Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

4  

Manab Mondal

Abstract Fantasy Inspirational

ভুতের মেলা

ভুতের মেলা

5 mins
425


ফুলিয়া মানে শুধু তাঁত শিল্প নয়। ফুলিয়া মানে কীর্তিবাসের জন্ম স্থান, যবন হরিদাসের ভজনস্থলী বা সাধনপীঠ। হরিদাস ঠাকুর কথা হয়তো অনেকর অজানা, জাতিতে মুসলমান হয়েও তিনি শ্রীচৈতন্যের একান্ত অনুরক্ত ভক্ত হয়েছিলেন। তিনি সবসময় নাম জপ করতেন। মুসলমান হয়েও বৈষ্ণবীয় ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থাকার অপরাধে এ রাজের শাসনকর্তা তাঁকে ‘বাইশ বাজারে’ বেত্রাঘাত করার আদেশ দেন। তবু তিনি হরিনাম ছাড়েন নি। যাইহোক নদীয়ার ফুলিয়া একটা পবিত্র তীর্থস্থান।এই ফুলিয়াতেই নববর্ষের দিন আয়োজিত হয় ভুতের মেলা।

বাংলা নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে ফুলিয়া তালতলায় ভূতের মেলার জাঁকজমক ও ভিড় চোখে পড়ার মত‌। ভূত বলছি বটে, আসলে তা কবন্ধ (মস্তকবিহীন মূর্তি)। নদিয়া ভূতের মেলা আসলে একটা লোকদেবতার পূজা।লোক মুখে মুখে এটিই ভূত মেলা নামে জনপ্রিয় হয়েছে ।

কবন্ধ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা আগে , এই মেলা সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে চাই।কবন্ধের পুজো ঘিরে মেলায় মাত শান্তিপুরে ফুলিয়ার তালতলা গ্রাম প্রতিবছরই। প্রায় ষাট বছরের বেশি সময় ধরে এই কবন্ধের পুজো চলে আসছে সাথে আয়োজিত হয় মেলা। এই বর্তমানে জনপ্রিয় হয়েছে পেয়েছে ভুতের মেলা নামেই। আমরা জানি এক সময়ে ওপার বাঙলায় থেকে বহু মানুষ এই বাংলায় ফুলিয়াতে এসে বসবাস শুরু করেছেন। সেই সব মানুষদের পূর্ব পুরুষেরা এই পুজো করতেন ওপার বাঙলায় । ওপার বাঙলা থেকে এদেশে চলে আসার পরে, তাঁদের পূর্ব পুরুষরা এখানেও এই পুজোর প্রচলন করেছেন।

বাংলাদেশ নিশকাইন্দার নামে এক দেবতার পূজা হয় যাকে ভুত দেবতা বলে পূজিত হয়। তবে কবন্ধ আর নিশকাইন্দার এক নয়।বরং নিশকাইন্দার কাছাকাছি আরেকটি ভূতদেবতার ‘নিশিকান্ত’ মিল বেশি। । নদিয়া এলাকার ফুলিয়া গ্রামে এই নিশিকান্তের থান। এটিও স্থানীয় অপদেবতা তবে আদিতে নিশিকান্তর পূজা হতো বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার বামনকুইটা গ্রামে। সেই গ্রামের বসাক পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে ভূতদেবতা নিশিকান্তের পূজা করতেন। দেশভাগের পর তাঁরা নদীয়া চলে যান। সেখানে গিয়ে নিশিকান্তের পূজার প্রচলন করেন। নদীয়ার নিশিকান্তের মূর্তির ছবির সঙ্গে অনেকটাই মিল আছে নবাবগঞ্জের নিশকাইন্দার মূর্তির।

কবন্ধ পূজার যাবতীয় উদ্যোগশুরু হয়ে যায় চৈত্রমাসেই । গাজন উৎসবের মতো এখানেও শিবের পাটা মাথায় নিয়ে সন্ন্যাসীরা ঘোরেন গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে । এলাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করেন ,চাল, ডাল, আনাজ ইত্যাদি। 'ভুক্তা'-বলে একে । দিনের শেষে তাঁরা কোনো একটি জায়গায় বসে তা রান্না করে খান। তাঁরা এই সময় নিরামিষ খান । এই জায়গায় পয়লা বৈশাখের দিনই পুজিত হয় একটি কবন্ধ মুর্তি।কবন্ধ মুর্তি মাটির ওপরেই শায়িত থাকে। এই মূর্তি তৈরি করেন স্থানীয় বাসিন্দারাই। যার মাথা থাকে না, চোখ, নাক ইত্যাদি ঢুকে থাকে শরীরের একটু নীচের দিকে। গলা থাকে না।

তবে কবন্ধের এই রূপ কেন ? সেটা জানতে হলে যেতে হবে রামায়ণ কাহিনীতে।রামায়ণ অরণ্যকাণ্ড

বলা হয়েছে রাম, লক্ষণ জটায়ুর অন্তিম সংস্কার করে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন । চারপাশে বন জঙ্গল আর টিলা। দূরে ঋষমূক পর্বত দেখা যাচ্ছে,এই পর্বতে মতঙ্গ মুনির আশ্রম । তা রাম ও লক্ষণ জানতেন  । মতঙ্গ মুনি তখন জীবিত নেই। তবুও তাঁর পবিত্র আশ্রম আছে সেখানে তাঁরা যাবেন। তারা দুজনে যেতে যেতে দশানন রাবণের আর সীতা সম্বন্ধে নানা কথা আলোচনা করতে করতে এগুতে থাকলেন তারা বনের মধ্য দিয়ে ।

হঠাত একসময় মনে হল যেনো সহস্র হাতী একসাথে ধেয়ে আসছে। বনের গাছ গুলি তৃণ মতো উপরে পড়লো । মুহুর্মুহু চরণ ফেলবার শব্দে চারিপাশ কম্পমান হল ভূমিকম্পের মতো। কে যেনো গাছ গুলিকে উপরে ফেলে করে তাদের দিকে আসছে । রাম ও লক্ষণ উভয়ে ধনুর্বাণ উচিয়ে ধরলেন । তাদের সামনে এক অদ্ভুদ দৈত্য বের হল। তাঁর বড়ই বিকট দর্শন চেহারা। এই সেই কবন্ধ। অতি স্থূল, পর্বতপ্রমাণ দীর্ঘ চেহারা। ধড়ে মুণ্ড নেই। বুকে বিশাল চোখ, নাকের গর্ত এক দুটি গহ্বরের মতো। রক্তবর্ণ ওষ্ঠের মধ্যে বিশাল তীক্ষ্ণ হাতিদাঁতের মতো দন্তসাড়ি বেরিয়ে আছে । সেই কবন্ধ বলল- “আহা বড়দিন বাদে নর মাংস ভোজনের সুযোগ এসেছে। রোজ রোজ পশুপক্ষী ভোজন করে ক্লান্ত হয়েছি। আজ মানুষের মাংস খাবো।” রাম , লক্ষণ বললেন- “কবন্ধ! বাঁচতে চাইলে সামনে থেকে পলায়ন কর। আমাদের ক্রোধের বলি হবে।” কবন্ধ জানালো- সে এই মানুষের থেকে ভীত নয়। এই বলে দুই হাত দিয়ে রাম লক্ষণ কে ধরল। রাম বললেন- “তবে তুই মর ।” এই বলে রাম খড়্গবাণ নিক্ষেপ করলেন। রাম তীরে কবন্ধের দুই হস্ত কেটে আলাদা হয়ে গেলো। 

কবন্ধ বলল- “আপনারা কারা? আপনারা কোন সাধারন মানব নন।” রাম ও লক্ষণ নিজ পরিচয় দিলেন, রাবণ দ্বারা সীতা হরণ কথাও জানালেন । কবন্ধ বললেন- “হে প্রভু রামচন্দ্র! আপনি সেই বৈকুণ্ঠের বিষ্ণু । অভিসাপে আমার এই অবস্থা হয়েছিল । আগে আমি সুন্দর এক দানব ছিলাম । কিন্তু রূপে যৌবনে অহঙ্কার জন্মায় আর অহঙ্কার থেকে হয় সর্বনাশ। একসময়ে আমি এইরূপ মায়াবলে বিকৃতরূপ ধরে এখানে সাধু সন্ন্যাসীদের ভয় দেখাতাম । একদিন মহর্ষি স্থূলশিরাকে ভয় দেখানোর পাপ করেছিলাম। মহর্ষি স্থূলশিরা বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে আমাকে এই বিকৃত রূপে সদা এখানে থাকবার অভিশাপ দিয়েছিলেন। মহর্ষি জানিয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণু ধরিত্রীতে অবতার ধারন করে এখানে এসে যখন আমার হস্তদ্বয় ছিন্ন করে আমাকে কৃপা করবেন, তখনই আমার মুক্তি ঘটবে। এরপর দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধের সময় দেবরাজ ইন্দ্রের বজ্রের আঘাতে আমার রূপ হয়। আমার মাথা , বুকে প্রবেশ করে। হে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র , আমাকে আপনি মুক্তি দান করুন। আমাকে আগুনে সমর্পণ করুন।” রামচন্দ্র কৃপা করলেন। কবন্ধকে মুক্তি দান করতে, আগুন জ্বালিতে বললেন লক্ষণকে । ভগবান রাম কবন্ধকে প্রশ্ন করলেন- “আমার স্ত্রী সীতাকে, রাবণ অপহরণ করে নিয়ে গেছে। তুমি জানো সে কোথায় সীতাকে নিয়ে গেছে?” কবন্ধ বলল- “প্রভু! দেবী সীতাকে রাবণ কোথায় নিয়ে গেছে তা আমি জানি না। কিন্তু সীতাদেবীকে খুঁজে বের করার একটি উপায় আমি জানি। আমাকে আগে আগুনে প্রবেশ করতে দিন। বর্তমানে এই পিশাচ রূপে আমি কোন শুভ কর্ম করতে অসমর্থ।” কবন্ধ অগ্নিতে প্রবেশ করলে, তাঁর দেহ দাহ হয়ে এক সুন্দর দেবতা প্রকট হলেন। রামচন্দ্রকে বন্দনা করে বললেন- “প্রভু! সামনেই ঋষমূক পর্বতে বানররাজ বালির ভয়ে তার ভ্রাতা সুগ্রীব , হনুমান, জাম্বুবান , নল, নীল লুকিয়ে আছে। বালিকে মতঙ্গ মুনি বহু পূর্বে শাপ দিয়েছিলো। যার ফলে বালি এই পর্বতে আসতে পারে না। আপনি সুগ্রীবের সাথে মিত্রতা করুন। বানরেরা অবশ্যই মাতা সীতাকে খুঁজে বের করবে।” এই বলে কবন্ধ মুক্তি পেয়ে ভগবানের ধামে গমন করলো।

এই কবন্ধ নাকি শিব ভক্ত ছিলেন। তাই শিবের পূজার সাথে সাথে শিবের সঙ্গী হিসেবে তাঁর পূজা করা হয় পয়লা বৈশাখে। হয়তো অশুভের বিনাশে পর শুভ সুচনা প্রতীক এই পূজা।




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract