বটবৃক্ষ
বটবৃক্ষ
অঞ্জন বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তিনজনের সুখের সংসার ।ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন ওর বাবা সুপ্রতিম আর মা রেবা,অঞ্জনকে চোখের আড়াল হতে দেন না ।ছোটবেলা থেকেই তাই বাবা-মার শিক্ষা, ভালোবাসা ,আবেগ ,নির্দেশ এসবের সঙ্গে মায়ার বাঁধন ওর একটু বেশিই। ও জানে বাবা মা সব সময় ওর পাশে আছে এবং থাকবে ।
সেই অঞ্জনেরই একদিন হঠাৎ একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট হল।ও তখন ক্লাস ফোরে পড়ে ।বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর বাড়িতেই খেলতে গিয়ে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল কয়েক ধাপ ।মাল্টিপল ফ্র্যাকচার, সঙ্গে কোমরের ভয়ঙ্কর চোট। জীবনে কোনদিনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ। নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে থাকত অঞ্জন ।একের পর এক অপারেশন হবে ,জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। অঞ্জনের চোখে জল, অজানা আশঙ্কা।ও কি আর নার্সিংহোম থেকে নিজের বাড়ি ফিরতে পারবে না?কোনোদিন কি হাঁটতে, স্কুলে যেতে, খেলতে পারবে না ?ওর ছোট্ট মনে সেদিন অনেক ঝড়। কিন্তু মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সুপ্রতিম বাবু বললেন "তোর কিচ্ছু হবে না ,সব ঠিক হয়ে যাবে।" মা গালে চুমু খয়ে বললেন "সোনা আমার, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস, একদম ভয় পাবি না।" বাবা-মার এই 'সব ঠিক হয়ে যাবে' কথাটা সেই দিন থেকে অঞ্জনের জীবনে সবচেয়ে বড় ওষুধ, সবচেয়ে বড় মনোবল হয়ে গেল। ও বিশ্বাস করেছিল সত্যিই সব ঠিক হয়ে যাবে ।আর তাই হল। বিখ্যাত নিউরোসার্জন এর ট্রিটমেন্ট ,সর্বশ্রেষ্ঠ নার্সিংহোমের যত্ন -অঞ্জনের অপারেশন সফল হল।তারপর অমানুষিক লড়াই,দাঁতে দাঁত চেপে অঞ্জনের নিজের পায়ে হাঁটার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম।দাঁড়াতে ওকে হবেই। কষ্ট হত খুব,চোখে জল এসে যেত ,তবু লড়াই থামেনি।জানত বাবা মা ওর পাশে আছেন।তাদের ভরসার মর্যাদা অঞ্জন দিতে পারবে না?একদিন,তখন ও নিজের পায়ে কয়েক সেকেন্ডের বেশি দাঁড়াতে পারে নাহাঁটা তো দূর,অসহ্য যন্ত্রণা। সেদিনই হঠাৎ দেখে ফেলেছিল মার চোখে জল,মুখটা লুকিয়ে নিলেন।লুকিয়ে কত কাঁদতেন কে জানে?।সারারাত জেগে দুজনে ওর পাশে বসে থাকতেন।একদিন শুনে ফেলেছিল করিডোরে পায়চারি করতে করতে বাবা যেন কাকে আড়ালে বলছেন “ আমি হেরে গেলাম রে।ছেলেটা....” ।সেদিন ওর মনে জেদ চেপে গেল।ছোট্ট বুদ্ধিতে এটুকু বুঝে গেল,আর কারো না হোক,বাবা মার জন্য ওকে সুস্থ হতেই হবে।কিছুতেই ওদের হেরে যেতে দেবে না।ওদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।ওদের তিনজনকেই লড়াইটা জিততে হবে।আর সত্যিই কয়েক মাস পরে বাড়ি ফিরে আসে ও, একেবারে সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে হেঁটে। সেই থেকে অঞ্জনের নিজের থেকেও নিজের বাবা-মাই জীবনের সবথেকে বড় আশা ভরশা,ঠিক ভগবানের মতো ।
হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল অঞ্জনের। কোথাও চান্স পায় না উচ্চশিক্ষায়। কেরিয়ারটা শেষ হয়ে যাবে। বাবা সুপ্রতিমবাবু বুঝতে পারেন ওর উৎকণ্ঠা, মনোকষ্ট ।মা রেবাও অঞ্জনের মনের ঝড়ঝাপটা কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কেউ ওকে বকাঝকা করেন না ।বাবা বলেন "চিন্তা করিস না ,তোর তো সাইন্সে ভালো নম্বর আছে ,আমি দেখছি কি করা যায়। তোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যাবার দরকার নেই ,অন্য অনেক ভালো কোর্স আছে ।সব ঠিক হয়ে যাবে।" মাও হেসে ওর পিঠে হাত রেখে ওর মনে বল বাড়ান। বাবা-মার সমর্থন, ভরসা যোগানো ,ওর গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটু আলোর রেখা হয়ে দেখা দেয়। জীবনের দুর্বিষহ দিনগুলোয় ওকে বাঁচতে শেখায়। একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। "সব ঠিক হয়ে যাবে।"
ঘুরে সত্যিই দাঁড়িয়েছিল অঞ্জন। ডাটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে আজ ও একটা ভালো কোম্পানিতে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করে। মাঝেমধ্যেই বিদেশে যায় সেমিনারে বা ক্লাস নিতে।আজ ও প্রতিষ্ঠিত,আজ ও জানে জীবনে কিভাবে বারবার ঘুরে দাঁড়ানো যায়, ঘুরে দাঁড়াতে হয়। আর তার সব কৃতিত্ব ওর বাবা-মার।
ঠিক এই সময় অঞ্জনের জীবনে আবার একটা ঝড় আসে, সব এলোমেলো হয়ে যায়।বর্ণালীর সঙ্গে হঠাৎ ব্রেক আপ হয়ে যায়, পাঁচ বছরের সম্পর্কটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ।বর্ণালীর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা ,মেনে নিতে পারে না অঞ্জন ।জীবনটা যেন ছারখার হয়ে যায় ।চোখে জল, একা উদ্দেশ্যহীন পথ চলতে চলতে হঠাৎই কলকাতায় ফিরে আসে ও,চাকরিটাও দুম করে ছেড়ে দেয়। মুখ গুঁজে, ঘর বন্ধ করে পড়ে থাকে, খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করে না। এবারেও কিন্তু প্রতিবারের মতোই পাশে পায় সেই বাবা-মাকে। বন্ধুর মতো বাবা এসে নানা কথায় ওকে ভোলানোর চেষ্টা করেন ঠিক ছোটবেলার মতো, মনটাকে আশা দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। অঞ্জন এখন বড় হয়েছে, বন্ধু বান্ধব হয়েছে
, আলাদা জগত হয়েছে ।বাবা-মাকে আর তার আগের মত সেভাবে দরকার নেই। বাবা-মার সঙ্গে ছোটবেলার সেই বাঁধনটা এখন আর ততটা নেই, অন্তত রোজকার জীবনে।কিন্তু ও দেখল, ওর ধারনা বিশাল ভুল। বাস্তবে, আজও বাবা মা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় আশাভরসা ,সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব। বাবা অফিসে ছুটি নিয়ে ,ওর পাশে পাশে থাকেন ।মা নতুন নতুন রান্না ,নতুন নতুন গল্পের বই এনে দেন ,ছোটবেলার ছবি- ভিডিও দেখাতে থাকেন। নানাভাবে দুজনে, অঞ্জনের মনের আঘাতটাকে মলম দেবার চেষ্টা করেন। বাবা জোর করে একদিন ওকে বাইরে বের করে আনেন, মাঝে মাঝেই ও রাজি না হলেও আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের ডেকে এনে ওর সঙ্গে দেখা করান। ওর প্রিয় সব জিনিস কিনে আনেন, আগডুম বাগডুম গল্প করতে থাকেন,এমনকি ছোট্ট মনে করে একটা নতুন ক্যারামবোর্ড পর্যন্ত।
অঞ্জন সত্যিই ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠে সেই অবসাদ। বাবা-মার সেই ঘিরে থাকা, আঁকড়ে থাকা ,পাশে থাকা আর চোখে চোখে একটাই কথা চব্বিশ ঘন্টা ধরে মুখে না বলেও বুঝিয়ে যাওয়া, "সব ঠিক হয়ে যাবে ।" তিন মাস পরে অঞ্জন চাকরি রিজয়েন করে।
এদিকে সুপ্রতিমবাবুর বয়স হচ্ছে, রেবাগিন্নিরও আজকাল কি একটা হয়েছে, একটুতেই দুর্বল হয়ে পড়ে,চোখের তলায় কালি পড়েছে ।ওদের শরীরে বয়স থাবা দিয়েছে বুঝতে পারে অঞ্জন, একটা অজানা ভয় এসে গ্রাস করে ওকে ।বাবা মাকে ছাড়া ও কি করে পারবে? কি করে বাঁচবে ?বাবা-মাও সেটা বুঝতে পারে ,অঞ্জনের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় ।
এটা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষেরই গল্প। বড় হয়ে ওঠার গল্প। আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের গল্প ।বাবা-মা-সন্তানের বাঁধন যুগে যুগে ,দেশে দেশে একইরকম ।কিন্তু জীবনের থেকে কিছুই বড় নয়, জীবন মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়, মনের গঠন তৈরি করে দেয়, বোধ তৈরি করে দেয়। ছোট্ট শিশু ধীরে ধীরে ভবিষ্যতের পিতায় পরিণত হয়।
কয়েক বছর পরের কথা।অঞ্জনের বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়েও হয়েছে, অরুনিমা ।ওদের এখন সুখের সংসার। সুপ্রতিম- রেবা যে শুধু ,অঞ্জনের বাবা মাই নন, ওর বৌ মৌসুমিকেও ওরা আঁকড়ে ধরেছেন, নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন। আর অরুনিমা তো ওদের চোখের মনি। অঞ্জন-মৌসুমী অফিস বেরিয়ে গেলে ওরাই অরুনিমার সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় সঙ্গী, খেলার সাথী ।
হঠাৎই ঘটল ঘটনাটা।সামান্য কয়েকটা ব্লাড টেস্ট করাতে গিয়ে ব্যাপারটা যে এই দিকে ঘুরে যাবে, কেউ ভাবতেও পারেনি।অঞ্জনের মার ক্যান্সার ধরা পড়ে।সুপ্রতিমবাবু একেবারে ভেঙে পড়লেন। এতদিন বোঝা যেত না, এখন বোঝা গেল, ওনার নিজের শরীরেও ভেতরে ভেতরে অনেক অসুখ বাসা বেঁধেছিল। শুধু স্ত্রী-পুত্র-বৌমা আর নাতনিকে নিয়ে আনন্দে সংসারটা বয়ে যেত বলে কিছু বোঝা যেত না,বোঝার দরকার পড়েনি।শুধু অবিচল বটগাছের মত দাঁড়িয়েছিলেন ।এবার রেবার ক্যান্সার ধরা পড়ায় সংসারটা আবার যেন ছারখার হয়ে গেল। নার্সিংহোমের বিছানায় রেবা যেন মিশে গেছেন,সুপ্রতিমবাবু বাইরে বেঞ্চে সবসময় বসে থাকেন, কেবিনে ঢুকতে চান না। রেবা ডাকলেও না, অঞ্জন ডাকলেও না। সেদিন প্রথম কেমো হবে, অঞ্জন ঘুমন্ত মার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিতে দেখল, মার চোখের কোণে জমে থাকা একটা জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।যেন ওর চুমুটুকুরই অপেক্ষা করছিল। ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল অঞ্জন। মাকে নিয়ে যাচ্ছে ডক্টর-সিস্টাররা ট্রলি করে। অঞ্জনের যেন হঠাৎ কি একটা হল, কোথা থেকে যে ও মনে এত বল পেল কে জানে? কিভাবে যেন ওর বয়সটা অনেক বেড়ে গেল ।ও বুঝলো এবার ওকেই হাল ধরতে হবে, কাউকে না কাউকে তো সংসারে বটবৃক্ষ হতেই হয়।
কেবিনের বাইরে সুপ্রতিম বাবু বসে আছেন ,কিছু কথা বলেন না, এমনি বসে থাকেন।এই কদিনে ওনাকে আরও বৃদ্ধ লাগে। অঞ্জন এসে বাবাকে ধরে তুলল, কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রেখে শরীরে পুত্রের স্নেহস্পর্শে, অস্ফুটে ডেকে উঠল "বাবা,ওঠ,সব ঠিক হয়ে যাবে।" সেই ডাকে কি মায়া ছিল ,কি টান ছিল,কি ভালোবাসা ছিল কেউ জানে না। অঞ্জন আজ পুত্র নয়, যেন বাবা হয়ে উঠেছে। সুপ্রতিমবাবু অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালেন ।অঞ্জন দেখল, বাবা নয় এ যেন তার সন্তান, একে আগলে রাখতে হবে, মাকে আগলে রাখতে হবে ।অঞ্জনের সেই পরম মমতার আলিঙ্গনে সুপ্রতিম বাবুর চোখে ভেসে উঠল, একটা ছবি। একটা বাচ্চা ছেলে খেলতে খেলতে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছে ,প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নার্সিংহোমের বেডে পড়ে রয়েছে, আর কে যেন সমানে বলে চলেছে "চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে,সব ঠিক হয়ে যাবে।“