ভুতের হাসি
ভুতের হাসি
ব্যাপারটা বলার মত তেমন কিছু নয়। অনলবাবু গল্প লেখেন। কলকাতার বড় কাগজে ছাপাও হয়। সব ঠিকঠাকই ছিল। মুশকিল হল এ বার ভূতের গল্প লিখে। এর আগে কোনও দিনই ভূত নিয়ে লেখা হয়নি ওনার । নিজে ভীতু মানুষ। সাহস হয়নি। কিন্তু গত সপ্তাহে এক বোকা ভূত নিয়ে মজার গল্প লিখেছেন। মিনি পড়েই বলেছিল, ‘জেঠু, ভূত নিয়ে মজা করাটা কিন্তু ঠিক হল না।’
‘কেন বল তো? অনেকেই তো লেখে। তা ছাড়া সবটাই তো গল্প, নাকি? হাঃ হাঃ হাঃ। কী, ঠিক কি না? বল।’
‘ঠিক না ভুল তুমিই বুঝবে, আমার কী!’ মিনি আর কথা বাড়ায়নি।
ব্যস, ঘটনা ওইটুকু। আর সে দিন থেকেই অনলবাবু কেমন যেন উলটোপালটা স্বপ্ন দেখছেন। অনেক কিছু ভুলে যাচ্ছেন। কথা বলতে বলতে থেমে যাচ্ছেন। গলাটা প্রায় শুকিয়ে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কোনও সময় হয়তো ভয় ভয় করছে। কোনও সময় বা বোকা বোকা লাগছে। অফিসে এসেও শান্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
এখন টিফিনের সময়। সবাই গল্পগুজব করলেও অনলবাবু একেবারেই চুপ।
‘কী ব্যাপার অনলদা, এত চুপচাপ কেন?’ তপন বাবু সেল ফোনটা টেবিলে নামিয়ে পাশের চেয়ারে বসলেন।
‘না, কিছু না।’
‘কিছু না বললেই হল? ক’দিন ধরেই দেখছি গুম হয়ে আছেন। নতুন কিছু গল্প মাথায় ঘুরছে নাকি?’
‘না, না। ও কিছু না, এমনিই।’
‘বুঝতে পারছেন না তপনদা, আজ পয়লা এপ্রিল না! কথা বললে যদি, বোকা হয়ে যান। তাই মুখে তালা। হাঃ হাঃ হাঃ।’ প্রলয়ের কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
কথাটা কিন্তু মিথ্যে নয়। মিনি সাবধান করেছিল, ‘জেঠু, আজ কিন্তু বোকা বানাবার দিন।’ অনলবাবু শুকনো মুখে হেসেছিলেন। এ আরেক উটকো বিপদ! যাক গে। দিনটা ভাল ভাবে কেটে গেলেই হল ।
বিকেলে হঠাৎ আকাশে মেঘ ডাকতেই অনলবাবুর ভয়টা আরও চেপে বসল। মনে হল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরা দরকার। বড় রাস্তার মোড় থেকে পথটুকু বেশ নির্জন। আজ আবার টর্চ, ছাতা সব ভুলেছেন।
বাইরে বৃষ্টি নামল। হালকা, ঝিরঝির। পড়ুক। একটু হাঁটলেই বাস স্টপেজ। অনলবাবু ঘড়ি, কাগজপত্তর, টিফিনবাক্স এমনকী মোবাইল সেট, সব কিছু ব্যাগে ভরে নিয়ে চেয়ার ছাড়লেন। ‘আজ উঠি, বুঝলেন।’
‘সে কী! আমরাও তো যাব নাকি?’
অনলবাবু বেরিয়ে এলেন। কিছু বললেন না। তপন বাবু অবাক! যাঃ বাবা! কী হল কী?
বাস থেকে নামতেই আলো যেন ফুরিয়ে গেল। বড় রাস্তার মোড়ে তেমন লোকজনও নেই। অনলবাবু চারুর চায়ের দোকানের দিকে এগোলেন। বৃষ্টি এখনও থামেনি। গুঁড়িগুঁড়ি পড়ছে। কিছু ক্ষণ অপেক্ষা করা যেতে পারে। ও মা। কোথায় চারু? সন্ধ্যের মুখেই দোকান বন্ধ করে পালিয়েছে। কী আর করা যায়। অনলবাবু এ বার সোজা বাড়িমুখো।
আবছা আলোতে হাঁটাই মুশকিল। তার ওপরে বেয়াড়া হাওয়া সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। ভিজে জামাকাপড়ে শীত শীত করছে। হঠাৎ একটা চাপা শব্দ কানে এল অনলবাবুর। তিনি চার পাশে তাকালেন। শুনশান পথ। ঠিকঠিক দেখাও যাচ্ছে না। মনের ভুল নয়তো। না, তা কী করে হয়? শব্দটা অস্পষ্ট হলেও তিনি ঠিকই শুনেছেন।
এখনও বেশ কিছুটা পথ বাকি। শব্দটা এখন নেই। ভিজতে ভিজতে নিজেকেই কেমন ভুতুড়ে মনে হচ্ছে অনলবাবুর। গাছগুলো আরও বেশি ঝাঁকড়া দেখাচ্ছে। ভাবতে ভাবতেই আবার সেই শব্দ। কীসের শব্দ বুঝতে পারছেন না। বৃষ্টির? না। পাখির? না। মনে হচ্ছে যেন কোনও দুষ্টু বাচ্চার হাসির শব্দ। কিন্তু এখানে বাচ্চা কোত্থেকে আসবে? আশেপাশে কোনও জনবসতিও নেই। কেউ কি মজা করছে? তাই বা কী করে হয়? কেউ তো নেই। সামনে শুধু আঁকাবাঁকা মোরামের রাস্তা। আবার সব চুপ। শব্দ উধাও। গলা শুকিয়ে কেমন দলা পেকে যাচ্ছে। তার মানে কি মিনির কথাই ঠিক? ভাবতেই গা-হাত-পা আরও ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। অনলবাবুর এখন মনে হচ্ছে, কেন যে ও-সব লিখতে গিয়েছিলাম। আজ শেষ রক্ষা হলে হয়। ওই ওই সেই শব্দ। চাপা খিলখিল শব্দটা এ বার পায়ে পায়ে এসে গায়ের ওপর পাক খাচ্ছে। এ দিকে পথ যেন ফুরোয় না। অনলবাবু ভয়ে প্রায় ছুটতে শুরু করলেন। ভুতুড়ে শব্দটা এখনও তাড়া করছে।
তারপর কিভাবে যে উনি বাড়ি অবধি পৌঁছলেন তা উনি নিজেও জানেন না। বাড়ীর দরজায় পৌঁছে খুব জোরে জোরে দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। দরজা খুলেই মিনি তো অবাক! জেঠুর জামাকাপড় জলকাদায় মাখামাখি। ধপাস করে অনলবাবু সোফায় বসলেন। ঢকঢক করে জল খেলেন। এখন একটু ভাল লাগছে।
‘কী হল জেঠু, শরীর খারাপ?’ মিনি একটা তোয়ালে এনে দিল।
‘না রে, রাস্তাটা এত অন্ধকার!
তা ছাড়া আজ টর্চ, ছাতা সবই ভুলেছি তো, বেশ অসুবিধেয় পড়েছিলাম।’ আসল কথাটা চেপে গেলেন অনলবাবু।
‘তা ফোন ধরছিলে না কেন?’
‘ফোন?’
হ্যাঁ। তখন থেকে আমরা ফোন করছি, তপন কাকু ফোন করছে, তুমি তো ধরছই না।’
‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। ব্যাগের মধ্যে ফোনটা রেখেছিলাম তো, বুঝতে পারিনি। কেন তপনবাবু কিছু বলছিলেন নাকি?’
‘কী আর বলবে? তুমি তো নিজেরটা ফেলে তপন কাকুর ফোনটা ভুল করে নিয়ে এসেছ, সেটাই বলছিল।’
‘তাই নাকি? দেখেছিস, কখন যে ভুল করে...।’ ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতে গিয়ে চমকে গেলেন অমলবাবু। কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই সেই দুষ্টু বাচ্চার হাসির শব্দটা এ বার ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল হাঃ হাঃ হাঃ-হিঃ হিঃ হিঃ...।
প্রথমটায় ভয় পেলেও এ বার লজ্জা পেলেন অনলবাবু। ছি, ছি, এত ক্ষণ তপন বাবুর মোবাইলের রিং টোন ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত কি না একটা রিং টোন ওকে এপ্রিলফুল করে দিল!
‘কী হল ফোনটা ধরো।’ মিনি চেঁচাল।
অনলবাবু চুপ। কিন্তু ফোনটা এখনও হাসছে।
