্ণবের মুখ ভেসে ওঠে, চোখ ফেটে জল চলে আসে, তবু অনড় থাকতে হয়, লক্ষ্য স্থির রাখতে হয়। তিতিরের ভালোবাসায় বাবামা তো আপত্তি করেনি, তবু যখন কেউ এত সহজে তিতিরকে প্রয়োজন বানিয়ে নেয়, তার জন্য তিতির হারবে কেন?
প্রথম বছর নষ্ট হওয়ার পর, তিতির ফিরে তাকায়নি আর।
সময় বয়ে চলে, সময়ের পলি পড়ে বালিয়াড়ির আঁকিবুকিও চাপা পড়ে, নানান ব্যস্ততায় অর্ণবও চাপা পড়ে ছিলো এতদিন, খানিকটা। আজ হঠাৎ স্মৃতিটা সম্পুর্ন তাজা হয়ে উঠলো!
*************
ছেলের বাড়ি থেকে ফিরেই একমনে নিজের কাগজপত্র ঘেঁটে চলেছেন সনৎ।
বাড়ির লোনটা সামনের ফেব্রুয়ারিতে মিটলেও, তিনজনের নামে করে রাখা আলাদা আলাদা ইনসিওরেন্স পলিসিগুলো চলবে, বছরদশেক আগে ওগুলো ম্যাচিওর্ড হয়েছিল, সনৎ আবার বারো বছরের টার্মে লাগিয়ে দেয়, রিটায়ারমেন্টের পর হাতে থোক একটা আসবে, এই আশায়। তিতিরের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কথা তো মনে আসেনি কখনও, ওই এক মেয়ে, চাকরি থাকতে থাকতে সব ঋণ মিটিয়ে, নিজেকে গুছিয়ে তারপর মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু মনীষাটা এত তাড়াহুড়ো করছে! পিএফে হাত দেওয়া ছাড়া গতি কই!
ছেলের বাড়ি থেকে প্রথমে বললো, দাবিদাওয়া নেই, খুব ভালো কথা। তারপর ছেলে কোথায় ভাড়া থাকে, দেখতে গিয়েই চোখ কপালে উঠলো, একটা অন্ধকার স্যাঁতস্যাঁতে তিনশো স্কয়ারফুটের চার দেওয়াল। ছেলে এবার নিজের মতলব জানায়, ফ্ল্যাট কেনার মতলব। স্ট্যান্ডের পাশে প্লটও দেখিয়ে দেয়, আক্ষেপও জানায়, নিজে কুড়ির মত লোন নেবে, বাকি দশ....
ঘটক কাকিমা সমাধান বাতলে দেন, "সনৎ নাহয় বাকিটা দেবে, ওদের যা আছে সবই তো মেয়ের জন্য!"
এহেন আকস্মিক আক্রমণে সনৎ থতমতপ্রায়, সামান্য ভুমিসংরক্ষন দপ্তরের সরকারি কর্মচারী হয়ে দশলক্ষ টাকা ক্যাশ, কোথায় পাবেন তিনি?
এছাড়াও দানসামগ্রী, গয়নাগাটি...!
সনৎ ভেবে কুল পাননা। স্ত্রীকে বলেন, "পারবোনা মণি, সম্বন্ধটা বরং বাদই দাও, আমার মনটাও ঠিক সায় দিচ্ছেনা গো!"
মনীষা রে রে করে ওঠেন, "আজকালকার দিনে সরকারি চাকরি করা পাত্রের দর জানো? মেয়ের বাবারা আস্ত ফ্ল্যাট বুক করে ঘুরছেন যৌতুকের জন্য, আর তুমি শেয়ার দিতে পারবে না?"
-"সে যে দিচ্ছে দিক, আমার সামর্থটাও তো দেখতে হবে.."
মনীষা স্বামীর পাশে আসেন, "বেশ একসঙ্গে না দাও, রিটায়ারমেন্টের পর বাকিটা দিও, তখন তো পলিসিগুলোও ডবল ম্যাচিওর্ড পাবে আর গয়নাগাটি, আমার যা আছে, পালিশ করে দিয়ে দেব"।
সনৎ অসহায় চোখে স্ত্রীর দিকে তাকান, "নিঃস্ব হয়ে যাবো মনীষা, মেয়েটাও থাকবেনা, সলিড ক্যাপিটাল থাকবেনা..."
মনীষার চোখে স্বপ্ন, "মেয়েটার ভবিষ্যৎ তো সিকিওর্ড হবে, ওই তো আমাদের সব, কী না করেছি বলো ওর জন্য, সব তো ওর ভালোর জন্যই!"
একটা অতীত চোখে নেমে আসে মনীষার, "মনে নেই তোমার, কলেজে উঠে কী ভুলটাই না করতে চলেছিল মেয়েটা, আগুপিছু না ভেবেই কে এক ভ্যাগাবন্ড ছেলেকে বাড়িতে আনলো, কী? না, বন্ধু। কিন্তু আমি ঠিক বুঝেছিলাম, বন্ধুরও বেশি কিছু।"
সনৎ গম্ভীর, "সেদিন কাজটা ঠিক করোনি তুমি, একটা নির্দোষ ছেলেকে...!
-" তো কী করতাম? ওদের সম্পর্কটা হ্যাঁ হ্যাঁ করে মেনে নিতাম? বুলবুলদা মন্টির জন্য এনআরআই পাত্র আনলো, তনিমাদির প্রফেসর জামাই, অনুষ্ঠান বাড়িতে গেলে সবাই রসিয়ে রসিয়ে মেয়ে জামাইয়ের গল্প করবে, আর আমি কী করবো? ফ্যালফ্যালিয়ে বসে সবার অহংকার গিলবো?পারবোনা...
তিতির বরাবর জেদি, ওকে বুঝিয়ে লাভ ছিলোনা...
-"ওদের একটু সময় দিতে পারতে, নিজেদের গুছিয়ে নিত ওরা!"
-" বাবা তো তোমার চাকরিটা দেখেই বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন কী ছিল তোমার? ফ্ল্যাটের লোন শুধতে হচ্ছে এখনও? এত বছর একসঙ্গে কাটালাম, কোন সাধটা পূরণ হয়েছে আমার?
নানা, তিতিরকে আমি আমার মত সাফার করতে দেবনা।"
----------------–----------
দরজা খুলতেই ছেলেটার মার্জিত জিজ্ঞাসা, "আমায় ডেকেছিলেন আন্টি?"
-" হ্যাঁ, ভিতরে এস।"
বসারঘরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল ছেলেটা। মনীষা সামনের চেয়ার দেখিয়ে বলেছিলেন, "বসো, তিতির নেই, মামারবাড়ি গেছে, তোমার বাবা কী করেন অর্ণব?"
অর্ণব ইতস্তত, "বাবা নেই, মা আয়ার কাজ করেন..."
-" দাঁড়াও দাঁড়াও, বাবা নেই, মারা গেছেন?"
মুখ গোঁজ করে অর্ণব উত্তর দেয়," না, বাবা আমাদের সঙ্গে থাকেননা, ওনার আলাদা পরিবার আছে"
মনীষা যেন প্রত্যাশিত উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন, "বাহ বাহ, আমার মেয়ের প্রেমিকের বাবা দুশ্চরিত্র, মা আয়া, বাহ! আচ্ছা অর্ণব, তিতিরের সঙ্গে তোমার পরিচয়টা জুড়তে তোমার লজ্জা করবে না? দাঁড়াও দাঁড়াও, বিয়ে অব্দি গড়াবে তো, নাকি মাঝপথেই..."
অর্ণবের গলায় ধিক্কার, "ছিঃ! আন্টি, আমি তিতিরকে ভালোবাসি..."
-" হ্যাঁ, তাইতো বলছি, সরে যাও তিতিরের জীবন থেকে, ও অনেক বেশি ডিজার্ব করে, ও এসব মোহে করছে, ভালোবাসা বোঝার বয়স হয়নি এখনও ওর.."
- কিন্তু আন্টি ,ওকে আমি কথা দিয়েছি, আমরা আগে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, তারপর...
-" তারপর, তোমার পরিচয় বদলে যাবে? দুদিনেই বাড়ি গাড়ি ওয়েল সেটেলমেন্ট হয়ে যাবে? ওয়েল আর্ন্ড তকমা সেঁটে যাবে গায়ে?
তিতির আমাদের একমাত্র মেয়ে, অনেক যত্নে বড়ো হয়েছে, পারবে বিয়ের পরদিন থেকেই ওর লাক্সারি বজায় রাখতে?"
-" তা হয়তো না, তবে ভালোবাসায় কোনো কমতি রাখবোনা, বিশ্বাস করুন!"
-" ফুহ! ভালোবাসা! তোমার মত ক্লাসের আবার ভালোবাসা! আমরা তোমায় মানতে পারবোনা। আর বিশ্বাস করি, তিতিরের চোখ থেকে মোহের চশমা খুলে গেলে ওও তোমার ঘেন্নাই করবে!"
- বেশ, সরে যাবো, কিন্তু এখন, এখন তো তিতির আমাকে ভালোবাসে...
- সেই দায়িত্বও তোমার, ভেবে রাখো কী করলে তিতির এখনই তোমায় ঘেন্না করবে!
মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। মনীষার ঠোঁটে তখন বিজয়িনীর হাসি।
ছেলেটির পা টলছে...!
--------------------------------
পাশে বসে তিতিরের থুতনির কাটা দাগটা আঙ্গুল বাড়িয়ে চিহ্নিত করলো লোকটা, "কিসের দাগ এটা?"
তিতির আলতো হাতে থুতনি ছোঁয়, "ও, কলতলায় পড়ে গিয়েছিলাম, পাঁচটা স্টিচ পড়েছিলো।"
-সেদিন দেখলামনা তো, দাগটা লুকোতেই কি মাথা নত করেছিলেন?
তিতির অবাক, "আশ্চর্য! লুকোবো কেন? সবজি কাটতে গিয়ে বহুবার হাত কেটেছে, সেরে গেছে, এটাও সেরকমই একটা, ফলাও করে বলার মত কিছু নেই!"
- "তা নেই, তবে সৌন্দর্যে একটা কলঙ্ক আসে বৈকি, চাঁদের মত!"
তিতির হাসে, "আমি চাঁদ নই, রক্তমাংসের মানুষ, নিজেকে সুন্দর প্রমান করতে লুকোচাপা করতে পছন্দ করি না, আপনি করেন নাকি?
লোকটা থতমত," কী বলতে চাইছেন? কী লুকিয়েছি আমি? আপনার বাবামা সবকিছুই তো নিজের চোখে দেখে এসেছেন!"
- "আমাকে জানাতে বারণ করে বিয়ের পণ নেওয়াটা লুকানো নয়?"
-" দেখুন, আমি লুকোইনি, একটা নিজের আস্তানা চেয়েছি, আপনার বাবা হেল্প করছেন, ফ্ল্যাটটা আপনার নামেই থাকবে।
- তাতে কি মহত্ব প্রমান হয়? যদি ফ্ল্যাট না হতো, আজ থেকে কুড়ি বছর পর, আরও তিরিশ, চল্লিশ বছর পর, আপনার রিটায়ারমেন্টের টাকায় ছোট্ট একফালি জায়গায় একচালা কুঁড়ে বাঁধতে পারতামনা? দশ লাখে নিজেকে বিক্রি করে দিলেন? এতটাই সস্তা আপনার আদর্শ?
রেস্টুরেন্টের চেয়ার ঠেলে উঠে গেল তিতির, টেবিলের উপর মুখ ঝুলিয়ে অচেনা দুটো চোখ; অপমানিত।
******************
নিজের ছোট্ট কিটব্যাগটায় টুকিটাকি কিছু জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে তিতির, আজ একমুহূর্তও এখানে নয়। কী ভেবেছে লোকটা? তিতির একটা পুতুল? দোকানে এসে অর্ডার করে যাবে, বাড়ি নিয়ে যাওয়ার আগে বারবার যাচাই করবে, কী ভেবেছে? সেদিন ওতো অপমান করলো তিতির, তবুও লজ্জা নেই!
ঘরের বাইরে পা রাখতেই মা সামনে, "কী হচ্ছে তিতির, আর হাতে গোনা কটাদিন মাত্র, এখনও এসব পাগলামো কেন করছিস?"
- সেটা তো আমারও প্রশ্ন মা, হাতে গোনা আর মাত্র কটাদিন, এখনও উনি এখানে এসে যাচাই করবেন আমার থুতনির কাটা দাগটা কতটা এফেক্টিভ?
- তুই ওভাবে নিচ্ছিস কেন? তাছাড়া ছেলের দিদিরাও তো দেখেনি তোকে!
- কী দেখেনি? আর দেখে যদি মনে হয়, আহা, চাঁদের মুখে কালো কলঙ্ক, কী করবে, বিয়ে ভেঙে দেবে?
মা, বি প্রাকটিক্যাল, এরকম একটা সিক মাইন্ডকে তোমরা অ্যালাও করছো কিভাবে?
-" তুমি কি বলতে চাও, অর্ণব দাসই সবচেয়ে হেলদি মাইন্ড?"
মায়ের এরূপ কটাক্ষে আহত তিতির। ধপ করে বসে পড়েছে মেঝেয়। আবার পুরোনো চিনচিনে যন্ত্রনাটা ফিরে আসছে।
মেয়ের অবস্থাটা খেয়াল করেননা মনীষা, "গোল্ডেন মাইন্ড বোঝার মত মন এখনো তৈরি হয়নি তোমার, হ্যাঁ, মানছি তুমি অ্যাডাল্ট, কিন্তু এখনো আমরা তোমার লিগ্যাল গার্জেন, তাই তোমার ভালোমন্দ যেটা আমরা ঠিক করে দেব, সেটা তোমাকে মানতে হবে।"
মনীষা বেরিয়েই যাচ্ছিলেন, সামনে ঘটক গিন্নি, "বৌমা, তোমাদের সঙ্গে পাত্রের আর কথা হয়েছে? কাল থেকে চেষ্টা করছি লাইন পাচ্ছিনা, আগে কত কথা বলতো, হ্যাঁ রে তিতির, তোর ফোন থেকে একবার কল করনা, ধরবে নিশ্চয়!"
দুবার রিং হতেই ফোনটা এগিয়ে দিল তিতির। ঘটকগিন্নি প্রায় ছিনিয়ে নিলেন ফোন, "হ্যাঁ ভাই, সব ঠিক আছে তো, কাল থেকে তোমায় কল করছি...."
ফোনের ওপারে, "আমি এখনো দ্বিধায় আছি ঠাকুমা...
-" এসব কী বলছো তুমি, এতো দূর এগিয়ে গিয়ে, তুমি একটু ভেবে দেখো..."
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই সনৎ ফোনটা ছিনিয়ে নেন, "তোমার বাবাকে একটু ফোনটা দাও...
হ্যাঁ, দাদা, আপনার ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে দেবনা। আমি একটি শিক্ষিত রুচিসম্পন্ন পাত্র চাই, টাকার বিনিময়ে শিক্ষিত ক্রীতদাস নয়। পারলে ছেলেকে নৈতিক শিক্ষাগুলো দিন, কারণ ওর শিক্ষাতেই তো স্কুলের আরো পাঁচটা ছাত্র শিক্ষিত হবে! আচ্ছা, নমস্কার!"
মনীষার চাপা আর্তনাদ, "এ তুমি কী করলে... পাড়া প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন সবাই জানে"!
সনতের স্বর কঠিন, "কী জানে? তিতিরের বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে তো, কাল এটাও জানবে, বিয়েটা ভেঙে গেছে। আর তাতে আমার তিতিরও কিছু অনূঢ়া থেকে যাবে না, মণি। তিতির আমার মেয়ে, কোনো অবস্থাতেই ও আপোশ করবেনা, বুঝেছ তুমি?"
সনৎ তিতিরের কাছে এগিয়ে যান, "ওঠ মা, ক্ষমা করে দে আমায়, বাবা হয়েও চরম অন্যায় হতে দিয়েছি তোর ওপর, কিন্তু আর নয়, তুই এগিয়ে চল, তোর চলার পথে শক্ত খুঁটি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবো আমি, যতদিন বাঁচবো!"
চোখের জল মুছে তিতির বাবার বুকে মুখ রাখে, সেই ছোটবেলার মত।
আদুরে গলায় বলে, "অনেকদিন জিলিপি খাইনি বাবা!"