ভোরের সূর্য্য পর্ব সাত
ভোরের সূর্য্য পর্ব সাত
পর্ব সাত
- ম্যাডাম ! যতদূর খবর পেয়েছি বিপাশাকে বিষাদগ্রস্ত করে ওকে রাঁচি পাঠিয়ে দেয় গাজী । আমি রাতের অন্ধকারে গাজীর আস্তানা ছেড়ে পালিয়ে যাই । আমি জানতাম সে আমাকে পাকড়াও করবেই । তাই এক ট্রাক ড্রাইভারকে টাকা খাইয়ে হাত করি । সে আমাকে কলকাতায় নিয়ে আসে । আমি কলকাতার ভীড়ে মিশে যাই ।
কিছুদিনের মধ্যেই আমার টাকা পয়সায় টান পড়ে । আবার কোন কাজের খোঁজ করতে থাকি। পকেটে স্কুল ফাইনালের এডমিট এবং মার্কশীট । বিভিন্ন অফিসে - সরকারী বেসরকারী , কল-কারখানা এমনকি গাড়ির গ্যারাজেও গিয়ে দরবার করি ।
এক সরকারি অফিসে পিওনের পদ খালি ছিল । খবর পেতেই আবেদন করি । আবেদন পত্র হাতে জমা দিতে গিয়ে দেখি কয়েক হাজার আবেদন ইতিমধ্যে পড়ে আছে। কেউ গ্রাজুয়েট, কেউ ইঞ্জিনিয়ার । ভাবতে পারেন ম্যাডাম একজন ইঞ্জিনিয়ার ছেলে পিওনের পদে আবেদন করছে! আমি তো হাল ছেড়ে দি । ডাকও আসে নি ।
এরপর একটা গাড়ীর গ্যারাজে গিয় মালিকের সঙ্গে দেখা করি । সে বলে ' নিতে পারি তবে কিছু কশন মানি জমা করতে হবে ।' বলি - কত জমা করতে হবে ? মালিক বলে তিনমাসের মাইনে ।
ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারিনি । আমি তো চাকরিই করি না । মাইনের কথা আসে কি করে !
মালিক বলে - তিন মাস তোমার কাজ দেখব; এই তিন মাস কোন টাকাকড়ি দেব না তবে থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেব ।
আমি রাজী হয়ে যাই । ওই গ্যারেজে মেকানিকগিরি শিখছি । তিন মাস পর কাজে খুশি হয়ে মালিক আমাকে কাজে বহাল করে । মাইনে বাবদ এক হাজার প্রতি মাস ।
আমার মাথা ঘুরে যায় । ছ্যা: মাত্র এক হাজার ! মালিক বলে ' তবে কি এক লাখ দেব , হারামজাদা !'
আমি বললাম - কাকু থাকা খাওয়াটা ফ্রি করে দিন ।
আমার দিকে মোটা লেন্সের চশমার ফাঁকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল গ্যারাজকাকু । হয়তো মায়া হল । বলল - লেগে পড় ।
ব্যস ! শুরু হল সৎ ভাবে জীবন কাটানোর পালা । পিছুটান নেই । লেগে গেলাম কাজে ।
গাড়ি খারাপ হয় বা চাকা পাংচার হয় - গ্যারাজের সবসময় রমরমা অবস্থা । সকাল ন'টা থেকে রাত বারোটা গ্যারেজে ডিউটি । রাত দশটায় মালিক চলে যায় বাড়ি । গ্যারাজেই রাত কাটাই । খাওয়া পাশের হোটেলে । ডাল ভাত সবজি । এই হল বরাদ্দ । মাছ, মাংস বা ডিম আমার জন্য নয় । খেতে চাইলে পকেট থেকে টাকা দিয়ে খেতে হবে । খাইও মাঝেমধ্যে ।
এ ভাবেই চলছে । একদিন রাত এক দেড়টার সময় একটা স্কর্পিও এসে দাঁড়াল গ্যারাজের ঠিক সামনে । গ্যারাজে উঁকি দিয়ে দেখল কেউ আছে কি না । আমি আলো নিভিয়ে, ফ্যান চালিয়ে ঘুমিয়ে গেছি । গাড়ি থেকে নেমে চারজন গ্যারাজে ধাক্কা দিল । বললাম - এখন আর হবে না স্যার । যন্ত্রপাতি মালিক নিয়ে গেছে ।
ওদের একজন বলল - আরে গাড়ি সারাতে আসিনি । বাড়ি ঠিক করতে এসেছি । হুকুমদাস বারাণওয়ালের বাড়িটা তো এখানেই ?
আমি ভেতর থেকেই বললাম - রাস্তার উল্টোদিকে নাক বরাবর বাড়িটাই হুকুমদাসের ।
- একবার বেরিয়ে এস না ! ঠিক কোনটা দেখিয়ে দেবে ।
বলে হাজার টাকার দুটো নোট জানালার ফাঁক গলিয়ে নামিয়ে দিল । আমি পকেটে পুরে দরজা খুলে বাইরে এলাম । ওরা আমাকে জাপটে ধরল ।
- ব্যাটা ! পালিয়ে বাঁচবি ভেবেছিলি ! হা হা হা ফকরুদ্দিন গাজীকে ফাঁকি দেওয়া ? ওঠ ! গাড়িতে ওঠ! বলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে স্কর্পিওতে তুলে নিল ।
পেছনে পড়ে রইল খোলা গ্যারাজ , গ্যারাজের মালিক ।
সকালে এসে দেখবে আমি পলাতক । কি জানি আর কি কি ভাববে !
যাই হোক গাড়িতে উঠিয়ে ওরা দ্রুত রওনা দিল গাজী সাহেবের উদ্দেশ্যে । কিছু গালিগালাজ ছাড়া মারধর তেমন কিছু করেনি ।
শুধু বলেছিল - তোর কোন ভয় নেই শশাঙ্ক । আমরা তোকে প্রাণে মেরে দিতে দেব না । তবে আর কোনদিন এ রকম বিশ্বাসঘাতকতা করবিনে । দেখতেই তো পাচ্ছিস গাজী সাহেব হাজার হাজার চোখ ! ও কিন্তু গন্ধ শুঁকে বলে দেয় কে কোথায় আছে !
কি সাংঘাতিক লোক রে বাবা ! ফের মনে পড়ে গেল বিপাশার ওই কথাটা - ' শাঁখের করাতে গলা বাড়িয়েছিস !'
নিজের কপালকে মেলাতে পারিনি স্যার । আজও মিলেনি । তা না হলে; জেলের সর্বময় কর্তা সস্ত্রীক এক মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর সঙ্গে অবলীলায় ডিনার করছেন, হৃদ্যতা দেখিয়ে আমার জীবন কাহিনী শুনছেন !
স্যার, আমি জানি ভোর বেলায় আমাকে স্নান করিয়ে, শুদ্ধ জামা কাপড় পরিয়ে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হবে । তারপর .......
( চলবে )
