বন্ধন
বন্ধন
প্রেসিডেন্সি জেনারেল হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে সামনের ফুটপাথ লাগোয়া বাসস্টপে অপেক্ষা করছিল রুবী। চারদিকে এপ্রিল মাসের দুপুর বারোটার রোদ। কিন্তু তাতে গা পোড়ানো তাপ নেই। মোবাইলে ট্রান্সপোর্টেশন অ্যাপসে দেখাচ্ছে এস সেভেন বাসটা আসতে এখনও কুড়ি মিনিট দেরী । কি আর করা! চারদিকে উঁকিঝুঁকি দিয়ে সবার অবস্থান দেখে নিচ্ছে রুবী । যাত্রী ছাউনির নিচে বেশির ভাগ অপেক্ষমাণ যাত্রীই বয়স্ক, ডাক্তার দেখিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হওয়া।
সামনে রেশমি চুলের দুই চায়নিজ বাচ্চা ছোটাছুটি খেলছে। তাদের মা মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত। রুবী নিজেও চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা, আজকে সে জেনেছে তার মেয়ে হবে। সেই থেকেই তার মেজাজ ফুরফুরে, ক্ষণে ক্ষণে হাত বুলাচ্ছে পেটের ওপর, যেন মেয়েকে আদর করছে। রুবীর চঞ্চল চোখ চলে গেছে আরও দূরে, একটা ফাস্ট ফুডের কাবাব স্ট্যান্ডের দিকে। মাংস পোড়া চনমনে গন্ধ ছাপিয়ে যে জিনিসটা রুবীকে কৌতূহলী করেছে, তা হলো স্ট্যান্ডের সামনে দাঁড়ানো দুজন নারী। একজন ষাটোর্ধ্ব, পরনে সালোয়ার কামিজ, কালো সোয়েটার, মাথায় সুতির ওড়না টেনে দেওয়া। আরেকজনের বয়স কম, জিনসের ওপরে টি-শার্ট আর পাতলা হুডি পরা, চোখে বড় রোদ চশমা। দুজনের হাতেই কাবাবের কাঠি, মাঝে মাঝে কাঠি থেকে কাবাবের টুকরো খুলে একে অন্যকে খাইয়ে দিচ্ছে। কী হতে পারে দুজনের সম্পর্ক? মা-মেয়ে, পিসি-বোনঝি? আর যাই হোক বউ-শাশুড়ি হবে না। রুবীর সন্দিহান মন অগোচরে হাঁটতে থাকে।
—মা, তাড়াতাড়ি খেয়ে নেন, একটু পরেই তো আপনার ছেলে ফোন করে খোঁজ করবে। এ ছাড়া রক্ত দিয়েছেন না আজকে।
—এইতো বউমা, তুমি কাবাবের কথা বলতে যেও না, রাস্তার ধারের খাবার খেয়েছি শুনলে বকবে।
যারপরনাই অবাক হয়ে বিস্ফোরিত নয়নে কথাগুলো শুনল রুবী। এসব শুধু সাহিত্যে মানায়, কারও জীবনে অসম্ভব। শাশুড়ির ব্যবহার তাকে মায়ের অনুভূতির কাছাকাছিও যেতে দেয়নি কোনো দিন। আজ মনে পড়ল আমেরিকার ভিসা পেয়েই রুবী কদমতলায় ভাশুরের বাড়িতে গিয়েছিল। অসুস্থ শাশুড়িকে নমস্কার করতেই উনি মুখ ঘুরিয়ে বলেছিলেন, ‘এইবার আমার ছেলের ইনকামের টাকাগুলো তোমাকে পালতে পুষতেই শেষ হবে, গড়িয়ার বাড়িটা আর তোলা হবে না।’ জল ভরা চোখে সামনে তাকাতেই অস্পষ্ট বাসটা নজরে এল রুবীর। সত্যিই কি অদ্ভুত দুনিয়া, মেয়েরাই মেয়েদের বড় প্রতিদ্বন্দী।