Sangita Duary

Tragedy Classics

3  

Sangita Duary

Tragedy Classics

বৃষ্টিস্নাতা

বৃষ্টিস্নাতা

6 mins
250



গ্যারেজ থেকে রয়্যাল এনফিল্ডটা বের করেও ঢুকিয়ে রাখলো সমুদ্র। সকাল থেকেই ঝিরঝির বৃষ্টি, বাইক বের করে কাজ নেই, যা প্যাচপ্যাচে রাস্তা, অতো সাধের যান, একটু নোংরা হলে বড্ড বুকে লাগে। 

চৌরাস্তা অবধি হেঁটে এসে হাত বাড়িয়ে একটা অটো থামায় সমুদ্র। বৃষ্টিতেও এতো লোক বেরোয়? অবশ্য লোক না বেরোলে, লোকের সমস্যা না থাকলে তাদেরই কপালেই বা লক্ষ্মী সদয় হবে কি করে?

শার্টার ঠেলে দোকানে ঢুকে সৌমেনকে ফোনে ধরে সমুদ্র, "কিরে আজও ডুব দিলি নাকি?"

ওপ্রান্তে সমুদ্রের এককালের বন্ধু কম এখনকার কর্মচারী বেশি সৌমেনের উত্তর, "নারে ভাই, বেরিয়েছিলাম, মোড়ে আসতেই একটা লরি এসে রাস্তার জল এমনভাবে গায়ে ছিটিয়ে দিলো যে বাধ্য হয়ে আবার ঘরে আসতে হলো চেঞ্জ করতে, চেঞ্জ করে বেরুতে যাবো ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, কি করে বেরোই বল তো"!

- "একটা লুঙ্গি গলিয়ে মাথায় ছাতা টাঙিয়ে আর জুতোজোড়া হাতে নিয়ে বেরিয়ে পর, যত্তসব!"

বলেই ফোনটা কাটলো সমুদ্র। এইজন্যই বলে চেনাজানাদের নিয়ে ব্যবসা করতে নেই, এখন দোকানের কাজগুলো নিজেকেই করতে হবে!

রাগে গজগজ করতে করতে সমুদ্র ড্রয়ার খুলে বুকিং খাতাটা বের করে। একেক করে চোখ বোলায় আজ কি কি পেন্ডিং সারতে হবে.... উমমম.... ঘোষপাড়ার বারো নম্বর বাড়ি থেকে কাল ফোন করেছিলো, প্রিন্টারটা সার্ভিসিং করাতে হবে,

আর... আর... ও বাবা জয়ন্ত দার ল্যাপটপটা গন্ডগোল করছে, সমুদ্রকে গত সপ্তাহে জানিয়েছিল, আজ যাবো, কাল যাবো করেও যাওয়া হয়নি, না না জয়ন্ত দা সমুদ্রর দোকানের সেই প্রথম দিনের কাস্টোমার, এভাবে ওঁকে অবজ্ঞা করা উচিত হয়নি। আজই যাবে, যতই বৃষ্টি পড়ুক, মাথায় বাজ পড়লেও এই ডিউটা আজ মেটাতেই হবে, তার আগে ,আর কোথায় কোথায় ডিউ আছে.... 


সমুদ্র ভালো ভাবে দেখে খাতা বন্ধ করে, সৌমেনটাকে এবার তাড়াতে হবে, ব্যাটা জানতো, এতোগুলো কাজ আছে, তা সত্বেও আজ ডুব দিলো!

আপাতত জয়ন্ত দা'র বাড়ি। কিন্তু সে চলে গেলে দোকানে থাকবে কে? বর্ষা বাদল হলেও উইকডে গুলোতে দোকান বন্ধ রাখা মানেই লস। রোজ লোকে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, প্রিন্টার না কিনলেও দু একটা হেডফোন, স্পিকার, পেনড্রাইভ, মেমরিকার্ড এগুলোর বিক্রি তো থাকেই।

স্টেশন চত্ত্বরে সমুদ্ররই একমাত্র হার্ডওয়ার্সের শোরুম ও সার্ভিস সেন্টার। মার্কেটের দিকে বড়সড় বেশ কয়েকটা থাকলেও সমুদ্রর আয় ইনকাম মন্দ হয়না।

মোবাইল টেনে বাবাকে ফোনে ধরে সমুদ্র, "জলখাবার খেয়েছো? এখনই দোকানে আসতে পারবে? আমি বেরুবো, অনেকগুলো সার্ভিসিংয়ের কাজ আছে, সৌমেনটাও আসেনি...!"

ফোন রেখে নিজের ছোট কিট ব্যাগটা গুছিয়ে নেয়। বাইরে বৃষ্টির তেজ ভালোই বাড়ছে। ঝাপটা লেগে দোকানের কাচের দরজাটা ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শার্টারটা অর্ধেক নামিয়ে দিতে গিয়েও থমকে গেল সমুদ্র। লাল ছাতার নীচে কচিকলাপাতা রঙের চুড়িদার পরে ও কে? 

নিশা!

কি করে সম্ভব?

সমুদ্র দৌড়ে ধাওয়া করে লাল ছাতাকে। সামনে এসে ভ্রম ভাঙে। না, নিশা নয়, নিশার মত, অন্য কেউ।

দোকানে ফিরে আসে সমুদ্র। কতবছর হলো যেন? প্রায় সাত বছর, সময়টা আবছা হলেও নিশার ওই পানপাতার মতো মুখের গঠন কি এত সহজ ভোলার?

অজান্তেই সমুদ্রর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো। শব্দ করে টেনে দিলো শাটারের অর্ধেকটা।

ধপাস বসে পড়লো নিজের চেয়ারে। হাঁফাচ্ছে। কয়েকটা দৃশ্য মনে পড়ছে, কয়েকটা ধারাবাহিক স্মৃতি হাতছানি দিচ্ছে;-

এই তো, দোকানের ভিতর ঘরের এইখানেই তো সেই তক্তপোষটা ছিল, ওখানে বসেই তো সেদিন সমুদ্রের জন্মদিন পালন করেছিল নিশা, হার্টশেপের একটা কেক, পঁচিশটা লাল গোলাপ আর একটা সুগন্ধি বাতিদান।

ওইখানে বসেই তো এমনই এক বৃষ্টি মুখর দিনে প্রথম চুম্বন, প্রথম আদর। বাইরে বৃষ্টির উদ্দাম শব্দ আর ঘরের ভিতরে নিশার শীৎকার, আহঃ! নেশা ধরে যেত সমুদ্রর।


কতদিন নিজের ঘরে নিজের বিছানায় মৌমিতার কাছে ঠিক একইরকম আর্তনাদ কামনা করেছে সমুদ্র, পায়নি, নিজের বউএর খুব-পরিচিত দেহের খাঁজে প্রথম থেকেই সেই আগুনটা পায়নি যেটা বিয়ের আগে গুনে গুনে চোদ্দবার নিশার শরীরে পেয়েছিল।

ওই তো, ওইতো কুলুঙ্গীতে রাখা লক্ষ্মী গণেশের মূর্তি, ওখান থেকেই তো সিঁদুর মাখানো ফুল থেকে সিঁদুর পরেছিলো নিশা, বলেছিলো, "আজ থেকে তোমার হলাম!"

সেদিনও তো বর্ষাই ছিল। নিশা তো বর্ষার মতোই এসেছিল সমুদ্রের জীবনে, একপশলা বৃষ্টি মেখে স্নিগ্ধ শান্ত প্রকৃতি।

রবীন্দ্রভারতী থেকে মাস্টার্সের ফর্ম বেরিয়েছে, সমুদ্র নিশাকে নিয়ে গিয়েছিলো। হাইওয়ে ধরে উড়ে চলেছে সমুদ্রর পালসার, নব্বই স্পীডে, আকাশ ছেঁচে বৃষ্টির শাওয়ার স্নান আর পিছনে সমুদ্রর কোমর জড়িয়ে নিশা, মনে হচ্ছিল, রাস্তাটা যদি আরও একটু দীর্ঘ হতো!

ফেরার পথে সেদিন নিউমার্কেটে ঢুকেছিলো ওরা। বুটিক ঘেঁটে একটা এমব্রয়ডারি সবুজ সালোয়ার। সমুদ্র মনে ভেবে নেয়, এটাই দেবে নিশাকে পুজোতে।

বাহারি মোড়ক হাতে গেটের বাইরে এসেই নিশার চিমটি, "কড়কড়ে দুটি হাজার টাকায় একটি না কিনে, চারটে ছিমছাম কুর্তিও হতে পারতো, একদিনের পরিধানের বদলে চারদিনে একেকটা পরে প্যান্ডেলে ঘুরতে পারতাম!"

ঘুরতেই তো চেয়েছিল সমুদ্র, কেবল সেই বছর নয় ,জীবনের বাকি বারো মাস তেরো পার্বণে নিশার সঙ্গে।

কিন্তু হলো কৈ?

সেদিনটা আজও মনে পড়ে সমুদ্রর। ভোররাত পর্যন্ত ফোনালাপের পর অবশ দেহ আর ক্লান্ত মস্তিষ্ক যখন ঘুমের দেশে গেল, সমুদ্র স্পষ্ট দেখলো নিশাকে, একটা হলুদ ঢাকাই শাড়ি পরে মিষ্টি হাসছে। 

ভারী চোখদুটো খুলেই চমকে উঠলো সমুদ্র, সত্যিই নিশা তার কাছে বসে, এতো সকালে?

নিশা হৈহৈ করে উঠলো, "কটা বাজলো খেয়াল আছে? ওঠো তুমি, আমি সেই কখন থেকে...!"

সমুদ্র উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজলো, স্বপ্ন দেখছে নিশ্চই।

ওমনি মায়ের গলা, "বাবু ওঠ, দোকানে যাবিনা?"

ধরফড়িয়ে উঠে বসে সমুদ্র, সত্যিই স্বপ্ন ছিল, নিশা আসেনি? স্বপ্নও এতো জ্যান্ত হয়?

ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে এসে আবার চমক, চায়ের কাপ হাতে নিশা, পিছনে মা, "কেমন চমকে দিলাম? কাল তোর বাবা তোর ফোন ঘেঁটে ওর নম্বরটা নিয়েছিল, কি ভেবেছিল তুই লুকিয়ে লুকিয়ে জল খাবি, আর তোর বাবা টের পাবেনা? আয় তো মা, মাংসটা চেখে দেখ তো, নুন ঠিক হয়েছে কিনা?"


আশ্চর্য! নিশাও সুরসুর করে মায়ের পিছন পিছন রান্নাঘরে। সমুদ্র লুকিয়ে দেখলো, মা কাছে বসিয়ে নিজের হাতে নিশাকে কষা মাংস খাওয়াচ্ছে।

কি যে সুখী ছিল সেদিন সমুদ্র!

সেদিনই এমনটাই বর্ষা ছিল।

নিশা আর বৃষ্টি যেন সমার্থক।

রূমঝুম বৃষ্টির নিক্কন আর নিশার গায়ের মিষ্টি গন্ধ সমুদ্রর জীবন তখন কানায় কানায় পূর্ণ।

দুইবাড়ির মত নিয়ে তাদের বিয়ের ডেটটাও ফাইনাল হয়ে গিয়েছিল, দোলের ঠিক দুদিন আগে।

নিশা আফসোস করে ঠোঁট ফোলায়, "সামনের বছর তাহলে রং খেলা বন্ধ, তাইতো?"

সমুদ্র নিশার নাক মূলে দেয়, বলে," উঁহু, ওইদিনই তো আমাদের ফুলশয্যা, তোমায় আমার রঙ্গে রাঙাবো, নতুনকরে, সুন্দর করে!"

লজ্জায় নিশা রাঙা হয়ে যায়।

দুইবাড়ির আয়োজন তখন তুঙ্গে, নেমন্তন্নের লিস্ট, কেনাকাটা, ক্যাটারার বুকিং, পার্লারে এডভান্স, গয়না গড়ানো, বড়রা যে যার কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ এক বিকেলে গঙ্গার ধারে নিশার তলব। হাজির হতেই অভিযোগ, "এখনও বিয়েই হলোনা, আর তুমি বেমালুম আমার জন্মদিনটাই ভুলে গেলে?"

মনে মনে জিভ কাটে সমুদ্র, সত্যিই তো মাথাতেই ছিলোনা একদম! কিন্তু সিচুয়েশনটা তো আন্ডার কন্ট্রোলে আনতে হবে, স্মার্টলি উত্তর দেয়, "ভুলে যাওয়ার ভান করেও মনে রাখার মত করে সেলিব্রেট করাটাই সমুদ্র বসুর স্টাইল!"

"তাই?" নিশা নিজের কোমরে হাত রাখে, "তা কেমন সেলিব্রেশন শুনি?"

- "এই যেমন, আজ, তোমার মন যা যা চায়বে, সব পূরণ করার দায়িত্ব আমার!"

নিশা আরও কাছে আসে সমুদ্রর, "বেশি কিছু না, বছরের কয়েকটা বিশেষ দিন শুধু মনে রেখো, আর কিছু চাইনা!"

-" ব্যাস, এইটুকুই? বেশ কথা দিলাম, ভুলবোনা, আমি মরে গেলেও ভুত হয়ে তোমায় কেক খাইয়ে যাবো!"

নিশা হাতের তালুতে সমুদ্রের ঠোঁট চেপে ধরে, "খবরদার! তোমার আগে যেন আমি...."

সমুদ্রও থামিয়ে দেয় নিশাকে, "আমরা দুজনেই বাঁচবো, একসাথে!"

সেদিন অনেক্ষন দুজন গঙ্গার ধারে বসেছিল। 

রাত বাড়লে রাস্তায় লোকজন কমে যায়, তাই সমুদ্র হেলমেট পরলেও নিশা ওটা হাতেই নিয়েছিল। শ্লথ গতিতে চালাচ্ছিল সমুদ্র, নিশার ক্লান্ত মাথা পরম নির্ভরতায় সমুদ্রের পিঠের ওপর।


পাঁচমাথার মোড়ে হঠাৎ একটা লরি, সমুদ্র কিছু বোঝার আগেই.....

যখন জ্ঞান ফিরলো, সমুদ্র হাসপাতালে, বাঁ পাটা ভেঙে প্লাস্টারে মোড়া। কিন্তু নিশা....

সমুদ্র চিৎকার করে উঠেছিল, "নিশার মাথায় যে হেলমেট ছিলোনা...!"

**************

 বৃষ্টিটা কমলো বোধহয়। সমুদ্র চোখের কোণটা মুছে নিলো। খুব কষ্টে দিনগুলো কাটিয়েছে তখন, সবজায়গায় নিশার স্মৃতি, সমুদ্রর ঘরে, দোকানে, ওই তক্তপোষে, মায়ের রান্নাঘরে....উঃ! জ্ঞান ফেরার পর থেকেই প্রায় অর্ধপাগল, নিশা তার জীবনে নেই, ফিরবেও না কোনদিন, এটা মেনে নেওয়া যে কি যন্ত্রণার!

কিন্তু সময় সব ভুলিয়ে দেয়। একজন মা সন্তান হারানোর শোকও ভুলে যায় সময়ে আর এ তো ভালোবাসার নামে বেইমানি, একসাথে বেঁচে থাকার কথা দিয়েও কথা না রাখার প্রতারণা।

একেক করে প্রত্যেকটা জায়গার ভোল পাল্টিয়ে দিয়েছে সমুদ্র, তক্তপোষটা জলের দরে বেচে দিয়েছে। 

গত বছর জোর করে বাড়ি থেকে বিয়েটাও দিয়ে ফেললো সমুদ্রর, মৌমিতার সঙ্গে।

**************

কি মনে করে একবার ক্যালেন্ডারটার দিকে চোখ বোলায় সমুদ্র, যা ভেবেছে তাই, আজই তো সাতাশে আগস্ট, নিশার জন্মদিন! গতবছর পর্যন্তও ওই দিনে প্রত্যেক বছর নিশার নাম করে মন্দিরে গিয়ে প্রণাম করে এসেছে সমুদ্র, আর এ বছর সে ভুলে গেল? নিশাকে দেওয়া কথা রাখলনা?

তাই বোধহয় নিশা মনে করিয়ে দিয়ে গেল হঠাৎ দেখা দিয়ে!

কুলুঙ্গীতে রাখা ঠাকুরের পা থেকে নিশার ছবিটা অনেকদিন পর হাতে নিলো সমুদ্র, "ক্ষমা করো নিশা, আমি সত্যিই তোমার যোগ্য ছিলামনা, তাই কথা দিয়েও কথার খেলাপ করে ফেললাম, আর তুমি? মৃত্যুও তোমার কাছে হেরে গেল। সারাজীবন আমার পাশে থাকবে বলেছিলে, জানি আজও তুমি আছো আমার চারপাশে, বৃষ্টি হয়ে, রোদ্দুর হয়ে, সন্ধ্যে হয়ে, সকাল হয়ে। তোমার ভালোবাসার কাছে হেরে গেলাম আমি, ভালো থেকো। যদি ভুলেও যাই কখনও, আবার একপশলা বৃষ্টি হয়ে মনে করিয়ে দিও, তবু কক্ষনো ছেড়ে যেওনা আমায়, শুধু অপেক্ষা করো, তোমার কাছে আমার ফিরে যাওয়ার।"


কোথাও একটা বাজ পড়লো হঠাৎ, শুরু হলো বৃষ্টি আবার, মুষলধারে।

                                      


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy