শিপ্রা চক্রবর্তী

Classics Inspirational

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Classics Inspirational

বোধন.....

বোধন.....

4 mins
228



ঢাকে কাঠি পড়ে গেছে। মায়ের আগমনের সুর দিকে দিকে বইছে। আজ মহালয়া সকাল থেকেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের গলায় সেই চেনা পরিচিত সুরে বেজে চলেছে মহিষাসুরমর্দ্দিনী। অন‍্য বছর হলে এখন কুমোরটুলির বাসিন্দাদের চরম ব‍্যস্ততা থাকে, কিন্তু এই বছর সেই রকম কিছুই নেই!!! চারিদিকে মহামারীর করালগ্রাস। রতন পাল দূর্গা ঠাকুরের সাজ সজ্জার, পাশাপাশি মূর্তিও গড়ে। প্রত‍্যেক বছর কিছু না... কিছু, বায়না পায় রতন, মোটামুটি নামডাক হয়েছে ওর। কিন্তু এবছর একটাও ঠাকুরের বায়না পায়নি রতন, কোনক্রমে টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছে। রতন মাটির দাওয়ায় গালে হাত দিয়ে বসে দূর আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশের গায়ে খুশির রঙ লেগেছে। প্রত‍্যেক বছরের মত নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে। দাওয়ার নীচে রতনের ছোট্ট পাঁচ বছরের মেয়ে বিন্নি কাঁদামাটি নিয়ে আপন মনে কিছু গড়ছে আর গাইছে........


"আয়... রে ছুটে আয়... পুজোর

গন্ধ.....এসেছে।

ঢ্যাম্ কুড়কুড়..., ঢ্যাম্ কুড়াকুড়

বাদ্যি.... বেজেছে।

গাছে শিউলি.... ফুটেছে

কালো.... ভোমরা জুটেছে।

আজ.... পাল্লা দিয়ে... আকাশে

মেঘেরা... ছুটেছে।"


রতন মেয়ের দিকে নিস্পলক তাকিয়ে ভাবছে, বছরকার দিন সবাই নতুন জামা পড়বে আর আমার মেয়েটাকে আমি একটা জামাও কিনে দিতে পাড়বনা!!! হায়রে কপাল আমার । রতনের চোখের কোনটা জলে চিকচিক করে উঠল।

---------রতনের বউ রান্নাঘর থেকে বলে উঠল, চাল বারন্ত আজই আনতে হবে কিন্তু!

----------রতন খুব ধীরে বলে উঠল, হুম...।

---------বিন্নি হাতে মাটির একটা তাল নিয়ে দৌড়ে বাবার কাছে এসে বলল, একটা শিব ঠাকুর গড়ে দাওতো....!! তখন থেকে চেষ্টা করছি হচ্ছেই না......!

------------রতন মেয়েকে কোলের ওপর বসিয়ে বলল, শিব ঠাকুর দিয়ে তুই কি করবি বিন্নি মা...?

----------বিন্নি দুইদিকে দুই... বেনি দুলিয়ে বলল, পূজো করবো! ঠানদিদা বলেছে শিব ঠাকুরের কাছে মন থেকে যা... চাওয়া হয় তাই মেলে।

-----------রতন হাসি হাসি মুখে বলল, তা তুই কি.... চাইবি শিব ঠাকুরের কাছে?

--------বিন্নি বলল, চাইব তোমার কাছে একটা ইয়া.... বড় দূর্গা ঠাকুর বানানোর সুযোগ যেন আসে। তাহলে আমাদের আর কষ্ট থাকবেনা।

--------রতন মেয়েকে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে বলে উঠল, তুই কবে এত বড় হয়ে গেলি বিন্নি...!

--------বিন্নি তার ছোট ছোট হাত দিয়ে বাবার চোখের জল মুছিয়ে বলল, দাওনা শিব ঠাকুর গড়ে।

রতন কাদার তালটা হাতে নিয়ে একটা শিব ঠাকুর গড়তে শুরু করল, ঠিক তখনই একটা মস্ত বড় গাড়ি এসে দাঁড়াল ওদের বাড়ির সামনে। রতন অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে একটা বছর তিরিশের যুবক গাড়ি থেকে নামছে।

---------ছেলেটি নেমে বলে উঠল, আচ্ছা এখানে রতন পাল কে.... বলতে পারবেন?

---------রতন হাতজোড় করে বলে উঠল বাবু আমিই রতন পাল...!

--------ছেলেটি বলে তুমি ঠাকুর তৈরী..... করোতো??

---------রতন বলল হ‍্যাঁ...... বাবু করি...!!!

------------ছেলেটি বলল, আমি ষষ্টির দিন সকালে এসে ঠাকুর নিয়ে যাব, ছোট একচালার একটা দূর্গা বানিয়ে দেবেন। আমার ঠাম্মি স্বপ্ন দেখেছে দূর্গা পূজোর, তাই পূজোতো করতে হবেই!! তা... আপনি পাড়বেনতো এই কদিনের মধ‍্যে করতে।

----------মুহুর্তের মধ‍্যে রতনের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল আনন্দে, রতন বলল, হ‍্যাঁ....পাড়বো।

---------ছেলেটি রতনের হাতে টাকা দিয়ে বলল এটা এখন রাখুন, বাকি ঠাকুর নিয়ে যাওয়ার সময় দেব।

****************************************

শুরু হলো জোর কদমে কাজ, কাঠামো তৈরী, মাটি লেপা, ছাঁচে মুখ, হাত, পা... তৈরী, রঙ করা পোশাক সাজ... সজ্জা তৈরী, কটাদিন যেন ঝড়ের বেগে কেটে গেল রতনের। আজ ষষ্ঠি মায়ের বোধন, ভোর ভোর সেই গাড়ি আবার আসল রতনের বাড়ির সামনে রতন হাসিমুখে ঠাকুর তুলে দিল হাতে। ছেলেটিও কথা মত বাকি টাকা তুলে দিল রতনের হাতে।

-----------রতন বিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোর কথা শুনেছেরে মা... শিবঠাকুর, তাইতো ঐ.... দাদাবাবুকে পাঠিয়েছিল আমাদের ঘরে। উনিই হলেন জ‍্যান্ত শিব ঠাকুর।

--------বিন্নি মাথার দুইদিকে দুটি বেনি দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল।

----------রতন মেয়েকে কোলে নিয়ে বলল, চল বউ পূজোর বাজারটা করে আসি।

রতন বউ মেয়েকে নিয়ে গেল বাজারে, বউএর জন‍্য কলমকারি প্রিন্টের সুতির শাড়ি, মেয়ের জন‍্য জামা, আর নিজের জন‍্য একটা ফতুয়া কিনল। বাজার করে বাড়ি ফেরার পথে দেখে সেই মস্ত গাড়িটি ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে।

-----------রতনের বুক ধড়াস করে উঠল, এই ভেবে ঠাকুর কি... পছন্দ হয় নি... তাহলে, ফেরত দিতে আসল নাকি, রতন পা.... চালিয়ে তাড়াতাড়ি গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। এবং হাতজোড় করে বলে উঠল, কি... হয়েছে বাবু! ঠাকুর পছন্দ...হয়নি.....!!!

---------ছেলেটি হাসতে হাসতে বলল, হ‍্যাঁ.... খুব পছন্দ হয়েছে, আমি এসেছি তোমাদের নিমন্ত্রন করতে। তোমরা সবাই মিলে যাবে আমাদের বাড়ি ঠাকুর দেখতে ঠিক আছে।

--------বিন্নি ছেলেটির হাত ধরে টানতে টানতে বলল, আচ্ছা তুমি কি..... শিব ঠাকুর???

---------ছেলেটি বিন্নিকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আমি শিব ঠাকুর কেন... হব...???

------------বিন্নি বলল, তাহলে বাবা যে.... বলল, তুমি জ‍্যান্ত শিব ঠাকুর হয়ে এসেছ আমাদের ঘরে।

---------রতন বলল বাবু আপনি সঠিক সময়ে আমাদের জীবনে এসেছেন, একেবারে ভগবানের মত।

--------ছেলেটি গাড়িতে উঠতে উঠতে বলল, তোমরা সবাই যাবে হ‍্যাঁ.... পূজোতে!!!

---------রতন হাসি হাসি মুখে বলল, আচ্ছা বাবু যাবো।

বিন্নি ছোট হাতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে টাটা দিতে লাগল, আর গাড়িটি আসতে আসতে মিলিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics