বট দাদুর গপ্প
বট দাদুর গপ্প
দীনবন্ধুবাবু ব্যাংকের কিছু কাজ সেরে টোটো চড়ে বাড়ি ফিরছেন তখন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের তেজটাও বেড়েছে প্রচন্ড। তার উপর রাস্তার যে কি বাজে হাল কিছু বলার নেই। আগামী বর্ষায় রাস্তার হাল আরোই তথৈবচ হবে বৈকি।
- এই রাস্তাটা যে কবে ঠিক হবে কে জানে! প্রশাসনের কোনো নজর নেই একেবারে!
দীনবন্ধুবাবুর কথার উত্তরে টোটোচালক পান চিবোতে চিবোতে বলল
- না কাকু! শুনছি তো বড় রাস্তা হবে। শিগগিরই কাজ শুরু হবার কথা তো।
- হলেই ভালো।
বুড়োবটতলায় বেশ কিছু লোক ফিতে দিয়ে মাপ নিচ্ছে রাস্তার।
- কাকু, দেখুন কাজ শুরু হয়ে গেছে।
বেশ কিছুটা স্বস্তি পেলেন দিনবন্ধুবাবু। উফফ! রাস্তাটা হলে এই নিত্য হয়রানি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে মাস তিনেকের মধ্যেই নাকি রাস্তাঘাট তৈরি হয়ে যাবে। সত্যি দারুণ ব্যাপার!
এমনিতে সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে ওঠেন দীনবন্ধুবাবু। তার গিন্নি রূপালী দেবী চা নিয়ে আসেন। বুড়োবুড়ি পাশাপাশি বসে গপ্পগুজব করেন। তারপর পুজো-আচ্চা সেরে বাজার, ঠাজার, হেনা কাজ, তেনা কাজ শুরুর পালা।
তবে পরদিন সকালটা একটু অন্যরকমভাবে শুরু হল দীনবন্ধুবাবুর। সকাল সাড়ে ছ'টা বাজে তখন। ফোনটা বাজতে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলেন উনি। এই সকালে কে ফোন করল রে বাবা! এমনিতে সারাদিনে ছেলে ছাড়া কেউ খুব একটা ফোন ঠোন তো করে না। ঘুম জড়ানো গলায় দীনবন্ধুবাবু বললেন
- হ্যালো
- দীনু, আমি সফিউল বলছি রে।
- হ্যাঁ রে সফি বল। এই ভোরবেলা! সব ঠিকঠাক আছে তো রে?
- তুই কোথায় রে? তাড়াতাড়ি আয় বটতলায়।
এখন নয় নয় করে দীনবন্ধুবাবু সত্তর ছুঁইছুঁই। আর সফিউলের সাথে ওনার পরিচয় সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে। কাল যেখানে লোকজন ফিতে নিয়ে মাপ নিচ্ছিল সেই বুড়োবটতলায় কলেজ থেকে ফেরার সময় ওরা আড্ডা জমাত। সেই আড্ডায় ভিড় করত রবীন্দ্রনাথ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলা। শিল্প-সংস্কৃতি থেকে পলিটিক্স, কিছুই বাদ পড়ত না আড্ডায়। আর মজার ব্যাপার হল, এই সত্তর বছর বয়সেও ওনারা বিকেলে আড্ডা মারতে যান ওই একই জায়গায়। দল ভারী হয়ছে শুধু। সফিউল এত সকালে কেন ফোন করল! উফফ! নির্ঘাত সকাল সাড়ে ছ'টাকে সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টার সাথে গুলিয়ে ফেলেছে। সফিকে নিয়ে আর পারা যায় না!
- ভাই সফি, বাইরের দিকে তাকা! এখন সকাল সাড়ে ছ'টা। সকাল সন্ধ্যা গুলিয়ে যাচ্ছে ভাই তোর!
- না রে দীনু, একটা প্রবলেম হয়েছে। রাকেশ আর গৌতমও এখানে চলে এসেছে। তুই তাড়াতাড়ি আয়।
- কি হয়েছে সেটা তো বল।
- এখানে রাস্তা তৈরি হচ্ছে রে।
- সফি, তোর মজা করার অভ্যেসটা গেল না। খবরটা আমি কালই পেয়েছি যে রাস্তা হচ্ছে। আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক হয়রানি মনে হয় কমবে এবার। আর তুই খবরটা এমনভাবে দিচ্ছিস, যেন কোনো সর্বনাশ হয়ে গেছে। পারিসও বটে!
- সর্বনাশই হয়েছে রে। আমাদের বটগাছটাকে কেটে ফেলবে ওরা রাস্তা বানানোর জন্য। তুই তাড়াতাড়ি আয়।
কি! রাস্তা বানানোর জন্য বটগাছটা কেটে দেওয়া হবে! চারশো বছরের পুরোনো বটগাছ। সেই গাছ কেটে দেওয়া হবে! না,না এটা বাড়িতে বসে পায়ের উপর পা তুলে চা খাওয়ার সময় নয়। রূপালী দেবীকে দরজাটা বন্ধ করতে বলে বেরিয়ে গেলেন দীনবন্ধুবাবু।
ইতিমধ্যে জনা পনেরো লোক জড়ো হয়েছেন বুড়োবটতলায়। ওনারা মানবপ্রাচীর তৈরি করে রীতিমত রুখে দাঁড়িয়েছেন বট গাছটার সামনে। আর বুড়ো বটগাছ! চারশো বছরের হাজারও সাক্ষী বয়ে বেড়ানো সেই বট দাদু আজ যেন সাক্ষী গোপাল। যারা গাছ কাটতে এসেছে তাদের অবশ্য বক্তব্য "হামলোগ কেয়া করেঙ্গে বাবু?" সত্যিই তো! ওনারা কি-ই বা করবেন! ওদের যা আদেশ আছে তা তো ওদের পালন করতে হবে। আটটা নাগাদ লোকাল কাউন্সিলর এলেন। "আপনারা কেমন মানুষ দাদা! এই এতদিন রাস্তা চাই, রাস্তা চাই বলছিলেন। এখন যে-ই রাস্তা হতে শুরু করল অমনি গাছ বাঁচাও শুরু হল! কি জ্বালা বলুন তো! নতুন গাছ লাগানো যাবে। কাটতে দিন তো!"। এদিকে দীনবন্ধুবাবুরাও অনড়। চারশো বছরের পুরোনো গাছকে কিছুতেই কাটতে দিতে পারেন না ওনারা। এতদিন যে বটবৃক্ষ প্রজন্মের পর প্রজন্মর সাক্ষী থেকেছে আজ তাকে রক্ষা করতে হাতে হাত মিলিয়ে লড়বেন ওনারা। আপাতত দু দিন স্থগিত থাকল গাছ কাটার কাজ।
ভেবে কুলকিনারা করতে পারছেন না দীনবন্ধুবাবুরা। অত আইনকানুন তো ওনারা বোঝেন না। নিজেদের মধ্যে পলিটিক্স নিয়ে তরজা চললেও তা যে কেবল ওই বটতলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল তা বেশ ভালো করেই জানতেন তারা। একটা ঐতিহ্য, একটা গর্বকে এইভাবে শেষ হতে দেওয়া যায় নাকি! উপায় খুঁজতে হবে এই ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়ে। হাতের মুঠো শক্ত করেন ওনারা।
- আমরা কিন্তু দেখেছি চিপকো মুভমেন্ট বারবার সফল হয়েছে।
- সেটা কি রে সফি?
- আরে একটা নন ভাওলেন্ট ফরেস্ট কনসারভেশন মুভমেন্ট। ইন্ডিয়ার বহু জায়গায় হয়েছে এবং সাকসেসফুল হয়েছে।
- ফেলিওরও তেমনই আছে। লাস্ট ইয়ার মুম্বাই-এ মেট্রো রেল শেড তৈরির জন্য কত গাছ কাটা হল। দু হাজারের বেশি। প্রোটেস্ট করে কিছু তো হলোই না। উল্টে যারা প্রোটেস্ট করলো তাদের জেলে পুরে দিল।
- আঃ! প্রথমেই নেগেটিভ কেন?
- কিন্তু আমরা এগোবো টা কি করে! না আমাদের আছে টাকা, না আছে লোকবল, না আছে শক্তি, না আছে চেনাজানা কেউ। লড়ব টা কি করে?
- প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্য কত লোক কত লড়াই করে। তাদের কাছে গেলে হয় না?
- দ্যাখো রাকেশদা, তুমি এরকম লোক পাবে কোথায়? অর এরকম অর্গানাইজেশন! আমাদের সার্কেলটা তো খুবই ছোটো। তাই না?
- কিছু তো একটা ভাবতেই হবে।
আলোচনার ঝুড়ি ভরে নানা প্রস্তাব আসতে থাকে কিন্ত সিদ্ধান্ত আর হয় কই! তার উপর করোনা পরিস্থিতিতে যে খুব বেশি ঘোরাঘুরি করে লোক জোগাড় করা যাবে তারও উপায় নেই। দীনবন্ধুবাবুদের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ পড়ে। বটগাছটা অনেক কিছু ওনাদের জীবনে। বটগাছটা ওনাদের কাছে জীবন্ত ডায়রির মত। কোনো কিছু স্মৃতি যেন বটগাছটার ঝুরি বেয়েই নেমে আসে ওনাদের কাছে।
বিকেলে আবার জড় হবেন, আপাতত যে যার বাড়ি ফিরলেন। খাওয়াদাওয়া শিকেয় উঠেছে। চিন্তারাও যেন বটগাছটার মত একাধিক শাখাপ্রশাখা বের করেছে। দুপুরবেলা ছেলে ফোন করতে দীনবন্ধুবাবু রূপালী দেবীকে বললেন
- থাক! ওকে আর এ ব্যাপারে কিছু জানাতে হবে না। এমনিতেই বাইরে আছে। বেকার চিন্তা করবে।
- বেশ।
ফোন ধরতেই ছেলে বলল
- মা, বাবাকে বল চিন্তা না করতে।
বেশ অবাক হলেন রূপালী দেবী। কি করে জানল ছেলে। তাও অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায়ই ছেলেকে উত্তর দিলেন
- কেন রে! কিসের চিন্তা? বাবা তো ঠিক আছে।
- মা! আমি সব জানি। সফিউল কাকার ছেলে আমায় ফোন করেছিল। সব বলেছে আমাকে। তারপর রাকেশ আংকেলের ছেলের সাথেও কথা হয়েছে। আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘটনাটার কথা লিখেছি। প্রচুর সাড়া পেয়েছি। অনেক এনভায়রনমেন্ট লাভার বিকেলের মধ্যেই চলে আসছে। একদম চিন্তা করো না মা। গাছটাকে আমরা বাঁচাবোই।
রূপালী দেবী ছুটে দীনবন্ধুবাবুর কাছে গিয়ে খবরটা জানালো। যেন এক ঘুটঘুটে অন্ধকার, ঘিঞ্জি, জানলা-দরজা বন্ধ একটা ঘরে দুম করে বসন্তের বাতাস কোকিলের ডানায় চড়ে ঢুকে পড়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দীনবন্ধুবাবু বললেন
- আশা আছে তবে রূপালী।
বিকেলে বুড়োবটতলায় দীনবন্ধুবাবুরা পৌঁছে বুঝলেন বটগাছটাকে সত্যি শুধু ওনারা নন, আরো প্রচুর লোক ভালোবাসেন।
- আমরা এনভায়রনমেন্ট মিনিস্টারের কাছে একটা আবেদন জানাচ্ছি যাতে রাস্তাটা একটু ঘুরিয়ে করা হয়। একটু সাইন করে দিন না।
বিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন দীনবন্ধুবাবুরা। কিছু একটা ঠিক হবেই। গাছ বাঁচবেই।
- সফি! কি রে কি বুঝজিস?
- আমরা পারবো রে দীনু।
- আয়, কোলাকুলি করি। সকালটা যা টেনশনে কেটেছে!
সূর্যাস্তের লাল আভায় দুই প্রিয় বন্ধুর আলিঙ্গন যেন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে শীঘ্রই বট দাদুর মাথায় উড়বে জয়ধ্বজা।
পরের দুদিনও বট গাছ আগলে রেখে আশা নিরাশার দোলাচলে দিন অতিবাহিত হল দীনবন্ধুবাবুদের। চোখে ঘুম নেই, তাও উৎসাহ উদ্দীপনায় কোনো ভাটা পরে না।
তখন রাত চারটে। ভোরের পাখিগুলো ভোর হবার আভাস পেয়ে কেউ কেউ ডাকতে শুরু করেছে। ফোনটা বেজে উঠল দীনবন্ধুবাবুর। এত রাতে কে ফোন করছে! অন্ধকারে রাত্রেবেলায় ওরা আবার বটগাছটাকে কেটে দ্যায়নি তো! রাতে তো কেউ আর পাহারা দেয় না। বুকটা ধড়াস করে ওঠে ওনার। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখেন ছেলে ফোন করেছে। ছেলে! এত রাতে! ওর আবার কোনো বিপদ হলো না তো? ফোনটা ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় দীনবন্ধুবাবু বললেন
- হ্যালো
- বাবা!! আমরা জিতে গেছি।
ছেলের গলায় উচ্ছাস বাঁধ মানছে না।
- বাবা, এনভায়রনমেন্ট মিনিস্টার টুইট করেছেন রাস্তার প্ল্যান চেঞ্জ হয়েছে চারশো বছরের বট গাছকে বাঁচানোর স্বার্থে।
সত্যিই উচ্ছাস আর বাঁধ মানছে না। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে আজ উৎসবে মাতোয়ারা হবার দিন। সূর্য ওঠার সাথে সাথে মন্দিরে শঙ্খধ্বনি আর মসজিদের আজানের সুরে যেন জয়ধ্বনি প্রতিফলিত হচ্ছে তখন। আর আমাদের বুড়ো বট দাদু ! সে হাজারো প্রজাতির পাখি, পতঙ্গ, কাঠবিড়ালিদের সঙ্গে নিয়ে ভোরের সূর্যের আলো গায়ে মেখে বসে দিব্যি খিলখিলিয়ে হাসছে।