ছায়ানট ষড়বিংশ পর্ব
ছায়ানট ষড়বিংশ পর্ব
রোগী পরীক্ষা আরম্ভ করার আগে নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলে নিলেন ডাক্তার এবং ব্যারিস্টার সাহেবরা ।
তারপর প্রথমে তক্ষশীলাদেবীকে চেক করলেন । কথাবার্তায় কোন অসঙ্গতি আপাতভাবে পেলেন না। বিপত্তারণ বাবুরও একই ব্যাপার ।
তখন ডক্টর বল বললেন - আপনাদের ব্লাড টেস্ট করতে হবে ।
উভয়েই বললেন - করুন।
এরপর ডাক্তারবাবু তাঁদের প্রিসিনাপ্টিক ওর একটি রাসায়নিক পদার্থ যা প্রিসিনাপ্টিক নিউরোন ভেসিকেল থেকে সিনাপসের মধ্য দিয়ে এক নিউরোন থেকে অন্য নিউরোনে বা পেশীতে বা গ্রন্থিতে স্নায়ু উদ্দীপনা বহন করে।
সেদিনের মত টেস্ট স্যাম্পেল নিয়ে ওঁরা চলে গেলেন ।
জেলর সাহেব প্রবেশ করলেন সেলে । বিপত্তারণ বাবুকে বললেন - তোমাদের শরীর থেকে যে রক্ত নেওয়া হল সেই কথা তোমরা কি আগে থেকে জানতে ?
বিপত্তারণ বাবু বললেন - না স্যার ।
- তাহলে তোমরা রাজী হলে কেন ? আর রাজী হলেও কিছু করার নেই । এবার হরি নাম জপ ; মুক্তি পাবে ।
তক্ষশীলা দেবী বললেন - সে তো দিনরাত জপছি বাবা । মুক্তি আর পাচ্ছি কোথায় ! এই তো পচিয়ে পচিয়ে মারছ ।
জেলর বললেন - শোনো এই যে উকিল আর ডাক্তার এসে এত কাণ্ড ঘটিয়ে গেল ; তোমরা কি ভাবছ ?
তক্ষশীলা দেবী বললেন - আমরা কিছু ভাবছি না বাবা। ভাবছ তুমি পাছে আমাদের সেল থেকে নিয়ে পালায়! ভেবো না, আমরা এমন কাজ করব না । তোমার কাছে একটা নিবেদন ছিল ।
- বল ।
- বলছিলাম যে আমাদের দু'জনেরই তো বয়স হয়েছে ! দু'টো আলাদা কুঠুরিতে না রেখে একটাতে থাকতে দেবে বাবা ?
- না না। অসম্ভব । যদি জানাজানি হয়ে যায় ; আমার চাকরিটাই থাকবে না ।
- এই উপকারটুকু কর বাবা । ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন ।
- পাগল ! ভগবান তোমাদের কি উপকার করেছে বল তো ! এই যে কাণ্ড-কারখানা করে এতটা পথ হেঁটে এলে - লাভ কিছু হয়েছে ? সেই তো কনডেমড সেলে পড়ে রইলে !
- একটু দয়া কর বাবা । মরণ দিন পর্য্যন্ত যেন দু'জনে একসাথে থাকতে পারি ।
- একদমই অসম্ভব । আমি কোনভাবেই এমন অনুমতি দিতে পারি না । আমাকেও তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে।
আচ্ছা, তোমাদের বাঁচার যদি এতই শখ ছিল তবে এই ঘটনাগুলো ঘটালে কেন ?
বিপত্তারণ বাবু এতক্ষণ চুপ থেকেছেন । এবার নিস্তব্ধতা ভেঙে বললেন - আমদের মত কেউ এখানে না এলে তোমার চাকরি তো এমনিতেই নট হয়ে যেত । বুড়ী মানুষ, আবদার ভেবে পূরণ করতে পারবে না ?
জেলর বললেন - তোমাদের জন্য মায়া হচ্ছে কিন্তু আমি একজন অনুগত কর্মচারী হয়ে এমন বেআইনি কাজ করব কি ভাবে ?
তক্ষশীলা দেবী বললেন - অন্তত আজকের রাতটুকু কাছাকাছি থাকতে দাও !
জেলর সাহেব অবাক হলেন । এদের মধ্যে এত ভাব তবু জঘন্য কাজ করল কেন ! তাও আবার নিজের মেয়েদের সঙ্গে !
বললেন - তোমরা এমন বায়না ধরেছ কেন বল তো ! কোন উদ্দেশ্য আছে নাকি ?
তক্ষশীলা দেবী বললেন - আর কোন উদ্দেশ্য বিধেয় নেই বাবা । ইচ্ছে কর তো ভালো নইলে আর কি করব !
জেলর একটু ভেবে নিলেন । তারপর বললেন - ঠিক আছে ; কটা দিন তো দূরের কথা , আজকের রাতটাও দিতে পারব না । তবে রাত এগারোটা পর্য্যন্ত একসাথে গালগল্প করতে পারো !
বিপত্তারণ বাবু বললেন - ঠিক আছে বাবা । যা বললে তাই হবে । রাত এগারোটা পর্য্যন্তই সই ।
বলে পা মুড়ে তক্ষশীলা দেবীর কাছে বসলেন। জেলর চলে গেলে তক্ষশীলা দেবী বললেন - উকিলটা বেশ শক্তপোক্ত মনে হল ।
বিপতারণ বাবু বললেন - বেশ বুদ্ধিমানও। দেখলে না কেমন সুন্দর করে যন্ত্র বের করে ম্যানেজ করে নিল ।
তক্ষশীলা দেবী বললেন - মনে হচ্ছে কোথাও একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি ।
- আমিও । ওর বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। কানের যন্ত্র দিয়ে
কি করল বল তো !
তক্ষশীলা বললেন - সে যাই করুক; আমাদের উপকার হলেই হল ।
জেল থেকে বেরিয়ে ওঁরা ডাক্তারবাবুর গাড়িতে গিয়ে বসলেন।
মিঃ নাগার্জুন বললেন - যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন স্যার । এই পটভূমি ধরে ছবি আঁকতে পারলে আমাদের জিত হবেই।
- আমাদের নয় ; বলুন আপনার । আপনি উকিল। আমি ডাক্তার । আপনার সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে কাজ আর আমার পরীক্ষিত সত্যকে পুনঃ প্রতিষ্ঠা করা কাজ
- যা বলেছেন স্যার ।
- মিঃ নাগার্জুন, পরীক্ষার ফলাফল কিন্তু বায়াস করতে পারব না ।
- কে আপনাকে করতে বলছে ? আমি নিশ্চিত: মেন্টাল ডিস্টরশণ থাকবেই। মিলিয়ে নেবেন আমার কথা।
- লেট আস সি । তবে আপনার হিয়ারিং এইডটা খুব ভালো কাজ করেছে ।
মিঃ নাগার্জুন একটু হাসলেন ।
- স্থান, কাল, পাত্র বিশেষে কিছু কিছু খেলা দেখাতে হয় । এজন্য অবশ্য আপনার বিশ্লেষণ খুব ভালো হয়েছে।
আমরা কোন ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয় ; দু'টো প্রাণ বাঁচানোর জন্য লড়াই করছি। ওটা একটা নিছক হিয়ারিং এইডই ছিল । জেলরকে বোঝাতে অসুবিধা হয়নি ।
গাড়ি নাগার্জুনকে স্টার হোটেলে নামিয়ে ডাক্তারবাবুর বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল ।
দু'দিন পর লুপিন ল্যাব থেকে রিপোর্ট পাঠানো হল ডক্টর বলের ই-মেইলে ।
খুব কৌতুহলের সঙ্গে ডাক্তারবাবু দেখলেন রিপোর্টখানা। যা ভেবেছিলেন তাই । তিনি হতবাক হয়ে গেলেন যে স্বামী এবং স্ত্রী অর্থাৎ বিপত্তারণ এবং তক্ষশীলা দেবীর হরমোনে টেস্টোস্টেরন এর আধিক্য।
এই হরমোন বেশি মাত্রায় নি:সৃত হলে মানুষের মনে বৈকল্য ঘটে । নিউরোনকে অনিয়ন্ত্রিত মাত্রায় চালনা করে । ফলে স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনে রাগ (ক্রোধ) বেশি মাত্রায় বৃদ্ধি পায় ।
আমরা বলি না !- লোকটা বড় খিটখিটে বদমেজাজি। এই হরমোনটিই এর জন্য দায়ী ।এর অস্বাভাবিক ক্ষরণ মানুষকে পশুর পর্য্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। বলে মানুষ ঠাণ্ডা মাথায় নির্বিকারে খুন করে যেতে পারে ।
ডাক্তার বাবু চেঁচিয়ে উঠলেন - ঈউরেকা, ইউরেকা ।
তাঁর এই আনন্দ প্রকাশ কেউ দেখতে বা শুনতে পেল না ঠিকই ; তিনি কিন্তু উত্তেজনায় ছটফট করতে লাগলেন ।
ভাবলেন কেন যে রাতটা জলদি শেষ হয় না !
তিনি ফোন ঘোরাতে লাগলেন । কিন্তু স্টার হোটেলে নৈশভোজে মত্ত মিঃ নাগার্জুনকে পাওয়া গেল না । রিসেপশনিস্ট জানাল - মনে হচ্ছে স্যার রুমে নেই স্যার । আপনি আধঘন্টা পর ফোন করবেন প্লীজ ।
ডাক্তার বাবু আর কি করেন ! বাধ্য হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন ।
নৈশভোজের পর রুমে ফিরবার সময় মিঃ নাগার্জুনকে রিসেপশনিস্ট তাঁর ফোন আসার কথা জানালে মিঃ নাগার্জুন বললেন - হু ওয়াজ দ্য কলার ?
- স্যার , সামওয়ান মিঃ সুবীর বল
নাগাজুন সাহেব রিসেপশনিস্টের কাছ থেকে ফোন নিয়ে ডায়াল করলেন ।
অন্য প্রান্ত ডাক্তার বাবু বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন । কিন্তু ঘুম আসছে না । তিনি হয়তো মিঃ নাগার্জুনকে আবার ফোন করতে যাচ্ছিলেন - বেজে উঠল ফোনটা ।
রিসিভার তুলে বললেন - হাই মিঃ নাগার্জুন ! ভিনি, ভিডি, ভিসি ।
মিঃ নাগার্জুন বললেন - ইউ আর জিনিয়াস, ইউ আর রিয়েলী গ্রেট ।
( ক্রমশঃ)
