STORYMIRROR

Sangita Duary

Tragedy Others

3  

Sangita Duary

Tragedy Others

চল্লিশ বছর পর

চল্লিশ বছর পর

9 mins
273


সকাল সকাল স্নান সেরে আরতি টেবিলের ওপর বসানো দীপকের ছবিতে একটা টাটকা পলাশের মালা পরিয়ে দিলেন। আজ যে রঙিন দিন। চল্লিশ বছর আগে রঙিন যে মানুষটা আরতিকে বিবর্ণ করে চলে গেছেন, ঠিক আজকের দিনে প্রতি বছর আরতি তাঁর ছবিতে পলাশ ফুলের মালা পরান। সঙ্গে জ্বালান চন্দন ধুপ।

গতকালই স্বনামধন্য ব্যক্তিত্বময়ী শৃঙ্খলাপরায়ণ প্রধান শিক্ষিকা শ্রীমতি আরতি ঘোষাল অবসর নিয়েছেন। চল্লিশ বছর চাকুরী জীবনে কখনো ভেঙে পড়েননি মহিলা, সমান উদ্যমে স্কুল সামলেছেন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গড়ে তুলেছেন, দিনের চব্বিশ ঘন্টা বেঁধে রেখেছেন কাজের সুতোয় যাতে কোনোরকম একাকীত্ব গ্রাস না করতে পারে তাঁকে, কোনোরকম অপ্রাপ্তি যেন মাথাচাড়া না দিতে পারে জীবনে।

কিন্তু আজ থেকে যে অখন্ড অবসর সময় আরতির। এতদিন কাজের বাঁধনে খেয়ালই হয়নি চব্বিশ ঘন্টায় ঠিক কটা নিঃসঙ্গ পরমাণু মুহূর্ত থাকে!

তবু বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে ভালোবাসার মানুষটির সমস্ত অনুভূতিগুলো। আজ হোলি।

পাড়ায় নানান জায়গা থেকে হোলির গান ভেসে আসছে, সবই এখনকার। হিন্দি বাংলা একসঙ্গে মিলেমিশে জগাখিচুড়ি। চেষ্টা করেও আরতি মনের কান বন্ধ করতে পারেন না। দুচোখ বন্ধ করে আরতি মনোসংযোগ করার চেষ্টা করেন, ভাবতে চেষ্টা করেন ফেলে আসা সেই চল্লিশ বছর আগেকার রঙিন দিনগুলোর কথা। 

স্কুলের গন্ডি পেড়িয়ে সবে কলেজ তখন, মা'র ঘোর আপত্তি, মেয়েমানুষ, অতো লেখাপড়ায় কাজ কি, তার চেয়ে ঘরের কাজ শেখো, রান্না শেখো, সেলাই শেখো, ছেলের বাড়ির লোকেদের বলবে কী?

মেয়ে শুধু লেখাপড়াই করেছে! শুক্তোয় আদৌ চিনি পড়ে কিনা সে জানে না! মোচার ঘন্ট তে পেঁয়াজ লাগে কিনা সেটাও সে জানে না!


হুহু বাবা, যতই কলম ধরো, মেয়েদের ঠাঁই কিন্তু সেই রান্নাঘরেই।

ঠাকুরদা কিন্তু তখন সক্কলকে বেবাক করে দিয়ে উল্টো হাওয়া বইয়েছিলেন, "মেয়েদের ডিগ্রি বাড়লে দর বাড়ে, আর দর বাড়লে বরভাগ্যের পারদও চরচড়িয়ে বেড়ে যায়। ওকে কলেজ যেতে দাও, আমি অমলেন্দু ঘোষাল, আমার নাতজামাই ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার না হলে চলে?" 

তবে বিয়ের বাজারে নিজের দর বাড়াতেই হোক, আর অন্য যে কোনো কারণেই হোক আরতি বাড়ির বাইরে যাওয়াটা দারুন উপভোগ করতো। সেই ছোটবেলা থেকে মা কাকিমা জ্যেঠিমার এক গলা ঘোমটা টেনে দুপুর বেলা "এই বাড়ির ওই হলো ওর বাড়ির এই হলো" এটা একেবারেই পছন্দ করতো না আরতি। রাস্তায় ট্রামের টুংটুং, বাসের ধোঁয়া, গড়ের মাঠ, বাবুঘাটের দরিয়া সব মিলিয়ে আরতি ঘরের বাইরে নতুন এক জগৎ পেয়েছিল। সেদিন রবিবার। সকাল থেকেই বাড়িতে প্রায় একটা মিনি উৎসব, এবাড়ির মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে, তাও ইঞ্জিনিয়ার ছেলে, কম কথা!

কাকিমা সক্কাল হতেই আরতিকে জোর করে তুলে মুখে কাঁচা হলুদ আর কমলালেবুর খোসা বেটে লেপ লাগিয়ে দিলেন। আরে, আরতি সুন্দরী, যথেষ্ট সুন্দরী, বাইরে বেরোলে আলগা খোঁপাতেও সবাই তাকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে। তবু এই পাত্র হাতছাড়া করতে একেবারেই নারাজ ঘোষাল বাড়ি। কোনোমতেই যেন আরতির ছোট চোখগুলোর জন্যও সে বাতিল না হয়ে যায়, ত্বকের ঔজ্জ্বল্য আর মুখের হাসি যেন বাকি ফাঁক টুকু ঢেকে দেয় পুরোপুরিভাবে! বিকেলবেলা ছেলে এলো। সঙ্গে মা কাকিমা বাবা কাকা জ্যাঠা!

চুলের গোছা, পায়ের পাতা, গায়ের রং, সর্বোপরি মেয়ের কণ্ঠস্বর শুনে পাত্রপক্ষ এক কথায় রাজি।আরতি তখনও আড়চোখে দেখছে সামনে বসে থাকা জোড়া ভ্রুর মাঝে বিরক্তি লেগে থাকা ছেলেটিকে। বাকি সব্বাই যখন আরতির সান্নিধ্যে মুগ্ধ, এই ছেলেটির ভাবলেশহীনতা আরতির অহমে ঘা বসায়।

ঠোঁটের রেখা আরও একটু সরু করে, দেহের ভাষায় আরও একটু লাবণ্য ঢেলে আরতি যখন মোহময়ী দৃষ্টিতে তাকায়, যে কোনো পুরুষ সেই সম্মোহনে আটকা পড়তে বাধ্য। কিন্তু এই ছেলেটি ,পাগল নাকি!


********************************************

নিজের টেবিলে বসে একমনে ফাইল ঘাঁটছে দীপক। কাল মালহোত্রার প্রজেক্ট গুলো ফাইনালাইজ করে দিতে হবে। নতুন প্রজেক্টের অ্যাপ্রুভাল, সাইট ভিজিট, লেবার কনস্ট্রাকশন, ইনস্পেকসন, দীপকের এখন দম নেওয়ার সময় নেই। এমন সময় রিসেপসনিস্ট মিস লুসি এলেন কেবিনে, "স্যার, এক ভদ্রমহিলা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, বলছেন আর্জেন্ট দরকার!"

দীপকের স্বভাববশত ভ্রু কুঁচকে যায়, ভদ্রমহিলা!

"আসতে বলুন," বলেই আবার ফাইলে ডুবে যায় দীপক।

দরজায় নকের শব্দে মুখ তুলতেই ট্যারা হয়ে যায় দীপক, আরতি! গতকাল এনাকেই...

ব্যস্ত হাতে ফাইল সরিয়ে দেয় দীপক, "কী কান্ড, আপনি, আসুন আসুন বসুন!"

আরতি সরু চোখে জরিপ করে দীপককে, "অসুবিধেয় ফেললাম না তো?"

-"এমা ছি ছি, এ তো আমার সৌভাগ্য! বলুন, কী খাবেন? নিশ্চয়ই কলেজ থেকে আসছেন?"

বোতাম টিপে হাঁক দেয় দীপক, "বেয়ারা..."

আরতি গুছিয়ে বসে চেয়ারে, "সে সব দরকার পরে, আসলে একটা কথা জানার ছিল...!"

দীপক একটু সিরিয়াস, সরাসরি আরতির দিকে, "নিশ্চয়ই ,বলুন..."

-" আজ সকালেই আপনার বাড়ি থেকে আপনার আমার সম্বন্ধের সম্মতিসূচক একটা চিঠি এসেছে, আপনি জানেন?"

দীপক এবার নিরুত্তর। খানিকটা ইতস্ততও।

আরতি এবার একটু ঝুঁকে দীপকের মুখোমুখি, "দীপকবাবু, আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়নি? তাহলে আপনি সেটা নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন।"

আরতির চোখ থেকে চোখ সরায় দীপক, "আপনার এরকম মনে হওয়ার কারণ?"

-" যেদিন আমায় দেখতে গেলেন সেদিন আপনার চোখে বিরক্তি দেখেছিলাম, তাই..."

কথাটা শেষ হলো না, তার আগেই দীপক বলে, "তো কী করবো, একজন শিক্ষিতা মেয়ের বিয়ের বাজারে দর শুধুমাত্র তার চুল ত্বক পা দেখে? কেন আপনি যদি সর্বাঙ্গসুন্দর না হতেন, বিদ্যার দেবী আপনাকে বিদ্যা দিতে কার্পণ্য করতেন? ঠিক এই কারণেই এই মেয়ে দেখতে যাওয়ার নামে প্রহসনটাকে আমি তীব্র নিন্দা করি!"

মুগ্ধ চোখে আরতি দেখছে দীপককে, "এরকম পুরুষের কাছে হেরে গিয়েও জেতা যায়।"

গলায় কপটতা ফুটিয়ে আরতি জিজ্ঞেস করে, "তাহলে, এই বিয়েতে আপনার মত নেই?"


-" থাকতে পারে, যদি আপনি আমায় কথা দেন..."

আরতির বুক দ্রিমদ্রিম, "কী কথা..?"

- "আপনার যোগ্যতা দিয়ে ওই সব ঠুনকো দাঁড়িপাল্লা ছিঁড়ে দেবেন! নিজের পরিচয়ে বাঁচবেন? কথা দিন..."!

দীপকের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলতে ইচ্ছে করছে, "কথা দিলাম, তুমি পাশে থাকলে পৃথিবী জয় করতে পারি আমি!"

********************************************

মিক্স রিমিক্স গানের মাঝেই হঠাৎ কানে আটকালো একটা গান, পুরোনো গান, কিন্তু আজ আরতির কাছে কি ভীষণ নতুন, রোমাঞ্চকর... "আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে আকাশ খেলে হোলি..." আরতি আবার ভেসে যান অতীতে। 

বিয়ের পর প্রথম হোলি। তিন দিনের ছুটি ছিল দীপকের। আগের দিন বাড়ি ফিরেই আরতিকে তলব, "শিগগির গোছাও সব, শান্তিনিকেতন যাবো, বসন্ত উৎসব দেখবো!"

আরতির অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শখ ইচ্ছে দীপক কি ভাবে যেন টের পেয়ে যেত, আরতি জানতেই পারতো না। শান্তিনিকেতনে বসন্ত উৎসব; সেরকমই এক সুপ্ত আকাঙ্খা ছিল আরতির মনের মণিকোঠায়। দীপক সেটাও টেনে হিঁচড়ে বের করে এনেছে নিপুণ দক্ষতায়। প্রভাতফেরির সময় রাস্তা জুড়ে যখন লাল হলুদ শাড়ি পরে পলাশ ফুলের গয়না পরে মেয়েরা "খোল দ্বার খোল " নাচছে, দীপক আরতির হাত ধরে সোজা কোপাই নদীর ধারে। প্লাস্টিক খুলে বের করে পলাশ ফুল, নিজের হাতে আরতির খোঁপায় লাগিয়ে দেয়, মুঠো ভরে লাল আবির মাখিয়ে দেয় মাথায়। আরতির দুই গালের টোলে তখন একশো ফাগুনের সোহাগ। দীপক কানে কানে বলে, "এরকম সোহাগ আজীবন ধরে রেখো, তোমায় রঙিন দেখতে দারুন লাগে আমার!"

*******************************************

আরতির কলেজ যাওয়াটা ঠিক মত গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেনি বাড়িতে। না দীপকের বাড়িতে, না আরতির বাবার বাড়িতে। বৌমানুষ, গুরুজনদের ভাত বাড়া ছেড়ে কলেজে পড়তে যাবে, এ এমন কী কথা!

বাড়ির বউএর কোনো কর্তব্য নেই! স্বামী যথেষ্ট ভালো চাকরি করে, তবু বউএর কিসের জন্য কলেজ পাশ করতে হবে! এ যে ঘোর অনাচার! বারমুখী মেয়েমানুষের এসব কেবল বাইরে যাওয়ার অজুহাত। এবাড়িতে সকালের জলখাবার বাড়ির বউদের বানাতে হয়। খুব সকালে ঘুম ভেঙে নেয়ে ধুয়ে জলখাবার বানিয়ে দীপকের অফিসের রান্না সেরে আরতি কলেজ ছোটে। 


বিকেলের চা টাও এবাড়িতে বাড়ির বউই বানায়।

শাশুড়ি মা হুকুম দেন, "ছেলের ইচ্ছেতেই হোক, বা নিজের সাধেই হোক, যা ইচ্ছে করো, শুধু মনে রেখো সংসারকে অবহেলা করলে আমি কিন্তু সহ্য করবনা!"

আরতি পাঁচটার মধ্যে দৌড়ে বাড়ি ফেরে, বিকেলের চা, সন্ধ্যের জলখাবার বানায়। রাতের রান্নায় সাহায্য করে, রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আরতি বই খোলে, তখন তার চোখে লক্ষ ক্লান্তির ভিড়, বইয়ের ওপারে আরও একটি মুখ, কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে আরতির দিকে! একমাস পর আরতির পরীক্ষা। বাড়ির কর্তব্য সেরে নিজেকে তৈরি করতে পারছে কই? দীপককে কুণ্ঠা নিয়ে বলেই ফেলে, "আমি পরীক্ষা দেব না!"

সেদিন সন্ধ্যাবেলায় দীপক ফিরেই হাঁকডাক, "কোম্পানি কোয়ার্টার দিয়েছে, থাকতেই হবে, চলো গোছাও সব!"

সেদিন দীপকের চাপা গাম্ভীর্যের মাঝেও আরতি বুঝেছিল, এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র তারই জন্য। তাকেই আত্মনির্ভর করে তোলার জন্য। বেশ কাটছিল নতুন সংসারে। পরীক্ষা সামনে, কাজের লোকের জোগাড় হয়ে ওঠেনি তখনও, দীপক নিজের হাতে চা বানায়, খাবার বানায়। আরতি দীপকের হাত চেপে ধরে, "আমি থাকতে তুমি কেন এসব... ঈশ্বর আমায় ক্ষমা করবেননা!"

দীপক আরতির গাল টিপে দেয়, "এটুকু না করলে আমার ঈশ্বরও যে আমায় ক্ষমা করবেননা! তুমি সফল হবে আরতি, একটা দিন ঠিক আসবে দেখো, মেয়েরাও পুরুষদের মত কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে নিজেদের যোগ্য প্রমান করবে। নারী পুরুষ সমান হয়ে উঠবে!"

আরতি ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে থাকে স্বামীর দিকে, মনে মনে বলে, জনম জনম আমি শুধু তোমাকেই চাই!! আরতি কলেজ পাশ করেছে। একটা মেয়েদের স্কুলে চাকরিও পেয়েছে। দীপক ভীষণ খুশি, নিজে গিয়ে নেমন্তন্ন করে নিজের বাড়িতে, আরতির বাবার বাড়িতে।

দীপকের বাবা জানিয়ে দেন, "নেমন্তন্ন তো করছিস, রাঁধবে কে? নিশ্চয়ই কাজের লোক, তুই তোর বউ দুজনেই তো চাকরি করিস।

জানিস না, এবাড়িতে কেউ কাজের লোকের হাতের রান্না খায় না!"


মুখ কালো করে ফিরে এসেছিল দীপক। আরতির হাতে চাপ দিয়ে বলেছিল, "সময় দাও, অপেক্ষা করো, দিন পাল্টাবেই!" দুদিন পর আরতির মা এসেছিলেন বাড়িতে। আরতি তখন সবে ফিরেছে স্কুল থেকে। মেয়ের নিজের হাতে গড়া সংসার দেখে খুশি হয়েছিলেন। মুখে বলেছিলেন, "এবার নতুন অতিথি নিয়ে আয়, দেখবি সবার সব দূরত্ব ঘুঁচে যাবে!"

সেদিনও ছিল এমনই দোল। আরতি, দীপক, দুজনেরই ছুটি। আরতি মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে আগেই, এবার আর বাইরে কোথাও নয়, এই বাড়িতেই পালন হবে তাদের ভালোবাসার দোল খেলা। আজই দীপকের ঔরসে রঙিন করে ভরবে নিজের গর্ভ। সকাল সকাল স্নান সেরে একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে দীপককে ঘুম থেকে তুলতে যায় আরতি। ঘুমের মধ্যে ঠোঁটটা কেমন বেঁকে গেছে দীপকের! আরতির মায়া হয়, মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে চমকে ওঠে। হাত চকিতে চুল ছেড়ে নাকের কাছে, একি! দীপকের নিঃশ্বাস পড়ছে না কেন!!

********************************************

টেবিলের ওপর রাখা দীপকের ছবির সামনে অশ্রুহীন চোখে তাকিয়ে আছেন আরতি। তীব্র অভিমান ওই মানুষটির ওপর...ভালোবাসার মানুষকে আত্মনির্ভর করতে তাকেই ছেড়ে চলে যেতে হয়! কেন, কেন আজও হাত দুটো শক্ত করে ধরে রাখতে পারলে না?

দুবাড়ির সবাই দুষেছেন আরতিকে... মেয়েমানুষের লেখাপড়া! সত্যযুগ থেকে হয়ে আসছে, লক্ষ্মী সরস্বতী একসঙ্গে থাকতে পারে! যেমন দিগগজ টি হয়েছ, মা লক্ষ্মী তো বিমুখ হবেই, তা বলে স্বামীকেও খেতে হয়! চাকরি চাকরি করে বরের খেয়ালই রাখলনা হতচ্ছাড়ি! নাহলে ওরকম টাটকা ছেলে ঘুমের মধ্যেই পুট করে মরে যায়! নিশ্চয়ই কোনো চাপা অসুখ ছিল ছেলেটার। বলেনি কাউকে, কাকে আর বলবে, যে বউ ঘর ছেড়ে বর ছেড়ে ড্যাং ড্যাং করে চাকরি করতে বেরিয়ে যায়!

চোখের জল লুকিয়ে পাথর হয়ে গেছেন আরতি। নিজের বলতে পাশে থাকার মত কেউ নেই, শুধু দীপকের স্মৃতি ছাড়া, বলে যাওয়া কথাগুলি ছাড়া, "আরতি, তোমার মধ্যেই আজীবন থাকবো আমি, তোমার প্রতিটি রক্তকণায় ভীষণ রকমভাবে বাঁচবো আমি! পুরুষ আজীবন মেয়েদের খুঁটি হয়ে এসেছে, আরতি তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াবে, নিজের শরীরে ভর রাখবে, অন্য কারোর জন্য না, তুমি নিজের জন্য বাঁচবে, বলো, কথা দাও!"


চল্লিশ বছর ধরে আজকের দিনটায় আরতি পালিয়ে বেড়িয়েছেন। এই ঘর, সব আসবাব সব কিছুতেই তো দীপক মিশে আছেন। আরতির বারবার মনে হয়েছে, দীপক সেদিন নিশ্চয়ই আরতিকে ডেকেছিলেন, অসহ্য যন্ত্রনায় বুকে হাত চেপে নিশ্চয়ই খুঁজেছিলেন আরতিকে, আরতি ক্লান্তি মেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাই শুনতে পায়নি, বুঝতে পারেননি স্বামীর মৃত্যুযন্ত্রনা! নিজেকেই দায়ী মনে হয়েছে বারবার। তাই সকাল বেলায় পলাশ আর ধুপ দিয়েই আরতি বেরিয়ে যান, এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ান, চারিদিকে রঙের খেলা, আরতি বিবর্ণ নারী, কেউ তাঁকে রং দেয় না, সুনিপুণ ভাবে এড়িয়ে চলে। সারাদিন এতালবেতাল ঘুরে ঘরে ফিরে ক্লান্ত আরতি ঘুমিয়ে পড়েন, শেষ হয়ে যায় হর্ষের দিনটা।

গোলাপি ছোপ সাদা খোলের শাড়ি পরে আরতি আজ বেরিয়ে এসেছেন দরজার বাইরে। সামনের রাস্তায় পাশের বাড়ির ভাড়াটের বাচ্চা দুটো রঙ খেলছে। আরতিকে দেখেই দৌড়ে আসে বাচ্চাদুটো, রঙ মাখা হাত তুলে বলে, "তুমি রঙ মাখনি কেন? জানোনা আজ রঙ মাখতে হয়, নাহলে কৃষ্ণ ঠাকুর পাপ দেয়, জানো, আজ কৃষ্ণ ঠাকুরও রঙ খেলে।"

আরতি উবু হয়ে বসেন, "কে বলেছেন তোমাদের এসব?"

-"কেন মা বলেছে, আমরা তো চান করতে চাইনা, শ্যাম্পু করতে চাইনা, তাই মা বলেছে, আজ অনেক রঙ মেখে সাবান দিয়ে চান করতে হয়, তুমিও কি সাবান মাখতে ভয় পাও, তাই রঙ মাখোনি?" দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে বরফ চোখ থেকে। বাচ্চা দুটোর রঙিন হাত নিজের গালে বুলিয়ে নেন আরতি, বলেন, "আজ খুব করে সাবান মাখবো, সব নোংরা ধুয়ে দেব।"

ফিরে আসেন ঘরে, দীপকের সামনে, "আজীবন চেয়েছিলে আমি রঙিন থাকি, আমিও চেয়েছিলাম তোমার রঙে আজীবন নিজেকে রাঙাতে, কেন চলে গেলে সেদিন, আরও স্বাবলম্বী করতে চাও আমায়?

বেশ, হবো, আরও পরিপূর্ণ হবো আমি, দ্যাখো আজ চল্লিশ বছর পর আবার রঙ মেখেছি, এবার থেকে প্রতিবছর মাখব, এটাই তো চেয়েছিলে তুমি।


আমি বুঝেছি, ভালোবাসা মানেই শুধু মানুষটার সঙ্গে সারাজীবন থাকা নয়, তাঁর সমস্ত ইচ্ছের মান রাখা, অনুভূতিগুলোর যত্ন করা, নিজের মধ্যে মানুষটাকে ভীষণ রকম বাঁচিয়ে রাখা।

তোমার সব চাওয়া পূরণ করবো আমি, বদলে তুমি কথা দাও, প্রতি জনমে তুমি শুধু আমারই হাত ধরবে, কথা দাও..."

পলাশ ফুলের মালার ফাঁকে দীপকের ছবিটা, এতদিন ভ্রু কুঁচকে ছিল। আজ সেই ভ্রু জোড়া যেন সমান টানটান হয়েছে। ঠোঁটের কোণেও কি চোরা একটা হাসি ফুটে উঠলো?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy