ব্ল্যাক বিউটি
ব্ল্যাক বিউটি
"ওই তো রূপের ছিরি ,এতো সাজবার কি আছে তোর।তার থেকে বরং বোনকে সাজতে দে ভালোভাবে। ও সাজলে বিয়ে বাড়িতে পাঁচটা লোকে ওকে তাকিয়ে দেখবে। ড্রেসিং টেবিল টা আর জুড়ে থাকিস না, সরে যা জলি।" মায়ের এ হেন মন্তব্যে জলির বুকের ভেতরটা অন্য সব দিনের মতোই মোচড় দিয়ে উঠলো এক অব্যক্ত বেদনায়। মাথা নীচু করে সরে গেল সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে।সবে তো শাড়িটা পরে , চুলটা একটু বাঁধছিলো , মুখেও কিছু লাগায়নি ও। মায়ের মুখঝামটা শুনে ভয়ে জড়সড়ো হয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেল পাশের ঘরে। ওখানে আলমারিতে লাগানো আয়নাতে দেখেই চুলটা খোঁপা করে নিল ও। এমনিতেও তার গায়ের রং ফর্সা না বলে মা তাকে কিছু কিনেও দেয় না। যতো মেকআপ, লিপস্টিক সব বোন রিংকির জন্য। জলির মনে আছে, একবার ও বোনের মেকআপ বক্স থেকে নিজের মুখে একটু মেকআপ করতে গিয়েছিল।তাই দেখে বোনের সে কি হাসি। পাশের ঘর থেকে মাকে ডেকে দেখাচ্ছে আর হেসে গড়িয়ে পড়ছে মায়ের গায়ে।যেন সে মেকআপ করেছে না জোকার সেজেছে ।মা তো বলেই ফেলল ,জলি দাঁড়কাক হয়ে ময়ূর সাজতে যাস না। যা মুখটা ধুয়ে আয় ভালোভাবে।আর রিংকির তো বিদ্রূপের হাসি আর বন্ধ ই হচ্ছিল না। খুব অপমানিত বোধ করেছিল সেদিন জলি। তারপর থেকে আর কখনও বোনের মেকআপের কোনো জিনিসে হাত দেয়নি ও। কোথাও গেলে একটু হালকা কাজল আর হালকা লিপস্টিক।এর বেশি সে কিছু ই করে না। কখনও খুব ইচ্ছা হলে একটা ছোট টিপ। মা,বোনের ওকে নিয়ে এইরকম হাসি ঠাট্টা, বিদ্রূপের সময়, বাবা সবসময় জলির পাশে এসে দাঁড়াতো।বলতো,"কালো তো কি হয়েছে, ওর একঢাল লম্বা চুল আর সুন্দর দুটো মায়াবী চোখ দেখলে যে কেউ ওকে ভালোবেসে ফেলবে।আর গুণ ? সর্ব গুণ সম্পন্ন আমার জলি। শুধু রূপ দিয়ে কিছু হয়না বুঝলে সাবিত্রী। গুণের কদর সর্বত্র।"
বাবার এই কথায় মা আর বোন যেন আরও মজা পেয়ে যেত।বলতো," হ্যাঁ সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রেখে তোমার মেয়ের গুণকীর্তন করো। এই রূপে বিয়ে থা তো কেউ করবে না।"
এসব কথা শুনে জলির বুকটা কষ্টে ফেটে যেত। কেন সে এরকম কালো গায়ের রং নিয়ে জন্মালো।কেন ও মা আর বোনের মতো ফর্সা টকটকে হলো না। ওর এই রঙের জন্য মা নাকি জন্মের পর ওর দিকে ফিরেও তাকায় নি। ঠাকুমা যতদিন ছিল জলিকে আগলে রাখতো। মা কিছু বললে বলতো," বৌমা জলি আমার শ্যামা মা।কি সুন্দর একঢাল লম্বা চুল আর চোখ দুটো কি সুন্দর। শুধু গায়ের রং দিয়ে বিচার করো না আমার নাতনিকে। দেখবে ওর গুণের ছটায় ও একদিন চতুর্দিক আলোকিত করবে।" মা তাও ফিরে দেখতো না ওকে। আর তারপর তো বোনের জন্মের পর ,অত সুন্দর ফর্সা, গোলগাল,ডল পুতুলের মতো দেখতে মেয়েকে পেয়ে মা আর ওর দিকে ফিরেও দেখতো না। সারাদিন ওর বোনকে সাজাতো, যত্ন করতো। আর কত রকমের জামা কিনে দিত বোনকে তার তো হিসাব নেই। কই মা কখনো জলি কে তো এতো সুন্দর করে সাজায় নি। ওকে তো ছোটবেলায় ওর ঠাকুমা জামা পরিয়ে দিত, চুল বেঁধে দিতো। কখনও মায়ের কাছে দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলে ,মা কেন জানেনা ওকে সরিয়ে বোনকে কোলে তুলে নিত। আচ্ছা গায়ের রং ফর্সা না হলে মায়ের ভালোবাসা ও পাওয়া যায় না বুঝি। জলির মনে সারাদিন এই ভাবনা কুরে কুরে খেত। এইভাবেই কবে যেন বড়ো হয়ে গেল দুই বোনে।
মায়ের আদরে বেড়ে ওঠা রিংকি দেখতে অপরূপ সুন্দরী।আর বড়ো মেয়ে জলি চিকন কালো গায়ের রং, একঢাল লম্বা কুচকুচে কালো চুল, আর দীঘল কালো দুটি চোখে অতলান্ত গভীরতা। যেন কত কিছু বলতে চায় সেই চোখ দুটো। রিংকি সারাদিন পোশাক, মেকআপ এইসব নিয়েই ব্যস্ত।আর ব্যস্ত ফটো তুলতে।আর জলি ব্যস্ত তার পড়াশোনা নিয়ে।আর ব্যস্ত তার ছবি আঁকা নিয়ে। অসাধারণ হাত তার ছবি আঁকার। তার তুলির ছোঁয়ায় ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা ছবি যেন জীবন্ত হয়ে যেত। নিজের না বলতে পারা দুঃখ কষ্ট সে ফুটিয়ে তুলতো ক্যানভাসে। এইভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। সেদিন মামাতো দাদার বিয়েতে যাবার আগে মাকে শুধু জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল জলি কি রঙের শাড়ি টা পড়বে ও। মা তো তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, "যেন ডিপ কোনো শাড়ি পড়তে যাস না, সবাই হাসাহাসি করবে।" কালো মেয়ে ডিপ রঙের শাড়ি পরতে পারবে না, এটা কোথায় লেখা আছে , সেটা জলির জানা নেই। যাইহোক শেষমেশ একটা হালকা রঙের শাড়ি ই পরেছিল জলি মায়ের কথামতো। আর বোন তো টকটকে ফর্সা রঙে ডিপ নীল রঙের শাড়ি পরে ঝলমল করছিল। কি সুন্দর যে লাগছিলো ওকে। ওর পাশে জলি সত্যিই বেমানান লাগছিলো। খুব কষ্ট হচ্ছিল জলির। ভগবান ওকেও তো একটু ফর্সা করে পাঠাতে পারতো।
বিয়ে বাড়ীতে সবাই বোনের রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মায়ের মুখ ও গর্বে উজ্বল হয়ে উঠছিল। মা তো কাউকে এটাও বলছিল না যে, তার আর একটা মেয়ে আছে।হোক না সে কালো, কিন্তু তার অনেক গুণ। জলি আনমনে হলের এক কোনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলো। হঠাৎই পিছন থেকে কেউ যেন ওর পিঠে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,"তুমি সাবিত্রী র মেয়ে তো?" জলি পিছনে ফিরে দেখলো ,ওর মায়ের বয়সী একজন সুসজ্জিতা ভদ্রমহিলা। ও ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললো। ভদ্রমহিলা আবারও বললেন,"একা এক কোনে দাঁড়িয়ে আছো কেন? সবাই কতো আনন্দ করছে , তুমি ও আনন্দ করো।" জলি কিছু না বলে চুপ করে রইলো। ভদ্রমহিলা ওর হাত ধরে , সস্নেহে ওকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন ওর মায়ের কাছে। জলি কে এভাবে হাত ধরে নিজের কাছে আনছে দেখে সাবিত্রী একটু হকচকিয়ে গেল। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বললো,"আরে বুলি দি , কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। কবে এলে কানাডা থেকে? "তারপর কটকট করে জলির দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো। বেচারা জলি সরে যাচ্ছিলো ওখান থেকে। কিন্তু বুলি মাসি আবার ওর হাত ধরে ওকে ওখানেই আটকে দিলো। তারপর বললো,"কোথায় যাচ্ছো তুমি? চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আর সাবিত্রী এটা তোমার বড়ো মেয়ে তাই তো?" সাবিত্রী কথা ঘোরানোর জন্য বললো ,"বুলি দি, এসো আমার ছোট মেয়ে রিংকি র সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। " বুলি মাসি আবার মা কে বললো , শুনলাম তোমার বড় মেয়ে দারুন ছবি আঁকতে পারে। ওর হাতের ছোঁয়ায় ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা ছবি নাকি জীবন্ত হয়ে ওঠে।" মা রিংকি কে টানতে টানতে নিয়ে এলো বুলি মাসি র কাছে, কেন সেটা জলি জানে না। বুলি মাসি কিন্তু রিংকি র রূপ নিয়ে কোনো কথাই বললো না। আর সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার বুলি মাসি এরপর নিজের ছেলেকে ডেকে পাঠালেন কাউকে দিয়ে। তারপর সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে নিজের সুপ্রতিষ্ঠিত ছেলের সঙ্গে পরিচয় করালেন সবার আগে জলির।রিংকি আর মা একপাশে দাঁড়িয়ে আছে, অথচ জলি র মধ্যে কি এমন দেখেছিল বুলি মাসি, জলি সেটা বুঝতে পারছিল না। তারপর নিজের ছেলেকে বুলি মাসি বলছিল, "অসাধারণ গুণ জলির জানিস তো বাবিন। আমি অবশ্য এখানে এসেই জানলাম সব।সেই থেকে এই মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করবার ইচ্ছা টা সামলাতে পারছিলাম না।" তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাবিন কে বললো ,"দেখ তো এই ব্ল্যাক বিউটি কে তোর পছন্দ কি না? যদি হ্যাঁ বলিস তবেই কথা আগে বাড়াবো। আর এই যে মেয়ে, তোমার আমার ছেলেকে কেমন লাগলো বলো" জলি হতভম্ব এ হেন মন্তব্যে।তার মতো কালো মেয়ে, যাকে কিনা কথায় কথায় মা , বোনের অপমান সহ্য করতে হয়, শেষে তার জন্য এইসব অপেক্ষা করেছিলো এই বিয়ে বাড়িতে।
আসলে বুলি মাসি মায়েদের পাড়ায় থাকতো। বন্ধু র মতো মায়েদের সঙ্গে বড়ো হয়েছে। তারপর বিয়ের পর কানাডা চলে গিয়েছিল। দু বছরে একবার করে আসে। এবার এসেছে মামা নিজের ছেলের বিয়েতে নিমন্ত্রণ করেছে বলে।এসে সবার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে,জলির যে এতো গুণ , সেটা ও মামা মামীদের থেকেই জানতে পেরেছে। আর তারপর থেকেই নাকি নিজের ছেলের বউ করবে বলে জলির ব্যাপারে খোঁজখবর ও নিচ্ছিল।আর তারপরের ঘটনা তো সব সামনেই। ঘটনার আকস্মিকতায় মা আর রিংকি একটু হকচকিয়ে গিয়েছিল। মা এটা ভাবতেই পারেনি যে তার রূপে ঝলমল করা মেয়ে থাকতে, শেষে কিনা মায়ের ওই কালো মেয়ে টাকেই বুলি মাসি আর তার ছেলে পছন্দ করলো। এরপর বুলি মাসি বাবা, মা দুজনকেই জিজ্ঞেস করেছিলো, তারা তাদের এই ব্ল্যাক বিউটি কে ,বুলি মাসি র ছেলের হাতে দেবেন কিনা। বাবা তো আনন্দে কেঁদে ফেলেছিল। আর জলির শুধু ঠাকুমার বলে যাওয়া একটা কথাই মনে পড়ছিল,"তোর গুণ ই একদিন তোর পরিচয় হবে দিদিভাই। তখন কেউ তাকাবে না তোর এই রঙের দিকে। তোর গুণের ছটায় একদিন তুই ঝলমল করবি।"
ঠাকুমাকে আজ খুব মনে পড়ছে জলির।
সমাপ্ত