ভোরের সূর্য্য পর্ব একত্রিশ
ভোরের সূর্য্য পর্ব একত্রিশ
পর্ব একত্রিশ
শশাঙ্কর বোন সরস্বতী এবং গুলাবী বউ পুলিশের কাছে এক সম্পূর্ণ নতুন ধরণের বয়ান দিয়েছে । তা' নিয়ে পুলিশ মহলে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে গেছে ।
গুলাবীর আসল নাম ফারজানা । গরীবনাথ মন্দির এলাকার কোন এক জায়গায় তার পৈত্ক নিবাস । একটা ছোট্ট দু' রুমের টালির ঘর । বাপ মা মরা ফারজানা । একমাত্র ভাই উসমানের বয়স পাঁচ। নিতান্ত শিশু । পেটের দায়ে ফারজানা দেহের বিনিময়ে খদ্দের জোগাড় করত । আর তাদের দেওয়া টাকায় সংসার চালিয়ে নিত ।
দলছুট অবস্থায় ফকরুদ্দিন গাজী মোল্লা মজ:ফরপুর শহরে এসে পৌঁছালে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের প্রয়োজনে মন্দিরের আশেপাশে ঘুরঘুর করছিল ।
ফারজানা গাজীকে দেখে খদ্দের ভেবেছিল । ভাব জমিয়ে পরিচয় করে নিল । ফারজানার বয়স তেমন কিছু নয় এগারো বারো হবে । কিন্তু বয়সের তুলনায় শরীরটা একটু বেশী চোখে পড়ার মত । গায়ের রঙ ময়লা নয় ; তবে পরিস্কারও নয় । কিন্তু মুখটা মিস্টি । কথাগুলোও তেমনি মধুমাখা ।
গাজীকে দেখে প্রথমে পাত্তা দেয়নি । ভাবল খদ্দের নিজের থেকে এলে ভালো দাঁও মারতে পারবে । গাজী এসেছিল । তবে অন্য খদ্দের হতে । বলল - এ লড়কি ! ইয়েহি কহি কিরায়া পর ঘর মিলেগা ।
ফারজানা যেন হাতে চাঁদ পেল । বলল - হাঁ মিলেগা। লেকিন ভাড়া পানশো সে এক পয়সা কম নেহি হোগা হাঁ।
গাজী এত সস্তায় ঘরভাড়া পেয়ে যাবে - ভাবতেই পারেনি ।
বলল - পানশো কেয়া হাজার রুপেয়া দেগা । পহলে লে তো চল ।
ফারজানা ভীষণ আদর করে ঘরে নিয়ে এল । পাশের রুমটা দেখিয়ে বলল - এ দেখিয়ে।
গাজী দেখল না । ঢুকে পড়ল রুমে । একটা ছ'ফুট বাই সাড়ে তিন ফুটের চৌকি পাতা ছিল । গাজী ওখানে বসে বলল - ইয়ে লে এডভান্স হাজার ।
এক হাজার ! ফারজানা নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করে না । টুক করে নোটটা হাতিয়ে বলল - বগলমে একহি হিন্দু হোটেল হ্যায় ; খানা পিনা ওহি করনা পঢ়েগা ।
গাজী ফারজানার হাত ধরে টেনে প্রায় কোলের কাছে নিয়ে বলল - নাম কেয়া রে তেরা ?
- ফারজানা । মা বাপ নেহি হ্যায় । এক ছোটা ভাই হ্যায় - শাকিল - পাঁচ বরষ কা ।
- ইতনা ছোটা ? উমর কেয়া হ্যায় তেরা ?
ফারজানা উত্তর দেয় না । গাজী বুঝে যায় । আরও একটু কোলের কাছে তুলে নেয় ।
- সন্সার কোন দেখভাল করতা হ্যায় রে ; তু অকেলে ?
- হাঁ ।
- কেয়া করতি হ্যায় তু ?
ফারজানা উত্তর দেয় না । শুধু তার বুকখানা মেলে ধরে । গাজীর চোখ যায় সেই দিকে ।
গাজী একটা ভালো আশ্রয় পেয়ে যায় ।
এখানে দু'এক ঘর ছাড়া বাকি সকলে হিন্দু । তারা ফারজানাকে জানে তাই মেশে না । বাকিরা ঘৃণার চোখে দেখে ।
শাকিল উপস্থিত হয় ।
- এ কৌন হ্যায় বহনা ?
- হমারা চাচেরে ভাই ।
- কভি তো দেখা নেহি ।
ফারজানা ভাইয়ের গালে আলতো একটু ছুঁয়ে দিয়ে বলে - ক্যায়সে দেখোগে । ও তো ইয়াহা নেহি রহতা ।
- কাহাঁ রহতা হ্যায় ।
- বহোত দূর ইয়াহা সে - ওহি পাকিস্তান সে আয়া হ্যায় ।
গাজী মজা পেল । সে তো প্রকৃতই পাকিস্তান থেকে আসছে । কিন্তু তা' প্রকাশ করল না ।
শুধু বলল - বঢ়ি পক্কি লড়কি হ্যায় রে তু ! বলে গালে হাল্কা করে আঙুল দিয়ে আঘাত করে ।
ফারজানা ভাবে দরবেশ এসেছে । বলে - কিতনে দিন তক রহো গে ?
- জনম ভর । গাজী হাসে ।
ফারজানা আনন্দে ভেসে ওঠে ।
- তো ডেলি হোটেলকা খানা খানে কা কেয়া জরুরত । ঘরমেহি মিল জায়েগা । লেকিন উসকে লিয়ে .....
- হাঁ হাঁ জানতা হুঁ । রুপেয়া লগেগা । বোল কিতনা দুঁ ?
- মুঝে কেয়া পতা !
গাজী বলে - ঠিক হ্যায় সব খরচা ম্যায় দুঙ্গা ।
- পাক্কা ?
- বিলকুল পাক্কা ।
গাজীর এই উঠতি বয়সের মেয়েটিকে খুব পছন্দ হয়ে যায় । তা-ছাড়া ও তো বলেই দিয়েছে চাচেরা ভাই । এখানের লোকেরাও জেনে যাবে তা' । কেউ আর কোনরকম মাথা ঘামাবে না ।
ঘামায়নিও কেউ । প্রথম দিকে গাজী বাড়ি ছেড়ে বেরোত না । ফারজানাকেও যেতে দিত না । শুধু শাকিল বেরোত স্কুলে যাবার জন্য ।
মাস ছয়েক এমনি কেটে গেল । গাজী, ফারজানা, শাকিল।
ফারজানাকে একদিন শাদি করে নিল গাজী । কিন্তু অন্ধকার জগতে আলো আর কতক্ষণ । ফারজানাকে বাজারে পাঠিয়ে গাজী একটা বলের মত দেখতে বোমা বাড়ির উঠানে রেখে দিল । শাকিল বাড়ি ঢুকেই দেখে একটা সুন্দর বল নামানো আছে । নতুন বলের গন্ধ শুঁকতে গিয়েই মিথেন গ্যাস ঢুকে পড়ল নাকে। দম বন্ধ হয়ে গেল শাকিলের । গাজী ছোট্ট দেহটা নিয়ে গিয়ে কুয়োয় ফেলে দিল ।
তিনদিন পর দেহ ভেসে উঠলে ফারজানাকে বলল - কবর দে দো। নেহি তো পুলিশ ঝামেলা পাকায়েগা ।
বিশ্বাস করে ফারজানাও গাজীর কথায় সায় দিল ।
( চলবে )
