Sourya Chatterjee

Classics Others

4.8  

Sourya Chatterjee

Classics Others

ছোট্ট একটা স্কুল

ছোট্ট একটা স্কুল

5 mins
321


-next please

ইন্টারভিউ রুমের দরজাটা খুলে তার আগের প্রার্থী বেরিয়ে এলো। সব ফাইল আর ডকুমেন্টস গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালো ইকবাল। এবার তার পালা।

-May I ?

-yes, please come in.

-তুই! কেমন…

-please take your seat! Tell me about yourself!!

ঘাবড়ে গেল ইকবাল। ডিসেম্বর মাসের শীতেও কপালে জমা ঘর্মবিন্দু গুলোকে রুমাল বার করে মুছলো ইকবাল। 

-are you alright?

-হুম হুমম, yes ma’am.

-so, tell me about yourself.

-yes, I am md. Iqbal from Burdwan…


ইন্টারভিউ শেষ করে বাইরে এসে সবকিছু দেখে নিল একবার ইকবাল, ওই আর কি! সব ডকুমেন্টস ঠিকঠাক নিয়ে বেরিয়েছে নাকি!কিছু ফেলে এল না তো! এসব! খাওয়াও হয়নি কিছু সকাল থেকে। একটা দোকানে রুটি বানাচ্ছে পাশেই। খেয়ে নিল ইকবাল। ঠিকঠাক তো উত্তর দিতে পারল না। পরিশ্রমই সার হল। তাও যদি..

-এ ধর্মতলা ধর্মতলা..

বাস এসে গেছে। ফাঁকাই বেশ। জানলার ধারে বসে কখন যে ঘুমে দু চোখ লেগে গেছে মালুম ই হয়নি ইকবালের।

স্বপ্নের দেশে ইকবাল তখন স্মৃতির তরণী বেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে। সংস্কৃত ক্লাস নিচ্ছেন ভূবন স্যার। বেঞ্চের উপর ইকবাল আর সৌমেন দুজন একে অপরের কান ধরে দাঁড়িয়ে। রোজকার ঘটনা। একে একে রণজয় স্যার, শৈবাল স্যার, অনুপ স্যার এলেন, ক্লাস করালেন। কোনো ক্লাসে স্কেলের চাপড়, কিংবা কোনো ক্লাসে নীল-ডাউন, এই তো ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অবশ্য স্যার না এলে মাঠে যাদের নেতৃত্বে সবাই বাঁদরামি করত তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল সে। ওই তো কর্দমাক্ত বুটজোড়া পরে তন্ময় আসছে! তন্ময়ের ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে সব জল ফেলে দিল ও। হে হে। কেঁদে ফেলেছে.. কেঁদে ফেলেছে! বাচ্চা ছেলে।

ঢং ঢং ঢং ঢং!! টিফিন!!! চল মাঠে চল। আগে তো চানাচুর খাওয়া যাক!! চল!! এই এরপর কিন্ত ইন্দ্রাণী ম্যাডামের ক্লাস। এক মিনিট দেরি করেই ক্লাসে ঢুকলেই কিন্তু গার্জিয়ান কল! উফফ! ক্লাসের মেয়ে গুলো না! দেড়টা বাজলেই ম্যাডামকে ডেকে এনে ইচ্ছে করে বকা খাওয়াবে। পরীক্ষাতেও দেখায় না! ক্লাসেও এরম মন দিয়ে পড়া করবে ওরা আর স্যার ম্যাডামরা বকবে এদের।

-এই চানাচুর দে শালা!

-এ নে।

-কি ভাবছিস রে বে!

-আরে ইন্দ্রাণী ম্যাডামের ক্লাস! ফুটবল টা খেলতে শুরু করতে না করতেই তো ঘন্টা বাজিয়ে দেবে হরেন কাকা। আর জানিস ই তো মেয়েগুলোকে! সব এক একটা ইয়ে!!

-বাবা ইকবাল, নাটক মারাস না তো! ডুবে ডুবে তো হেব্বি জল খাচ্ছ বস। বটতলার মাঠটায় স্কুল ছুটির পরে দুজনে দুটো আইসক্রিম নিয়ে!! আহা!

-না রে বোকা! ওসব নয় কিছু! 

-মুখটা তো পুরো লাল হয়ে গেছে বে লজ্জায়। দে, চানাচুর দে শালা!

ঢং ঢং ! ব্যাস!! ক্লাসে চল! ফুটবল টা গেল পুরো। এই ..এরও পরে অঙ্ক ক্লাস আছে। সৌমেন, লাস্ট বেঞ্চে জায়গা রাখিস! অঙ্ক স্যার কি যে লেখে বোর্ডে কিছুই মাথায় ঢোকে না! গোবর দিয়ে মাথার দরজা খানা বন্ধ করে রাখা! ঢুকবেই বা কি করে! 

-ইকবাল, স্ট্যান্ড আপ!

কেলো করেছে রে।

-এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলা বলো।

-ওই তো স্যার, এ প্লাস এ বি প্লাস বি।

ধুর, এই সৌমেন! বল না! নাহ, রক্ষে নেই! অঙ্ক স্যার ঘড়ি টা খুলে টেবিলের উপর রাখলেন। শেষ তো আজ পুরো! এই সৌমেন! বল না।

-স্যার,বি প্লাস এ বি প্লাস এ স্যার।

-ঐশানী, বলো তো

ও তো বলে দিল। এই রে স্যার তো ওকে বসতে বলে এগিয়ে আসছে লাস্ট বেঞ্চের দিকেই। 

-উউ..লাগছে স্যার। উফফ! খুব জ্বর স্যার। মারবেন না স্যার! 

ঢং ঢং ঢং ঢং! 

উফফ! জয় হরেন কাকার জয়! বাঁচিয়ে দিল এ যাত্রা! ছুটি!!!

তারপর সাইকেলটা নিয়ে বাড়ির দিকে পাইপাই করে ছুট গুলতানি শেষে! বটতলা টা আসতেই সাইকেলের গতি আস্তে করল ইকবাল। ঐ তো! ঐশানী। আইসক্রিম কিনছে।

-ঐ,

-খাবি জল আইসক্রিম?

-উঁহু ওই কমলা দু টাকার পেপসিটা খাবো

-চ, বসবি তো মাঠটায়?

-চ,

-এ পেপসিগুলো খাস না। এগুলো নর্দমার জল দিয়ে বানায়। শুনবি তো না।

-তোর মাথা, আমার মুন্ডু।

-এই বুদ্ধু, এ প্লাস বি হোল স্কোয়ার কে বলতে পারেনা রে!?

-আহ, সবাই সব পারে নাকি! এই যে আমি ফুটবল খেলি, তুই পারিস নাকি!?

-মুখে কথা লেগেই আছে। স্যারের কাছে মারটা তো খেলি। 

-ধুর! আর আমি তো তোর দিকে তাকালাম। বললি না কেন! লিপ রিডিং করে নিতাম।

-স্যার বুঝে যেতেন। বোকার মত কথা বলিস না।

-কিছু বুঝতেন না! বললেই হলো নাকি!

- পড়াশুনায় মন দে। মা বলে পড়াশুনা না করলে বড় হয়ে নাকি চাকরি পাওয়া যায় না। তখন বুঝবি ঠ্যালা।

-কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে। চপ বেচবো সেরম হলে।

-চপ ভাজতে পারিস নাকি! যে বেচবি!

-ভাজবি তো তুই! আর বেচবো আমি।

-আমার বয়ে গেছে চপ ভাজতে।

-তবে তুই কি করবি?

-ম্যাথ টিচার হব। পড়াব। অঙ্ক করাব।

-ও, তবে তো আর একসাথে কিছু করা হবে না বল আমাদের!

-উমম! একটা প্ল্যান আছে। তুই খেলার টিচার হবি আর আমি ম্যাথের। কেমন হয়!!

-তা কোথায় পড়াব আমরা!?

-একটা ছোট স্কুল বানাব। হুমম! বেশ একসাথে কাজের ফাঁকে আড্ডা মারতে পারব এরম আইসক্রিম খেতে খেতে।

খুব রেগে গেল ইকবাল। পা টা মাঠের উপর দুম করে ফেলল। আর তাতেই ঘুম টা ভেঙে গেল।

সবে সল্টলেক! 

-দাদা, ঠিক করে বসুন না! ঘুমাচ্ছেন ঘুমান। ঠিক করে বসে ঘুমান! জোটেও বটে! যত্তসব।

ইকবাল বুঝতে পারল স্বপ্নের সাথে তাল মিলিয়ে বোধহয় খানিক হাত পাও ছুড়েছে সে। ছোটবেলার স্মৃতিটা এতটাই আচ্ছানিত করল আসলে! আর তাছাড়া! সত্যিই তো! ছোটবেলায় কে কি বলেছে সেসব নিয়ে বসে থাকলে তো জীবন থেমে থাকবে না। সময়ের তালে তাল মিলিয়ে চলে সবাই এগিয়ে গেছে। থেমে থাকবেই বা কেন!

আজ ইন্টারভিউ রুমে ইন্টারভিউয়ার হিসেবে ঐশানী কে দেখে খানিকটা ভেবলেই গেছিল ইকবাল। কিন্তু ঐশানী তো ওকে মনে হয় চিনতেই পারল না। নাকি চিনতে পেরেও না চেনার ভান করল! কে জানে! 

মোবাইলে টুং করে ই-মেইল এর নোটিফিকেশন ঢুকলো। লেখা আছে “you are not selected”। জানা কথাই! এমনিতেও পারেনি। তার উপর ঐশানীকে দেখে মনে হলো আরোই নেবে না। বেকার গেল দিনটা!

রাস্তায় বড্ড জ্যাম। বাস এগোচ্ছেই না। পাশে একটা বড় মাঠ নজরে পড়ল ইকবালের। সেই ছোট্টবেলার বটতলার মাঠটার মত অনেকটা। কয়েকটা ছেলে ফুটবল খেলছে। লাল জামা পরা একটা ছেলে বল টা নিয়ে ড্রিবল করতে করতে এগোচ্ছে! না! বাইরে মেরে দিল। গোল করতে পারল না। ইকবালের মুখে ছোটবেলার স্মৃতিমাখা একটা হাসি।

-এখনো খেলা হয় বুঝি ফুটবল?

ইকবালের কানে পৌঁছালো না কথাটা ঠিক! পেছনের সিট থেকে ঝুঁকে পরে ইকবালের গলা জড়িয়ে ধরল ঐশানী।

-বলছি, নর্দমার জলের পেপসি এখনো খাওয়া হয়?

পেছন ফিরল ইকবাল।

-ঐশানী!! তুই!!

-এমন বেঘোরে ঘুমাচ্ছিলিস! খেয়ালই করিস নি বল। তুই বেরোলি! আমি কিছু ফর্মালিটিস সেরে দে ছুট! ভাগ্যিস রুটি খাচ্ছিলি! তাই ধরতে পারলাম! কেমন আছিস বল!

একটু হাসল ইকবাল। চাকরিটা তো চাইলেই পাইয়ে দিতে পারত ঐশানী! চিনতে পেরেছে যখন! খানিক টা হতাশ হয়েই বললো

-চাকরিটা হয়নি রে ঐশানী

-জানি তো! বাদ দে ওসব! তারপর বল। খবর কি! বিয়ে সাদি করলি!?

-না রে! খুবই কম স্যালারির চাকরি করি। বিয়ে সাদি করে সংসার চালানোর মত ইনকাম করি না রে!

হাসল ঐশানী।

-আমিও করিনি জানিস। এত কাজের চাপ! ছেলে খোঁজার সময়ই পেলাম না।

কত না বলা কথারা নীরবতার পাহাড় জমায় হঠাৎ করেই। ইচ্ছে,অনিচ্ছে,সুখ,দুঃখর গল্পরা সেই পাহাড় বেয়ে ওঠা নামা করে চলেছে। খানিক পরে ঐশানী ই সেই নীরবতা ভাঙলো। 

-ভালো লাগছিল না। তারপর আজ তোর সাথে দেখা! বুঝলি! আর সময় নিলাম না।

একটু থামল ঐশানী। তারপর আবার বলতে শুরু করল

-যথেষ্ট সেভিংস ও হয়েছে। আমাদের ড্রিমটাকে চেস করবি? একটা স্কুল বানাবি? দম নিতে পারছি না রে কাজের চাপে। চ, স্কুল টা বানাই! 

-আমার না হয় কাজে তেমন চাপ নেই। সামলে নেব। তোর তো প্রচুর চাপ বললি!

-এই দ্যাখ! 

-কি রে!

-আমার দু বছরের লিভ উইদাউট পে অ্যাপরুভড। বাই দ্য ওয়ে খেলার স্যার এখন এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের ফর্মুলা জানে তো!

বাসটা খুব স্পীডে চলছে তখন।আর ইকবালের মনে স্বপ্ন আর বাস্তব মিলেমিশে এক হয়ে ভোরের সূর্যোদয়ের লালচে আভা মাখা সমুদ্রের ঢেউয়ের মত আছড়ে আছড়ে পড়ছে। 

-একটা ছোট্ট স্কুল বানাবি তো রে আমার সাথে?


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics