বংশধর
বংশধর
"চিতার আগুনে আমাকে পোড়াতে পারবে, সাদা ছাই গুলো বাতাসে ওড়াতে পারবে... আমার গানকে পোড়াতে পারবেনা...... "
সন্ধ্যায় নিউজ চ্যানেল গুলোতে মুম্বাইয়ের শিবাজী পার্কে সুরসম্রাঙ্গী, ভারতরত্ন লতা মঙ্গেশকর মহাশয়ার শেষকৃত্য মোবাইলে লাইভ সম্প্রচার দেখছিল সৌগত।সিনেমা এবং খেলার জগতের অনেকেই শ্রদ্ধা ও সন্মান জানাতে এসেছেন।
নাস্তিক সৌগতর ভগবান আজ সকাল আটটা বারো মিনিটে তার সব সাফল্য-
ব্যার্থতা-কষ্ট নিয়ে সঙ্গীতের সুরলোক থেকে দেবলোকে পাড়ি দিয়েছেন।আজ মন ভালো নেই ওর। কেমন বিমর্ষ, চুপচাপ বসে নিউজ চ্যানেল গুলো পাল্টে পাল্টে দেখছে। মা এসে পাশে বসলেন।পরপর দু ফোঁটা অশ্রু পড়ল মোবাইল স্কিনে। মা বুঝলেন ছেলের কান্নার কারন।
মায়েরও আজ মন ভালো নেই । সকাল থেকেই চোখ দুটোতে ভরা জোয়ার, বাঁধভাঙা নোনা জল কূল ছাপিয়ে যাচ্ছে বারবার। প্রকৃতির নিয়মে 6 ঘণ্টা 13 মিনিটেও ভাটা আসেনি আপনজন হারানোর দুঃখে ।
লতা দিদি কেন বিয়ে করেননি হেডলাইন টা দেখে হাতটা থেমে গেল। সৌগত ভাবতে থাকে একটা মানুষ এই সামান্যক্ষণ হল মৃত্যু হয়েছে, তারমধ্যেই এমন নোংরামি শুরু করে দিল নিউজ চ্যানেল গুলো। আরেকটি নিউজ চ্যানেল তো আরেক ধাপ এগিয়ে নোংরামির শেষ সীমা পার করে ফেলেছে। তাদের হেডলাইন লতা মঙ্গেশকর কত টাকা ও সম্পত্তি রেখে গেলেন এবং সেই সব টাকা বা সম্পত্তি কে পাবে। মনে মনে ধিক্কার দেয় সৌগত। সত্যিই টি. আর. পি-র জন্য আর কত নিচে নামবে এরা।
লতাদির জীবনের জানা-
অজানা অনেক পুরনো কথা নিউজ চ্যানেলে দেখাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই দাহকার্য্য শেষ হয়েছে। হঠাৎ মোবাইল টা বেজে উঠল। বেনুদির ফোন।
-"ভালো আছিস?.."
-"হু..."- ছোট্ট করে জবাব দিল সৌগত।
-"লতা দিদি আর নেই...."
-"হু...."শেষ করতে না দিয়েই বলল সৌগত।
-"সত্যি একটা অধ্যায় শেষ...."
-"অধ্যায় নয়, বরং মহাগ্রন্থ শেষ বলো......."
দীর্ঘ নিশ্বাস শেষে ফোনের দুদিক কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ।
তারপর বেনুদি নিরবতা ভেঙে জিজ্ঞাসা করল-"কাকিমা কোথায়??"
-" মা এই আমার পাশে বসে আছে, মন ভীষণ খারাপ।"
-"হ্যাঁ রে.... সবারই মন খারাপ...."
ফোনটা কেটে গেল না কেটে দিল সৌগত বা বেনুদি কেউ বুঝতে পারল না। সৌগতর ফোন করতে ইচ্ছা করল না। ফোন আসতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ভিডিও টি মোবাইল স্ক্রিনে হাত দিতে পুনরায় চালু করতে গেল। ফোনটা আবার বেজে উঠল।
বেনুদি বলল,- "ফোনটা কি কেটে গেল??"
সৌগত অনিচ্ছুক ভাবে বলল, -"মনে হয় কল ড্রপের জন্য......"
-"হ্যাঁ,আজকাল কল ড্রপের পরিমাণ খুব বেড়ে গেছে....
কাকিমা কাছে আছে??"
-" হ্যাঁ এই নাও মায়ের সাথে কথা বলো... "
-"হ্যালো...হ্যাঁ বেনু!কেমন আছিস মা ?"
-"ভালো, তুমি কেমন আছো কাকিমা...... "
- "ভালো... তবে আজকে লতাদির জন্য মন ভীষণ খারাপ"
-"হ্যাঁগো সত্যিই আজ মন খুব খারাপ, আজ কেউ ভালো নেই, যার গান শুনে বড়ো হয়েছি....
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ তারপর বেনুদি বলল, -
- " আচ্ছা,তোমার মনে আছে কাকিমা ছোটবেলায় সৌগত চুপিচুপি ফুল তুলে নিয়ে যেত... তারপর একদিন আমার মা আবিস্কার করল আলমারির তাকে লতা দিদি আর মান্না বাবুর ছবি।খবর কাগজ থেকে কেটে কেটে সৌগত ছবি দুটো সংগ্রহ করেছিল।রোজ পুজো করত... তখন কি বা এমন বয়স ছিল ওর... "
-" হ্যাঁ... গানবাজনা বড়ো ভালো বাসত ছেলেটা...। হটাৎ কি খেয়াল হল গান শেখা ছেড়ে দিল... "
-" এখন কি শুধু অফিস নিয়ে ব্যস্ত? "
-" হ্যাঁ, অফিস থেকে বাড়ি আর বাড়ি থেকে অফিস।"
"ঠিক আছে মা, ভালো থাকিস। আবার পরে ফোন করব ।"
মনখারাপের নিকষ কালো ছায়া আবারও অভেদ্য গাঢ় অন্ধকার হয়ে ঘিরে ধরল।মা বললেন,-"নয়া ন'দিন/ পুরানা শ'দিন -"
মোবাইলে ভিডিওটি পজ্ করে জিজ্ঞাসা করল-
-" মানে?... "
-"এটা একটা পুরোনো হিন্দি প্রবাদ,এই যে পুরনো দিনের গানগুলো প্রতিটি মানুষের মনের গভীরে অবস্থিত, এগুলো কখনও পুরোনো হওয়ার নয়.....
-"হ্যাঁ... দিজ সঙস্ উইল বি ক্যারিড ফ্রম জেনারেশন টু জেনারেশন. "
-" হ্যাঁ এই গানগুলোই ওনার সন্তান...."
-"হ্যাঁ,....হাজার লক্ষ বছর বয়ে চলা বংশধর-ও যা ওনার পরিচয় বহন করবে আর যা থেকে নতুন নতুন গানের জন্ম হবে.... "
মা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
